সীমান্ত হত্যা : একটি পর্যালোচনা

সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যা বাড়ছে৷ বাড়ছে মারণাস্ত্রের ব্যবহার৷ ভারত প্রতিনিয়তই সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছে। প্রাণঘাতী গুলি ব্যবহার না করার কথা বলেছেন বিএসএফের কর্তা ব্যক্তিরা। তবে বাস্তবতা হচ্ছে সীমান্তে বাংলাদেশের বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা বন্ধ হয়নি, গুলিবর্ষণের হার কমেওনি। দিন দিন বাড়ছেই সন্দেহভাজনদের আক্রমণাত্মক ভীতি প্রদর্শন, নির্দয়ভাবে প্রহার এবং নির্যাতন। মানুষকে পাখির মতো গুলি করে মারা হচ্ছে নৃশংসভাবে।

বন্ধুরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি রক্ষার না করার এধরনের উদাহরণ পৃথিবীতে বিরল। অথচ বন্ধুদেশের সাথে সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ হবে তো বটেই, তা মর্যাদাপূর্ণও হতে হবে। ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের ‘দেখামাত্র গুলি’র ক্ষমতা চর্চা বন্ধুত্বের সম্পর্কের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বের যে সম্পর্ক, তা অব্যাহত রাখতে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এড়াতে হবে। সারাবিশ্বের কোনো দেশে এরকম হত্যাকাণ্ড দেখাতে পারবেন না। পৃথিবীর কোনো দেশে এরকম তিনদিকে কাঁটাতার দেখাতে পারবেন না।

বাংলাদেশ সীমান্তেই কেন হত্যা?

ভারতের সাথে ৬টি দেশের স্থল সীমান্ত রয়েছে। এ দেশগুলো হল পাকিস্তান, চীন, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার ও বাংলাদেশ। আর ভারতের সমুদ্র সীমান্ত রয়েছে শ্রীলংকার সাথে। আমরা এও জানি, এই সবগুলো দেশের সীমান্তেই ভারতের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বা বিএসএফ মোতায়েন আছে।

স্বাধীনতার পর ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত সবসময়ই অশান্ত ছিল এবং এখনো রয়েছে। বাংলাদেশ ছাড়া অন্য ৫টি দেশের সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে কোনো লোক নিহত হওয়ার কোনো খবর কিন্তু চোখে পড়ে না। নেপালে সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের বর্ডারে তো মাসের পর মাস, দিনের পর দিন এধরনের হত্যার ঘটনা ঘটে না। শুধু বাংলাদেশ সীমান্তেই কেন এই হত্যা?

বাংলাদেশিদের জীবন তাদের কাছে এত মূল্যহীন যে তুচ্ছ কারণে বা খেলাচ্ছলেও তারা গুলি চালিয়ে এক একটি জীবন প্রদীপ নিভিয়ে দেয়। এ রকম পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের জন্য তাদের কোনো জবাবদিহি করতে হয় না। তাই সীমান্তে বিএএসএফের হাতে খুন হওয়া বাংলাদেশিদের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছে। বাংলাদেশ সীমান্তে বিএসএফের হাতে খুন হওয়া শত শত নিরীহ নিরপরাধ মানুষের অসহায় পরিবারের করুণ আহাজারি যেন চলছেই, চলবেই।

সীমান্তে নিহতরা আসলে কারা?

বিএসএফের হাতে নিহত নিরীহ বাংলাদেশিদের বেশিরভাগ মারা গেছেন ভারত থেকে গরু আনার সময়। কেউ মারা গেছেন বাংলাদেশ সীমানায় নিজের ক্ষেতে কৃষিকাজ করার সময়। আর কিছু লোককে বিএসএফ বাংলাদেশ সীমান্তের অভ্যন্তর থেকে ধরে নিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছে। অধিকাংশ বাংলাদেশি হত্যার ঘটনাই ঘটেছে বাংলাদেশের মাটিতে, ভারতে অনুপ্রবেশকালে নিহত হয়েছে এমন নয়। ক্ষেতে কর্মরত কৃষক বা মাঠ দেখতে যাওয়া নিরীহ মানুষকে গুলি করে খুন করা কেন? লোকজনকে ধরে নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে বা পাথর ছুঁড়ে হত্যা, লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া কেন?

সীমান্ত এলাকায় বসবাসরত বাংলাদেশের দরিদ্র নাগরিকরা বিভিন্ন প্রয়োজনে বাংলাদেশ সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে যাতায়াত করেন। এর মধ্যে রয়েছে জরুরি চিকিৎসাসেবা, আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে যাওয়া এবং কিছু অত্যাবশ্যকীয় পণ্য কেনা। শুধু সীমান্ত অতিক্রম নয়, জিরো লাইনের কাছে ভুলক্রমে চলে যাওয়ার কারণেও বাংলাদেশের নাগরিকরা হত্যার শিকার হয়েছেন। দরিদ্র পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হত্যার শিকার হওয়ায় অনেক পরিবার সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে। অথচ সীমান্তের শূন্যরেখার কাছে কৃষিজমিতে কৃষিকাজ বা নদীতে মাছ ধরার জন্য সীমান্ত পেরানোকে ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’ হিসেবেই দেখা হয় সীমান্ত এলাকায়।

ফেলানী খাতুন
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে কুড়িগ্রামের অনন্তপুর-দিনহাটা সীমান্তের খিতাবেরকুঠি এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া টপকানোর সময় ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ফেলানি খাতুনকে গুলি করে হত্যা করে বিএসএফের এক সদস্য

সীমান্ত হত্যা : ভারতের বক্তব্য কী?

সীমান্তে চোরাচালান ও বাংলাদেশ থেকে কথিত অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর বিতর্কিত শ্যূট-অন-সাইট (দেখামাত্র গুলি) নীতি বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বহাল আছে, যার প্রেক্ষিতে বিএসএফ কারণে কিংবা অকারণে বাংলাদেশি নাগরিককে গুলি করতে পারে।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বরাবরই সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের পক্ষে সাফাই গেয়ে আসছে। বিএসএফের পক্ষ থেকে যুক্তি দেখানো হয় যে, বিএসএফ সদস্যরা সাধারণ নাগরিকের ওপর গুলি ছোড়ে না। অস্ত্রধারী চোরাকারবারিরা দল বেঁধে জোয়ানদের ওপর আক্রমণ করে, তখন তারা আত্মরক্ষার্থে গুলিবর্ষণে বাধ্য হয়।

বিএসএফের সাবেক প্রধান রমণ শ্রীবাস্তবের ভাষায়, “কোনো মানুষের উচিত নয় এই শিকারগ্রস্তদের জন্য দুঃখ করা। তিনি দাবি করেন, যেহেতু এসব ব্যক্তি প্রায়ই রাতে, অবৈধভাবে ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশ করছিল, তাই তারা মোটেই ‘নির্দোষ’ ছিল না।”

২০২০ সালের ২ মার্চ ঢাকা সফররত ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা বলেন, ‘সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা দুই দেশের সম্পর্কের জন্য ভালো না। এই হত্যাকাণ্ডের মূল কারণ হচ্ছে সীমান্তজুড়ে ঘনবসতি এবং প্রচুর মানুষের বসবাস। পাশাপাশি সীমান্ত এলাকায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সীমান্তে হত্যার জন্য দায়ী।’

২০২০ সালের ২০ ডিসেম্বর বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাই কমিশনার বিক্রম কুমার দোরাইস্বামী বলেন, অবৈধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং অনুপ্রবেশের কারণে সীমান্ত হত্যা ঘটছে। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, এ ধরনের ঘটনা কেবল আত্মরক্ষার্থে ঘটছে। তারা সীমান্তের এপারে (বাংলাদেশ) কখনো গুলি করে না। দুই পাশেই একই মানুষ, সীমান্তে কে কোন দেশি তা পৃথক করা কঠিন।’

সীমান্ত হত্যা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন

সীমান্ত হত্যার ঘটনা মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। যদি বাংলাদেশের কোনো নাগরিক অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করেন তাহলে তার বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা না নিয়ে হত্যা কিংবা শারীরিকভাবে আঘাত করা গুরুতর অন্যায়। তাদেরকে গ্রেফতার করে প্রচলিত আইন মোতাবেক শাস্তি দেয়া যেত। ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশকালে তারা ভারতের প্রতি হুমকি হতে পারেন না। তাই বিএসএফ তাদের আটক করতে পারে, গুলি চালাতে পারে না।

যুদ্ধাবস্থা ছাড়া বন্ধুভাবাপন্ন দুই দেশের সীমান্তে এ রকম প্রাণহানি অস্বাভাবিক, অমানবিক। বিনাবিচারে গুলি করে মানুষ হত্যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না বরং তা আন্তর্জাতিক আইনের গুরুতর লঙ্ঘন। একটি প্রশিক্ষিত বাহিনীর সৈন্যরা কিন্তু চাইলেই এমনভাবে গুলি করতে পারে যাতে অপর ব্যক্তি মারা না যায়, কিন্তু তারা এমনভাবে গুলি করছে যাতে সাথে সাথে একজন নিরস্ত্র মানুষের মৃত্যু ঘটে ।

সীমান্ত হত্যার পরিসংখ্যান

মানবাধিকার সংস্থা অধিকার
২০০০ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ভারতের সীমান্তরক্ষা বাহিনী বিএসএফ এর গুলিতে কমপক্ষে এক হাজার ১৪৪ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন।’

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)
২০০৭ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে বিএসএফ গুলি ও শারীরিক নির্যাতনে হত্যা করেছে ৪২ জন বাংলাদেশীকে। ২০১৩ সালে মোট ২৭ জন বাংলাদেশীকে হত্যা করেছে বিএসএফ সদস্যরা। ২০১৪ সালে হত্যা করা হয়েছে ৩৩ জন বাংলাদেশীকে। আহত হয়েছেন ৬৮ জন। এ ছাড়া বিএসএফ ধরে নিয়ে গেছে ৫৯ জনকে। ২০১৫ সালে বিএসএফ হত্যা করেছে ৪৫ জন বাংলাদেশীকে; এর মধ্যে ৩১ জন গুলিতে এবং বাকি ১৪ জন শারীরিক নির্যাতনে মারা গেছে। ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত বিএসএফ ১৮ জনকে হত্যা করে।

২০১৯ সালে সীমান্তে ৪৩ জন বাংলাদেশী নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে গুলিতে ৩৭ জন এবং নির্যাতনে ছয়জন। আহত হয়েছেন ৪৮ জন। অপহৃত হয়েছেন ৩৪ জন। ২০১৮ সালে নিহত হয়েছেন ১৪ জন। আর ২০১৭ সালে ২৪ জন।

১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সালের এপ্রিল পর্যন্ত সীমান্তে ৩১২ বার হামলা চালানো হয়। এর মধ্যে ১৯৯৬ সালে ১৩০টি হামলা, ১৯৯৭ সালে ৩৯টি হামলা, ১৯৯৮ সালে ৫৬টি হামলা, ১৯৯৯ সালে ৪৩টি হামলা, ২০০০ সালে ৪২টি হামলার ঘটনা ঘটে।

সরকারি হিসাব
বিজিবির তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০১৭ সালের ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সীমান্তে বিএসএফ ও ভারতীয় নাগরিকদের হাতে মারা গেছেন ৯৩৬ জন বাংলাদেশি। এর মধ্যে বিএসএফের হাতে ৭৬৭ জন ও ভারতীয়দের হাতে ১৬৯ জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। ২০০৯ সালে ৬৭ জন, ২০১০ সালে ৬০ জন, ২০১১ সালে ৩৯ জন, ২০১২ সালে ৩৪ জন, ২০১৩ সালে ২৮ জন, ২০১৪ সালে ৪০ জন, ২০১৫ সালে ৪৫ জন এবং ২০১৬ সালে ৩১ জন নিহত হয়েছেন।

২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে সীমান্ত হত্যা বেড়েছে ১২ গুণ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর জাতীয় সংসদে দেয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে ২০১৭ সালে ১৭ জন এবং ২০১৮ সালে তিনজন এবং ২০১৯ সালে ৩৮ জন হত্যার শিকার হন।

সীমান্ত হত্যা : হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচ কী বলছে?

২০১১ সালের জুলাইয়ে হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচ সীমান্ত হত্যা নিয়ে বলে, “ভারত সরকারের বাংলাদেশের সীমান্তে বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স (বিএসএফ) দ্বারা হত্যা, নির্যাতন, ও অন্যান্য অনাচারের নতুন অভিযোগ একটি, দ্রুত পরিষ্কার, এবং স্বচ্ছ অপরাধের তদন্ত দায়িত্বগ্রহণ করা উচিত।”
হিউম্যান রাইটস্ ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়া পরিচালক, মিনাক্ষী গাঙ্গুলী বলেন, “সীমান্তে মানুষের উপর অত্যধিক বল ব্যবহার ও নির্বিচারে প্রহার অসমর্থনীয়। এইসব নির্যাতনের ঘটনা ভারতের আইনের শাসনের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রশ্নবিদ্ধ করে।”
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ’র প্রতিবেদনে জানানো হয় যে, সীমান্ত হত্যার প্রতিটি ক্ষেত্রে অভিযুক্তরা হয় নিরস্ত্র ছিল, না হয় তাদের হাতে শুধুমাত্র কাস্তে, লাঠি অথবা ছুরি ছিল। অনেক ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তিকে পেছন থেকে গুলি করা হয়েছিল, যা থেকে প্রতীয়মান হয় তারা পালাতে চেষ্টা করেছিল। খুব কাছ থেকে গুলি করা এবং শারীরিক অত্যাচারের ফলে মৃত্যুর ঘটনাও বিরল নয়। কোনো ক্ষেত্রেই মৃত ব্যক্তির কাছ থেকে প্রাণঘাতী অস্ত্র বা বিস্ফোরক সামগ্রী উদ্ধার হয়েছে বলে বিএসএফ দাবি করতে পারেনি।

মিডিয়ায় সীমান্ত হত্যার খবর

দেশের পত্র-পত্রিকাসহ আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় সীমান্তে বাংলাদেশের বেসামরিক নাগরিকদের হত্যার খবর গুরুত্ব সহকারে প্রচারিত হয়েছে এবং হচ্ছে। এমনকি খোদ ভারতীয় মিডিয়াতেও এ সংক্রান্ত বিভিন্ন সংবাদ ও গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলো সীমান্ত হত্যা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে ও সমস্যাটি সমাধানের উপায়-গুরুত্ব নিয়ে প্রবন্ধ-নিবন্ধ-প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

সীমান্ত হত্যা নতুন নয়

সীমান্ত হত্যার শিকার হয়েছে-

  • ১৯৭২ সালে ১৫জন
  • ১৯৭৩ সালে ২০ জন
  • ১৯৭৪ সালে ২৩ জন
  • ১৯৭৫ সালে ১১ জন
  • ১৯৭৬ সালে ১৬ জন
  • ১৯৭৭ সালে ২৭ জন
  • ১৯৭৮ সালে ১২ জন
  • ১৯৭৯ সালে ২২ জন
  • ১৯৮০ সালে ১৮ জন
  • ১৯৮১ সালে ১২ জন
  • ১৯৮২ সালে ১৯ জন
  • ১৯৮৩ সালে ১৬ জন
  • ১৯৮৪ সালে ২৩ জন
  • ১৯৮৫ সালে ২৭ জন
  • ১৯৮৬ সালে ৩০ জন
  • ১৯৮৭ সালে ১৭ জন
  • ১৯৮৮ সালে ১৩ জন
  • ১৯৮৯ সালে ১৭ জন
  • ১৯৯০ সালে ১৮ জন
  • ১৯৯১ সালে ১৫ জন
  • ১৯৯২ সালে ১৬ জন
  • ১৯৯৩ সালে ২৩ জন
  • ১৯৯৪ সালে ৩৯ জন
  • ১৯৯৫ সালে ৩৬ জন
  • ১৯৯৬ সালে ৩১ জন
  • ১৯৯৭ সালে ৩৩ জন
  • ১৯৯৮ সালে ৩৭ জন
  • ১৯৯৯ সালে ৩৮ জন
  • ২০০০ সালে ৩৯ জন
  • ২০০১ সালে ৯৪ জন
  • ২০০২ সালে ১০৫ জন
  • ২০০৩ সালে ৪৩ জন
  • ২০০৪ সালে ৭২ জন
  • ২০০৫ সালে ১০৪ জন
  • ২০০৬ সালে ১৫৫ জন
  • ২০০৭ সালে ১২০ জন
  • ২০০৮ সালে ৬২ জন
  • ২০০৯ সালে ৯৮ জন
  • ২০১০ সালে ৭৪ জন
  • ২০১১ সালে ৩১ জন
  • ২০১২ সালে ৩৮ জন
  • ২০১৩ সালে ২৯ জন
  • ২০১৪ সালে ৩৫ জন
  • ২০১৫ সালে ৪৫ জন
  • ২০১৬ সালে ২৯ জন
  • ২০১৭ সালে ২৫ জন
  • ২০১৮ সালে ১৫ জন
  • ২০১৯ সালে ৪৩ জন
  • ২০২০ সালে ৫২ জন।

বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার দেয়া পরিসংখ্যানের হিসেবে, বিএসএফ’র হাতে ২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছে ১ হাজার ১৮৫ জন বাংলাদেশি।

সীমান্ত হত্যার কয়েকটি আলোচিত ঘটনা

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে কুড়িগ্রামের অনন্তপুর-দিনহাটা সীমান্তের খিতাবেরকুঠি এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া টপকানোর সময় ২০১১ সালের ৭ জানুয়ারি ফেলানি খাতুনকে (জন্ম:১৯৯৬ সাল) গুলি করে হত্যা করে বিএসএফের এক সদস্য। ফেলানীর লাশ পাঁচ ঘণ্টা কাঁটাতারে ঝুলে ছিল। বাবার সঙ্গে ফেলানী নয়াদিল্লিতে গৃহকর্মীর কাজ করত। বিয়ের উদ্দেশে সে দেশে ফিরছিল।

২০১৫ সালের ১৯ আগস্ট নওগাঁর সাপাহারের করমুডাঙ্গা সীমান্তে ইসমাইল নামে এক দরিদ্র জেলে পুনর্ভবা নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে অন্ধকারে জিরো লাইনের কাছাকাছি চলে যান। এ সময় ৩১ বিএসএফের একটি টহল দল তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে নিষ্ঠুরভাবে মারধর করে। গুরুতর আহত অবস্থায় তিনি পালিয়ে আসেন এবং সাপাহার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তির পর পরই তার মৃত্যু হয়। তার পুরো শরীরে অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন ছিল।

২০১৫ সালের ২৭ অক্টোবর যশোর শার্শা উপজেলার সীমান্ত এলাকার ইছামতি নদীতে মাছ ধরার সময় মনিরুল ইসলাম নামে এক বাংলাদেশি জেলেকে হত্যা করেন বিএসএফ সদস্যরা।

২০১৫ সালের ৮ অক্টোবর ২১ বিএসএফের একটি দল দুর্গাপুরে বাংলাদেশ সীমান্তের ভেতরে প্রায় ৫০০ গজ ঢুকে পড়ে এবং নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে পাঁচজন গুলিবিদ্ধ হন। বিএসএফ সদস্যরা গ্রামবাসীর গরু, ছাগলও নিয়ে যান।

২০১৬ সালের ২৩ জুলাই বেনাপোলের পুটখালি সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হন শহিদুল ইসলাম ওরফে ফনি। ভোরবেলায় তিনি এবং আরো কয়েকজন ভারত থেকে গরু নিয়ে আসার সময় বিএসএফ তাদের উপর গুলি চালালে ফনি নিহত হন।

২০১৬ সালের ২২ জুলাই গোদাগাড়ি সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে নিহত হন আবুল কালাম আজাদ। তিনিও ভারত থেকে গরু নিয়ে আসছিলেন।

২০১৬ সালের ২০ জুলাই দিনাজপুরের ফুলবাড়ি সীমান্তে সাইফুল ইসলামকে ধরে পিটিয়ে হত্যা করেছে বিএসএফ।

২০১৬ সালের ১৪ জুলাই কুড়িগ্রামের রৌমারিতে একটি ব্রিজের উপর থেকে পাথর ছুঁড়ে বিএএসএফ খুন করে রাশেদুল ইসলাম নামে এক যুবককে।

২০১৬ সালের ১০ জুলাই নওগাঁর ধামইরহাটের চকিজিলা সীমান্তে গোলাপ হোসেন নামে আরেক যুবককে গুলি করে হত্যা করে তারা। তিনি সীমান্তের ২৬৫ নং মেইন পিলারের কাছে গেলে তাকে গুলি করা হয়।

আনম্যান্ড এরিয়াল ভেহিকেল বা ইউএভি সীমান্ত এলাকার ১০ থেকে ১২ হাজার ফুট উচ্চতায় চলাচল করবে

সীমান্তে চালকবিহীন ড্রোন

ভারত সম্প্রতি বাংলাদেশ সীমান্তে চালকবিহীন ড্রোন বিমান ব্যবহার করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ড্রোন তথা আনম্যান্ড এরিয়াল ভেহিকেল বা ইউএভি সীমান্ত এলাকার ১০ থেকে ১২ হাজার ফুট উচ্চতায় চলাচল করবে। আকাশ থেকে ছবি তোলার পাশাপাশি প্রয়োজন দেখা দিলে ড্রোন বিমান থেকে বোমা ফেলা হবে। গুলিও বর্ষণ করবে ভারতীয়রা। এ ব্যাপারে বিএসফকে সহায়তা করবে ভারতের বিমান বাহিনী।

সীমান্ত হত্যা বন্ধে করণীয়

সীমান্ত হত্যার দায় সরকার কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। সরকারের দুর্বল পররাষ্ট্রনীতি বদলানো দরকার। শুধু উদ্বেগ জানানো ও বৈঠকাদি যথেষ্ট নয়। দেশের মানুষের জীবন রক্ষার পাশাপাশি জাতীয় স্বার্থকে নিয়ে তৎপরতা বাড়াতে হবে।

দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় সীমান্ত হত্যাকাণ্ড সমস্যার সুরাহা হচ্ছে না। তাই সীমান্ত হত্যা বন্ধের জন্য বিষয়টি অনতিবিলম্ব আন্তর্জাতিক ফোরামে তোলা দরকার।

সীমান্তে যেকোনো অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে অপরাধীদের বিদ্যমান আইনে বিচার হবে এবং এটাই স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হওয়া উচিত।

বিএসএফ যাদেরকে হত্যা করেছে তাদের তালিকা করে ক্ষতিপূরণ দাবি করতে হবে ভারতের নিকট।
বাংলাদেশের মন্ত্রীদেরকে সতর্ক সচেতন হতে হবে বাক্যবানে। বিরত থাকতে হবে বেফাস মন্তব্য করা থেকে।
সরকারকে অবশ্যই সীমান্ত হত্যার প্রতিবাদে সংসদে নিন্দা প্রস্তাব পাস করতে হবে এবং আন্তর্জাতিকভাবে এর বিচার করতে হবে।

সমাপনী কথা

ফেলানীসহ কোনো বাংলাদেশীই আকস্মিক দুর্ঘটনার শিকার হয়নি। তাদের রীতিমতো টার্গেট করে, ফেলানীর মতো ক্ষেত্রে পয়েন্ট র্যাং ক দূরত্ব থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। সর্বব্যাপী নিন্দা ও প্রতিবাদের মধ্যেও এখনো সে কর্মকান্ডই চালিয়ে যাচ্ছে বিএসএফ। বিডিআর যখন ছিল তখন বিএসএফ কিন্তু এত বেশি দুঃসাহস দেখাতো না। পদুয়াসহ সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় মাঝেমধ্যে সমুচিত জবাব দেয়ায় বিডিআরকে বিএসএফ বরং বাঘের মতো ভয় করতো। একই বিএসএফ বর্তমান বিজিবিকে সামান্য পাত্তা পর্যন্ত দিচ্ছে না।

Exit mobile version