পাপ করে, অতঃপর নির্ভয়ে বুক ফুলিয়ে বলার দুঃসাহস দেখে বেশ কিছু দিন ধরে একটা হাদিস মনে পড়ছে। আবু হুরাইরা রাঃ হতে বর্ণিত; এক লোক (মায়াজ বিন মালিক র) রাসূলুল্লাহ সাঃ এর নিকট এলেন। নবীজী মসজিদে বসে ছিলেন। লোকটি তখন উচ্চ স্বরে বললো- ইয়া রাসূলুল্লাহ! আমি ব্যাভিচার করেছি। তখন তিনি লোকটি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। আবার লোকটি নবীজী’র সাঃ চেহারার দিকে গিয়ে একই কথা বললো। এবারও নবীজী মুখ ফিরিয়ে নিলেন। এভাবে চারবার নিজের ওপর সাক্ষী দিলেন।
অতঃপর নবীজী তাকে ডাকলেন এবং বললেন- তোমার মধ্যে কি পাগলামি আছে? সে বললো- না। তুমি কি বিবাহিত? সে বললো- হ্যাঁ। তখন রাসূলুল্লাহ সাঃ বললেন- তোমরা তাকে নিয়ে যাও এবং পাথরনিক্ষেপ করে হত্যা করো। (মুসলিম)
রাসূলুল্লাহ সা. বার বার মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন যাতে সে ফিরে যায়, নিজের গুনাহ গোপন রাখে। কারণ, যে পাপের সাক্ষী শুধুই সে নিজে, অপরাধ গোপন করে নিজের পাপবোধ থেকে সে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চেয়ে ফিরে আসতে পারে; সেখানে এভাবে প্রকাশ্যে ফলাও করছে কেন? চার বারের স্বীকারোক্তি তাকে শাস্তির যোগ্য করলো।
এবার চিন্তা করি সেই লোকটির কথা। তিনি পাপ করেছেন তা জানেন, আর এই পাপবোধ নিয়ে তিনি বাঁচতে চান নি। তাই আরেক হাদিসের বর্ণনায়- প্রথমে তিনি আবুবক্বর রাঃ, অতঃপর উমার রাঃ এর কাছে গিয়ে নিজের পাপের কথা জানালেন- সকলেই তাকে গোপনীয়তা বজায় রেখে ক্ষমা প্রার্থনার জন্য বললেন কিন্তু মায়াজের হৃদয় শান্ত হলো না। তিনি যার অধীনে ছিলেন, তিনি (হুজ্জাজ) তাকে নবীজী’র কাছে যেতে বললেন হয়তো নবীজী আল্লাহ’র কাছে ক্ষমা চাইবেন।
অন্য বর্ণনায় জানা যায়- হুজ্জাজের উদ্দেশ্যে নবীজী বলেছেন-“তুমি যদি তাকে তোমার কাপড় দিয়ে ঢেকে দিতে, তবে সেটা তোমার জন্য ভালো হতো” (আবু দাউদ) ইসলাম কাউকে শাস্তি দেয়ার জন্য যে উন্মুখ হয়ে থাকে না, তাও বুঝা যায়।
যাই হোক- এবার সেই যুগের লোকের সাথে বর্তমান নারী-পুরুষদের ঈমানের তুলনা করি। সবাই তাওবার কথা বললো,কিন্তু আল্লাহর ভয়ে নিজেই নিজের পাপের সাক্ষী দিয়ে শাস্তি মাথা পেতে নিলেন। কিন্তু বর্তমানে নারী-পুরুষরা প্রকাশ্যে, আনন্দ- উল্লাসের সাথে, আড্ডায় বন্ধুদের সাথে কিংবা সামাজিক মাধ্যমে ফলাও করে বলছে-‘ওমুক আমার গার্লফ্রেন্ড/ বয়ফ্রেন্ড’, ‘আমার গার্লফ্রেন্ড ওমুক রেস্টুরেন্ট পছন্দ করে- তাই তাকে সেখানেই নিয়ে গেলাম’, ‘আমার বয়ফ্রেন্ডের পছন্দের আইটেমটা আজ খেলাম’, ‘আমার গার্লফ্রেন্ড এটা গিফট দিয়েছে, তাই তাকে ট্রিট দিলাম’!
কত সুন্দর বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড সম্পর্ক! প্রকাশ্যে যিনার ঘোষণা! আসলেই তো গোপন করার কী আছে? এরা সাহসী (!) নারী-পুরুষ। তবে এমন দুঃসাহস কিভাবে আসে জানেন? এরা না নিজেকে ভালোবাসে, আর না আল্লাহকে-যিনি সবার সৃষ্টিকর্তা এবং যিনিই জানেন আমাদের জন্য কোনটা ভালো, কোনোটা খারাপ।
অথচ দেখুন- বর্তমানে একটা মেয়েও এটাকে স্বাভাবিক করে নিয়েছে যে- ‘সে তো আমার বয়ফ্রেন্ড, তার সাথে রুম ডেটিং এ যাওয়াই লাগবে’! আর এই মেয়েই যখন নিজের সবকিছু লুটিয়ে দেয়ার পর অত্যাচারের শিকার হয়, তখন নির্যাতনের প্রশ্ন আসে। আসে বিচারের দাবি। কিন্তু বিচার কি হয়? কোথাও শুধু হয়রানি, আদালতে দৌড়াদৌড়ি, জেল- জরিমানা, কোথাওবা মেয়ের আত্মহত্যা, কিংবা ধনীর পুত্র হলে কায়দা করে সবকিছু ঠিকঠাক করে নেয়া। তবে যে কথাটা না বললেই নয়- তাহলো- পাপ কাজের বিচার অবশ্যই দাবি রাখে কিন্তু সেই পাপের বিচার কিভাবে হবে যেটা প্রকাশ্যে, স্বেচ্ছায়, কিংবা সম্মতিতে হলো? এজন্যই পরকাল। এর জন্যই অন্তরে ভয় আর আল্লাহর জন্য ভালোবাসা।
গোপন পাপ উপলব্ধি করে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া যায়। কিন্তু প্রকাশ্যে বলে বেড়ালে, সবার কাছে নিজের সাহসের (!) জানান দিলে, সেটাকে উদ্ধত্য বলে। আর এমন উদ্ধত্যতা দেখানোর পিছনে পরিবারও কম দায়ী নয়, যেখানে নূন্যতম নৈতিকতার চর্চা নেই, ধর্মীয় জ্ঞান নেই। যেকারণে সামান্য পারিবারিক অনুষ্ঠানেও পরিবারের সন্তান নিজের গার্লফ্রেন্ড নিয়ে হাজির হয় এবং এটাকে অনুমোদনও দেয়া হয়!
আসলে যখন লজ্জা না থাকে, তখন মানুষ যা খুশি তাই করে। হাদিসে লোকটি আল্লাহর ভয়ে শাস্তির জন্য নিজের পাপকে গোপন করেননি, কিন্তু আফসোস! আজ আমরা পরকালে শাস্তির ভয় উপলব্ধি না করে, আনন্দের সাথে যিনার ঘোষণা করছি! আশাকরি নিচের আয়াতগুলো আমাদের ঈমান মজবুত করতে সহায়ক হবে-
“আসমানসমূহ ও জমিনে যা কিছু আছে তিনি তা জানেন এবং তিনি জানেন যা তোমরা গোপন করো এবং যা তোমরা প্রকাশ করো। আল্লাহ অন্তরসমূহে যা কিছু আছে সে বিষয়ে সম্যক জ্ঞাত (সূরা তাগাবুন, আয়াত-৪)
“যে এগুলো করে, সে শাস্তি ভোগ করবে। কিয়ামতের দিন তার শাস্তি দ্বিগুণ করা হবে এবং সেখানে সে হীন অবস্থায় স্থায়ী হয়ে’ (সূরা ফুরক্বান, আয়াত- ৬৮, ৬৯)
“আর যিনার নিকটবর্তীও হয়ো না, নিশ্চয়ই এটা অশ্লীল ও নিকৃষ্ট আচরণ” (বনী ইসরাঈল, আয়াত- ৩২)