সন্তানকে কোরআন শেখানোর উত্তম পদ্ধতি

সন্তানকে সহজে কোরআন শেখাবেন যেভাবে

মো: বাকীবিল্লাহ : আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে উত্তম সেই ব্যক্তি, যিনি কোরআন শেখেন এবং শিক্ষা দেন।

বাচ্চাদের কোরআন শিক্ষা দেওয়া তাদেরকে একটি বইয়ের বিধান ও এর শিক্ষার সাথে যুক্ত করা না, বরং তাদের আত্মার পুনর্জাগরণ, তাদের মন ও অন্তর্দৃষ্টি আলোকিত করা। প্রত্যেক মুসলিম পিতামাতার দায়িত্ব, সন্তানদের কোরআন শেখানো। শিশুদেরকে কোরআনের গল্পের মূল্য শেখাতে হবে। কোরআনের বিস্ময়কর বিষয়গুলি বুঝতে সাহায্য করতে হবে। তাদেরকে বুঝাতে হবে যে, কোরআন আমাদের জীবনের জন্য কতটা মূল্যবান।

বাচ্চাদের কোরআন শেখানো- একটি সচেতন প্রজন্মকে উন্নত সমাজ গঠনে সক্ষম করার জন্য সর্বোত্তম পদ্ধতি। যে সমাজ মহৎ ও উন্নত নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত।

যা-ই হোক, এই বিশাল দায়বদ্ধতার পরেও আপনার বাচ্চাদের জন্য কুরআন শেখা ততটা কঠিন নয় যতটা আপনি ভাবছেন। এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া; যা আপনি বাচ্চাদের বেড়ে ওঠার ধাপে ধাপে অনুসরণ করতে পারেন।

আপনি হয়তো ভাবছেন যে, এই যাত্রা শুরু করার সবচেয়ে উপযুক্ত বয়স কোনটি?

তাহলে শুনুন, আপনি যেদিন থেকে জানেন যে আপনি পিতা-মাতা হবেন, তখন থেকেই আপনার সন্তানকে কোরআন শোনানোর চেষ্টা করুন। শিশু কোরআনে শব্দগুলির সাথে পরিচিত হবে- যা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। তবে, ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে, কোনো শিশুর কোরআন শিখতে শুরু করার জন্য নির্দিষ্ট বয়স নেই, যদিও এর জন্য চার বছর বয়স যথাযথ বলে মনে করা হয়।

একটি শিশুর মানসিক ক্ষমতা ও বুদ্ধিগত প্রবণতা অন্যদের থেকে পৃথক হতে পারে। কিছু বাচ্চাকে মানসিকভাবে অন্যের তুলনায় পরিপক্ক বলে মনে হয়। সুতরাং আপনার শিশুর চিন্তা, আচরণ ও বৈশিষ্ট্য দেখে বুঝে নিন কখন থেকে তাকে কুরআন শিক্ষা দেবেন।

পিতা-মাতা হিসাবে আপনার বাচ্চাদেরকে কুরআন শিক্ষাদান ও গাইড করার জন্য এখানে কয়েকটি দরকারি পদক্ষেপ উল্লেখ করা হলো।

১. প্রথমত, গর্ভাবস্থায় পবিত্র কুরআন শোনার এবং তেলাওয়াত করার ক্ষেত্রে মাকে চেষ্টা করতে হবে। অনেক বিশেষজ্ঞ ও বিজ্ঞানী বলছেন, মায়ের পেটে ভ্রূণ তার আনন্দ বা ক্রোধের দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং জোরে জোরে মা যা শুনছে বা পড়ছে তা দ্বারা প্রভাবিত হয়। কিছু সমসাময়িক পণ্ডিত নিশ্চিত করেছেন, যে গর্ভবতী মা ঘন ঘন কোরআন শোনেন, তিনি কোরআনের সাথে সম্পর্কযুক্ত একটি সন্তানের জন্ম দেন।

২. আপনি বাচ্চাদের সাথে কথা বলুন। তাদেরকে আল্লাহ সুবহানাহু-ওয়া-তালা, কোরআনের গুরুত্ব এবং কেন আমাদের তাঁর শিক্ষাগুলি পালন করা উচিত তা সম্পর্কে বলুন। বাচ্চারা সর্বশক্তিমান আল্লাহর পরিচয় না বুঝে তার নির্দেশাবলি পড়া শুরু করতে পারবে না।

৩. পবিত্র কোরআনের প্রতি আপনার আগ্রহ দেখান। এর আয়াতগুলো উচ্চস্বরে তেলাওয়াত করুন। তবে নিশ্চিত করুন যে, বাচ্চারা আপনার চারপাশে রয়েছে। তাছাড়া আপনি কী করছেন তা তাদেরকে জানিয়ে রাখুন।
এটি তাদেরকে আপনার কার্যকলাপগুলি অনুকরণ ও অনুসরণ করতে আগ্রহী করে তুলবে। ফলে পরে কোরআন শিখতে ও মুখস্ত করতে তারা আরও অনুপ্রাণিত হবে। ভুলে যাবেন না যে, আপনি আপনার সন্তানের একজন আদর্শ মডেল। তারা আপনাকে যা কিছু করতে দেখবে, তা তারা অনুকরণ করবে।

৪. কোরআনের আয়াত জোরে জোরে পড়ুন। বাচ্চাদেরকে আপনি যে শব্দগুলি পড়ছেন, তা মুখস্ত করতে সহায়তা করবে।

৫. আপনার সন্তানকে তার নিজের জন্য একটি কোরআন কিনে দিন। মানবপ্রকৃতি উপহার ও মালিকানা পছন্দ করে। যদি পিতামাতারা এই সুযোগ কাজে লাগান, তবে তা বাচ্চাদের পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত ও মুখস্থ করতে উত্সাহিত করবে। এর দুর্দান্ত প্রভাব আপনি হাতেনাতে দেখতে পাবেন।

৬. সকালে ঘুম থেকে ওঠার সময় বাচ্চাদের প্রতিদিন কোরআন থেকে একটি আয়াত পড়ান।

৭. কোরআন সম্পর্কিত আপনার বাচ্চাদের কৃতিত্ব উদযাপন করুন। যেমন: তাজবিদের নিয়মসহ একটি নির্দিষ্ট সুরা তেলাওয়াত বা এর একটি বিশেষ অংশ মুখস্থ করা ইত্যাদি। এতে করে কোরআন মুখস্তকরণ আপনার আদেশ পালন নয় বরং বাচ্চাদের আবেগ ও আনন্দের কারণ হবে।

৮. আপনার বাচ্চাদের জন্য কোরআন থেকে কিছু গল্প বলুন। শিশু তার পিতামাতার সাথে কথা বলতে পছন্দ করে। তাদের সাথে গল্প বলতে বা শুনতে পছন্দ করে। শিশুকে যেসব আয়াত বা সুরা পড়াচ্ছেন, সেখান থেকে কোরআনের কিছু গল্প বেছে নেওয়ার চেষ্টা করুন। এতে করে কোরআনের প্রতি তার ভালোবাসা এবং শেখার আগ্রহ বৃদ্ধি পাবে।
এখানে আনন্দদায়ক ও আকর্ষণীয় গল্পগুলি বেছে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। কোরআনে আল্লাহ প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য অনেক ঘটনা বর্ণনা করেছেন। যেটা হয়তো আপনার শিশু উপলব্ধি করতে পারবে না। তাই তাদের জন্য উপযুক্ত ঘটনাবলি বেছে নিন।

৯. শিশুরা তাদের পড়াশুনায় যা শেখে তার সাথে কোরআনকে প্রাসঙ্গিক করার চেষ্টা করুন। যেমন- কীভাবে পড়তে ও লিখতে হয় তা কোরআন থেকে শেখান। আরবি লেখার অনুশীলন করতে কোনো আয়াত লিখে অনুশীলন করাতে পারেন। বাংলা হাতের লেখার ক্ষেত্রে কোরআনের কোনো আয়াতের তরজমা লেখাতে পারেন।

১০. পবিত্র কোরআনের বিশেষ শব্দগুলি খুঁজে করতে আপনার বাচ্চাদের নির্দেশনা দিন। এটি তাদের শব্দগুলি দ্রুত মুখস্ত করতে সাহায্য করবে করবে। যেমন- সুরা আল-ইখলাসে শব্দের অর্থ (আস-সামাদ) জিজ্ঞাসা করা। সুরা ফাতিহার আর-রহমান ও আর-রাহিম শব্দের অর্থ ও তাৎপর্য।

১১. আপনার বাচ্চাদেরকে পবিত্র কোরআন প্রতিযোগিতার অনুষ্ঠানগুলোতে উপস্থিতি নিশ্চিত করুন, যাতে তারা দেখতে পায় যে, তাদের বয়সী বাচ্চারা কোরআন তিলাওয়াত ও মুখস্থ করছে।

১২. আপনার বাচ্চাদের যেখানেই সুযোগ হয় কোরআন প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে উত্সাহিত করুন।

সব শেষে বলবো, বাচ্চাদের কোরআন শেখানোর জন্য আপনি যে পদ্ধতিই বেছে নেন না কেন, কোনোভাবেই তাদেরকে কোরআন শোনা বা পড়তে বাধ্য করবেন না। আপনার বাচ্চা যদি কোনো কিছু পছন্দ করে, সেগুলি থেকে তাদেরকে আটকে রাখবেন না। বরং দিনের একটি সময়কে কোরআন শেখার জন্য নির্দিষ্ট নিন। যাতে বাচ্চারা জানতে পারে যে, এই সময়টি কোরআন পাঠের জন্য নিবেদিত।
আপনি যদি তাদেরকে বাধ্য করেন তবে খেয়াল করবেন যে, বাচ্চারা আপনি যা পড়ছেন তাতে আগ্রহী হচ্ছে না। তারা কোরআন আত্মস্থ আরও বেশি সময় নেবে।
মনে রাখবেন, শিশুরা আমাদের প্রতিবিম্ব। তারা আমাদের মূল্যবোধ, আদব ও নীতির প্রতিনিধিত্ব করে। অতএব সর্বশক্তিমান আল্লাহর সঠিক শিক্ষার সাথে তাদেরকে অভ্যস্ত করতে সর্বোচ্চ ভালো উপায় অবলম্বন করুন। এবং জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যান।

Exit mobile version