একনজরে ভারতের ‘মিসাইলম্যান’

তামিলনাড়ু রাজ্যের উপকূল সংলগ্ন রামেশ্বারামের দরিদ্র দম্পতি জয়নুল আবেদিন-আশিয়াম্মা কখনো স্বপ্নেও ভাবেননি তাদের ছেলে জ্ঞানে বিজ্ঞানে ভারতকে নেতৃত্ব দেবে। এমনকি দেশের রাষ্ট্রপতির আসন অলঙ্কৃত করবে। কিন্তু সেই দরিদ্র বাবা-মার সন্তান আবুল পাকির জয়নুল আবেদিন আবদুল কালাম দেখিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি ভারতের শীর্ষ বিজ্ঞানী, প্রশাসক। ২০০২ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ভারতের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তিত্বদের মধ্যে তিনি অন্যতম।

বিজ্ঞানী এবং রাষ্ট্রপতি হিসেবে ভারতে তার অবদান অসামান্য। তার হাত ধরেই সাফল্যের শিখরে পৌঁছেছে ভারতের মহাকাশ গবেষণা। ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অরগানাইজেশনে তার অবদান অনেক। ভারতের রকেট ও মিসাইল প্রযুক্তিতে তার অবদান সর্বাগ্রে। ‘অগ্নি’, ‘পৃথ্বি’ এর মতো পরমাণবিক অস্ত্রবাহী মিসাইল প্রযুক্তি পূর্ণতা পেয়েছে তার হাত ধরেই। এজন্য তাকে ‘মিসাইল ম্যান অব ইন্ডিয়া’ বলে আখ্যায়িত করা হয়।

শৈশব ও বেড়ে ওঠা
এপিজে কালামের জন্ম ১৯৩১ সালের ১৫ অক্টোবর। পরিবারের দারিদ্র্য তার পড়াশুনার পথে বারবার বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পড়াশুনার ব্যয় সঙ্কুলান করতে কালাম অনেক ছোট কাজও করেছেন।

১৯৫৪ সালে তিরুচিরাপ্পালির সেইন্ট জোসেফ কলেজ থেকে স্নাতক করেন। তবে এ ডিগ্রি নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট ছিলেন না। পরের বছরই মাদ্রাজ চলে যান মহাকাশ বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে। সেখানে মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি) ভর্তি হন। বোনের গলার হার বিক্রি করে এই ভর্তির টাকা জুগিয়েছিলেন বলে শোনা যায়।

ক্যারিয়ার
এমআইটি থেকে স্নাতক সম্পন্ন করার পর কালাম ভারতের অ্যারোনটিক্যাল ডেভেলপমেন্ট স্টাবলিশমেন্ট অর্গানাইজেশনের (ডিআরডিও) প্রধান বিজ্ঞানী হিসেবে যোগ দেন। এখানেও সন্তুষ্ট হতে পারেননি। তখন ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশনে (আইএসআরও) স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকেল প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেন।

এখানে অনেকগুলো প্রকল্পে সাফল্যের সঙ্গে উৎরে যান কালাম। ১৯৭০ এর দশকে প্রজেক্ট ডেভিল এবং প্রজেক্ট ভ্যালিয়ান্ট নামে দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হাতে নেন তিনি। এই প্রকল্পের অধীনেই ভারত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে সক্ষম হয়।

এরপর এসএলভি প্রকল্পও সাফল্যের সঙ্গে শেষ করেন। এই এসএলভি রকেটে করে যখন রোহিনি-১ নামের মিসাইলটি সফলভাবে উৎক্ষেপণ করা হয় তখনই ভারত একটি মাইলফলক ছুঁয়ে ফেলে। এই সাফল্য ভারতকে মিসাইল তৈরি ও উৎক্ষেপণে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি এনে দেয়।

এই সাফল্য দেখেই ভারত সরকার কালামকে আরো উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্পের দায়িত্ব দেয়। তার অধীনেই পারমাণবিক অস্ত্রবাহী ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি হয়। এই অস্ত্র তৈরির প্রকল্পই এখন অগ্নি এবং ‍পৃথ্বি নামে অব্যাহত আছে।

১৯৯২ থেকে ১৯৯৯ সাল পর্যন্ত কালাম প্রধানমন্ত্রী এবং প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংগঠনের প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পান। এই সময় কালাম পোখরান-২ পারমাণবিক পরীক্ষার প্রধান প্রকল্প সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন। এই সাফল্যের পরই তিনি ভারতের মিসাইল ম্যান হিসেবে খ্যাতি পান।

কে আর নারায়নের পর ভারতের ১১তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে কালাম দায়িত্ব পালন করেন ২০০২ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত। প্রথম বিজ্ঞানী এবং চিরকুমার রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি ভারতের ‘রাষ্ট্রপতি ভবন’কে ধন্য করেন।

রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনকালে কালাম যেমন প্রশংসিত হয়েছেন তেমনি সমালোচিতও হয়েছেন। বিশেষ করে ২০ জনের প্রাণভিক্ষার আবেদনের ব্যাপারে তার নির্বিকার ভূমিকা অনেকে ভালোভাবে নেননি।

রাষ্ট্রপতি ও বিজ্ঞানী কালামের বাইরে একজন অত্যন্ত সংবেদনশীল লেখক কালামও আছেন। তিনি বেশ কিছু প্রণোদনামূলক ও প্রভাবশালী বই লিখেছেন। এর মধ্যে ‘India 2020’ সর্বাধিক পঠিত ও প্রশংসিত। এই বইয়ে ২০২০ সালের মধ্যে সুপারপাওয়ার হতে হলে ভারতকে কী ধরনের পরিকল্পনা ও পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে যেতে হবে সে ব্যাপারে একটি রূপরেখা দিয়েছেন তিনি। তার অন্যান্য বহুল পঠিত বইয়ের মধ্যে রয়েছে- ‘Ignited Minds’, ‘Mission India’, ‘Inspiring Thoughts’, ‘The Luminous Sparks’ ও ‘Wings of Fire’।

২০১১ সালে তিনি তরুণদের নিয়ে ‘What Can I Give Movement’ শীর্ষক দুর্নীতি বিরোধী আন্দোলন শুরু করেন।

মৃত্যুর আগে পর্যন্ত অনেক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে লেকচার দিয়ে বেড়িয়েছেন।

পুরস্কার ও সম্মাননা
কালাম ভারতের প্রায় সবক’টি বেসামরিক সম্মাননা পেয়েছেন। ‘পদ্মভূষণ’, ‘পদ্মবিভূষণ’ এবং ‘ভারতরত্ন’ সম্মাননা পেয়েছেন। এই সম্মাননাগুলো পেয়েছেন যথাক্রমে ১৯৮১, ১৯৯০ এবং ১৯৯৭ সালে।

জাতীয় ঐক্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ১৯৯৭ সালে তাকে ইন্দিরা গান্ধী সম্মাননা দেয়া হয়। পরের বছর ভারত সরকার কালামকে বীর সভাকর সম্মাননা দেয়।

চেন্নাইয়ের আলোয়ার রিসার্চ সেন্টার ২০০০ সালে তাকে রামানুজন সম্মাননায় ভূষিত করে। ২০০৭ সালে যুক্তরাজ্যের রয়্যাল সোসাইটি তাকে রাজা দ্বিতীয় চার্লস মেডাল দেয়।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি ২০০৯ সালে তাকে ইন্টারন্যাশনাল ভন কারমান উইংস সম্মাননা দেয়। একই বছর যুক্তরাষ্ট্রের এএসএমই ফাউন্ডেশন কালামকে হুভার মেডাল দিয়ে সম্মানিত করে।

বিশ্বে পেশাজীবীদের সবচেয়ে বড় সংগঠন আইইইই ২০১১ সালে সম্মানসূচক সদস্যপদ দেয়।

এছাড়া কালাম ৪০টি বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট পেয়েছেন। তার ৭৯তম জন্মদিনকে জাতিসংঘ বিশ্ব শিক্ষার্থী দিবস হিসেবে ঘোষণা দেয়। ২০০৩ এবং ২০০৬ সালে তিনি এমটিভি ইয়ুথ আইকন অব দ্য ইয়ার পুরস্কারের জন্য মনোনীত হন।

Scroll to Top