ছাত্রীকে বকা দেয়াই কাল হলো অধ্যক্ষের

হৃদয় ছিঁড়ে রক্ত ঝরছে আতাহার উদ্দিনের। তীব্র ব্যথায় কাতর গোটা শরীর। ফুলে গেছে গাল। বোবা কান্নায় ভিজে আসছে দুটি চোখ। কাঁদছে তার পরিবারও। এই কান্না যেন থামবার নয়। এই কান্না তিলে তিলে গড়ে তোলা সম্মান বিনাদোষেই খুইয়ে ফেলার কান্না।

নির্মম এক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে হৃদয় ভেজা রক্ত আর অশ্রুজলে একাকার সাভারের একমাত্র মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ আতাহার উদ্দিন।
মৃত্যু না হলেও যেন তার চেয়েও বেশি শোকের এই কান্না!

‘আমার তো একরকম মৃত্যুই হয়েছে। মরে গেলে তো কাঁদতে পারতাম না, এখন বেঁচে থাকতেই কাঁদছি’-নিজেকে সামলে নিয়ে এভাবেই অব্যক্ত কষ্টের কথা বলছিলেন সাভারের মোফাজ্জল- মোমেনা চাকলাদার মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ আতাহার উদ্দিন।

নিজ কলেজের প্রথম বর্ষের এক ছাত্রীকে কথিত শ্লীলতাহানির অভিযোগে চলন্ত বাসেই প্রকাশ্যে নাজেহাল, কলার ধরে টেনে হিঁচড়ে বাস থেকে নামিয়ে বিভ্রান্ত জনতার রোষের মাঝে ছেড়ে দেয়া, অত:পর থানা হাজতে। শেষ পর্যন্ত গণমাধ্যমে রগরগে খবরের শিরোনাম হয়ে সামাজিকভাবে অপমৃত্যু ঘটে প্রবীণ এই শিক্ষাবিদের।

প্রায় ২৪ ঘণ্টা থানা হাজতে থাকা অবস্থাতেই বেরিয়ে আসে আসল কাহিনী। শ্লীলতাহানির অভিযোগটি পরিণত হয় নিছক ভুলবোঝাবুঝির ঘটনায়!

থানা থেকেই মুক্তি মেলে তার। তবে ক্ষতি যা হবার তা হয়ে যায় এ সময়ের মধ্যেই। গণমাধ্যমে এই নিয়ে জ্বলজ্বলে শিরোনামে খবর আসায় একরকম সামাজিক সন্মানের মৃত্যু ঘটে এই শিক্ষাবিদের। আর এ নিয়েই যত কান্না আর অব্যক্ত বেদনা পরিবারটির।

অপপ্রচারের বলি হয়ে এখন সমাজের কাছে মুখ দেখাতে পারছে না প্রবীন এই শিক্ষাবিদের পরিবারের সদস্য, স্বজন ও আত্মীয়রা।

এক রকম ঘরবন্দি হয়েই দিন কাটছে তাদের। অথচ দু’দিন আগেও নানা সীমাবদ্ধতার মাঝেও হাসি আর খুশিতে পূর্ণতা ছিলো গোটা পরিবারে।

দীর্ঘ ১১ বছর ধরেই মোফাজ্জল-মোমেনা চাকলাদার মহিলা কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্বে আতাহার উদ্দিন। বয়স ৬০ এর কোটায়। নৈতিক স্খলন দূরের কথা! সকলের চোখে পরিচয় মৃদুভাষী ও মার্জিত একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে। স্ত্রী গত হয়েছে প্রায় দুই বছর।

আদরের তিন মেয়েকে নিয়ে ছোট্ট সংসার। মেয়েদের কেউ ভালো চাকরিতে। কেউ উচ্চ শিক্ষায়। সমাজের যে কোন অসঙ্গতি আর অন্যায়ের প্রতিবাদে বরাবর সামনের কাতারে থাকা মানুষটিকে জীবনের এই প্রান্তে এসে নিজ কলেজের ছাত্রীকে শ্লীলতাহানির মতো অপবাদের মুখে নাজেহাল ও লাঞ্ছিত হয়ে থানায় আটকে থাকা ও সংবাদের শিরোনাম হতে হবে এমনটি দু:স্বপ্নেও ভাবেননি তিনি।

অথচ খবরের কাগজে রগরগে শিরোনাম আর টেলিভিশনের তাৎক্ষণিক সংবাদ যেন সামাজিকভাবে সম্মানের মৃত্যু ডেকে আনে গোটা এ পরিবারটির।

কৌতুহলী সমাজের নানা প্রশ্নে ঘর বন্দি পরিবারের সদস্যরা বন্ধ রেখেছেন তাদের মোবাইল ফোন। তবে থেমে নেই মুক্ত মনের বিবেকবান মানুষ।

গণমাধ্যমে রগরগে খবরের শিরোনামের বিপরীতে সচেতন মানুষদের ক্ষোভ ও বেদনা উপচে পড়ছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে।

সকলের একটিই দাবি-যা হবার তা হয়ে গেছে এখন বিচারের মুখোমুখী করতে হবে এই ষড়যন্ত্রের কুশিলবদের। ফিরিয়ে দিতে হবে অধ্যক্ষের হারানো সন্মান।
আতাহার উদ্দিনের গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালী জেলায়।পরিবার নিয়ে থাকেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন শেনওয়ালিয়া গ্রামে।

ঘটনার শুরু সোমবার সকালে। সাভারগামী চলন্ত একটি বাসে। কলেজে যাবার জন্যে বিশমাইল থেকে বাসে ওঠেন কলেজের অধ্যক্ষ আতাহার উদ্দিন। ওই বাসেই তার আসনের সামনে বসা ছিলেন কন্যার চেয়ে ছোট বয়সী একই কলেজের মানবিক বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্রী রমিজা আক্তার। বেশ কিছু দিন ধরে কলেজে না আসার কারণ জানতে চাইলে ওই কলেজ ছাত্রী অধ্যক্ষের পাশের আসনে এসে বসেন। বলেন, মোবাইল ফোন চুরির ঘটনায় সহপাঠিনীর অভিযোগ, সেই সাথে আর্থিক অস্বচ্ছলতা তাকে কলেজ থেকে দূরে রেখেছে।

এক পর্যায়ে রমিজা ইংরেজি বিষয়ে নিজের দুর্বলতার কথা বলে অধ্যক্ষের সহায়তা চাইলে তাকে কলেজে ওই বিষয়েই বাড়তি ক্লাস করার পরামর্শ দেন আতাহার উদ্দিন।

রমিজা বলেন, স্যার আমাকে দেখে কলেজে না যাবার কারণ জিজ্ঞাসা করেন। আমি উত্তর দিতে তার আসনের কাছে এসে বসি।

তাকে জানাই পারিবারিক অবস্থার কথা। উপবৃত্তি না হলেও যেন বেতন মওকুফ করা হয় সে বিষয়ে তার সহায়তা চাই। তারপর কি থেকে যে কি হয়ে গেলো তার কিছুই বুঝতে পারছি না।

রমিজা বলেন, ওই বাসের যাত্রী এনাম মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ডিএম সুমন বাসের অন্যান্য যাত্রীদের বিভ্রান্ত করে স্যারকে নাজেহাল করেন এবং পরে স্থানীয় জনতা স্যারকে পিটুনি দিলে পুলিশ এসে তাকে তুলে নিয়ে যায়।

পরবর্তীতে বেরিয়ে আসে প্রকৃত ঘটনা। আসলে অধ্যক্ষকে হেনস্থা ও সামাজিকভাবে হেয় করতেই সাজানো ছিল ঘটনাটি। মানবিক বিভাগের এই শিক্ষার্থীর বাবার নাম আমির হাওলাদার। তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করার পর তার মা জাহানারা বেগম স্থানীয় একটি তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ নিয়ে মেয়েকে নিয়ে থাকতেন জিরাবো এলাকায়।

তার পরিবারের সাথে সখ্য গড়ে ওঠে একই এলাকার বাসিন্দা এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ডিএম সুমনের।

ইতোমধ্যে রমিজার একটি বিয়ে হয়। তবে স্বামীর সাথে বনাবনি না হওয়ায় গোটা পরিবারটিই ছিলো ডিএম সুমনের ওপর নির্ভরশীল।

কলেজ অধ্যক্ষ আতাহার উদ্দিন বলেন, সুমনের সাথে মেয়েটি বহুবার আমার বাড়িতে গিয়েছে ইংরেজি সাজেশনের জন্যে। ছেলেটির পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে সে জানাতো, সুমন তার আংকেল।

ঘটনার দিন কিছু বুঝে ওঠার আগেই মিথ্যে অপবাদ দিয়ে গাড়িতেই সুমন আমাকে নাজেহাল করে।

আমি মেয়েটির শ্লীলতাহানী করেছি– বানোয়াট ও কাল্পনিক এ অভিযোগ ছড়িয়ে জনতার হাতে আমাকে ছেড়ে দেয়।

এক পর্যায়ে আমি মেয়েটিকে চিৎকার করে সত্য কথা বলার অনুরোধ করলেও মেয়েটির নীরবতায় আমার ওপর জনতার অত্যচারের তীব্রতা আরো বাড়তে থাকে।

মেয়েটি আমার কলেজের ছাত্রী, আমি অধ্যক্ষ পরিচয় বার বার চিৎকার করে দেয়া সত্বেও আমাকে অপরিচিত প্রমাণ করার চেষ্টা চালায় সুমন।

আমাকে বলা হয় কলেজ পরিচালনা কমিটির সভাপতি কে? উত্তরে আমি আলহাজ্ব আব্দুল গনির নাম বললে ওই ছেলেটি জানান, ওই কলেজের সভাপতি তো স্বপন সাহা! জনতাও মিথ্যে মনে করে আমাকে মারধর করে। তারপর একজন সাংবাদিকদের কার্যালয়ে নিয়ে আমার বেশকিছু ছবি তোলা হয়। পরে থানায় খবর দিয়ে আমাকে তুলে দেয়া হয় পুলিশের হাতে।

আর মুহূর্তেই গোটা দেশে টেলিভিশনের স্ক্রলে এ খবর দিয়ে বলা হয় আমার আটকের কথা!

‘এই যুগে গাড়িতে কি করে প্রকাশ্যে শ্লীলতাহানি করা সম্ভব?

এমন ঘটনায় চালকের সহযোগী বা সহযাত্রীরাও কিছু আঁচ করতে পারলো না। মেয়েটি চিৎকার করেও প্রতিবাদ করলো না। অথচ তার সঙ্গে থাকা এক যুবক মেয়েটিকে চেনে এমন ভাব করে গুজব তুলে আমাকে নাজেহাল করলো। জনতাকে বিভ্রান্ত করায় কেউ আমার কথা আমলে নেয়নি। সবাই হুজুগে আমাকে পিটিয়েছে’-বলেই চোখ মুছতে থাকেন আতাহার উদ্দিন।

স্থানীয় সংসদ সদস্য ডা. এনামুর রহমান বলেন, বৃহস্পতিবার কলেজে জরুরি বৈঠক ডাকা হয়েছে।  জানা গেছে, রমিজার বিরুদ্ধে কিছু দিন আগে একই শ্রেণির সহপাঠী জেসমিন আক্তারের ট্যাব চুরির অভিযোগ আনেন তার মা দীপা বেগম। এর আগেও বেশ কয়েক ছাত্রীর মোবাইল ফোন চুরির ব্যাপারে সন্দেহ করা হয়েছিলো রমিজাকে।

তবে ট্যাব চুরির অভিযোগে তাকে সর্তক করে বকাঝকা করাই কাল হতে পারে বলে ধারণা কলেজ অধ্যক্ষের।

সাভার মডেল কলেজের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আব্দুল মোতালেব মিয়া  বলেন, ভ্রান্ত ও স্পর্শকাতর অভিযোগ এনে অধ্যক্ষকে যেভাবে হেনস্থা করা হয়েছে তা সত্যিই দু:খজনক। আমরা ক্ষুব্ধ জনতার রোষ দেখে প্রথমে ধরেই নিয়েছিলাম ঘটনাটি হয়তো সত্য। তবে প্রাথমিক তদন্তেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে ওঠে।

‘গোটা ঘটনাটিই ভুল বোঝাবুঝি’ – মেয়েটির মা থানায় এই মর্মে লিখিত দেয়ায় আমরা থানা থেকেই অধ্যক্ষকে ছেড়ে দিই। তবে তার যে ক্ষতি হবার তা হয়ে গেছে। সামাজিকভাবে তিনি অসন্মানিত হয়েছেন।

অধ্যক্ষের বড় মেয়ে ফাহমিদা নাজনীন তনিমা  বলেন, এ ঘটনায় বাবা মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েছেন। বিভ্রান্ত মানুষদের অমানবিক বর্বরতার কথা মনে করতেই মাঝে মাঝে ভয়ে কেঁপে উঠছেন তিনি।

যখন চায়ের দোকানে বাবার ছবিসমতে খবরের কাগজ হাতে সাধারণ মানুষ বক্রোক্তি করছিলো, আমরা তখন বাবাকে নিয়ে মুখবুজে নানুর বাসায় ফিরে আসি।
এটা কি ধরনের সমাজ। সমাজের কাছে আমার বাবা তো পচে গেলো। এর কি কোন বিচার নেই-বেশ ক্ষোভের সাথেই প্রশ্নগুলো করছিলেন তিনি।

অধ্যক্ষের পরিবার জুড়ে যেন শোকের আমেজ। মেজো কন্যা অনিমা খাওয়া দাওয়া ভুলে গেছে। বন্ধুদের একের পর এক জিজ্ঞাসার জবাবে চোখের পানি ফেলা ছাড়া কোন জবাবই দিতে পারেনি সে। ছোট্ট রিনি বাবার এ ঘটনায় দুদিন ধরে স্কুলে যাওয়াই ছেড়ে দিয়েছে। এদিকে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ ঘটনার বিচারের দাবিতে সরব হয়ে উঠেছে অনেকেই।

ঘটনার পরই ডিএম সুমন অধ্যক্ষকে নাজেহাল ও তাকে পিটুনি দেবার খবর ফেসবুকে নিজের দেয়ালে তুলে দিয়ে ঘোষণা দেয়, আগামীকাল ডেইলি স্টারে বিস্তারিত প্রতিবেদন ছাপা হবে। তবে সচেতন মানুষের প্রতিবাদের মুখে পরদিন ছবিগুলো সরিয়ে দেয় সে।

তবে দাবি করে, রমিজাকে সে চেনে না। শ্লীলতাহানির ঘটনার প্রতিবাদ করেছে মাত্র।

শহীদ সেহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মাসুদা বেগম শিখা তার ফেসবুকের দেয়ালে লিখেছেন, একজন বৃদ্ধ নির‍াপরাধ পিতৃতুল্য শিক্ষককে যখন ছাত্রীর শালীনতাহানির মিথ্যা অপবাদ দিয়ে থানায় দিয়ে আসা হয় আর সবগুলো টিভিতে তা দেখিয়ে তার ৬৫ বছর ধরে অর্জন করা সমস্ত সম্মান এক মিনিটেই মাটিতে মিশিয়ে দেয়া হয়, তখন ওই মিথ্যুক শয়তান, যে এসব করেছে, তার কি শাস্তি হওয়া উচিৎ?????

এনাম মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী প্রমা মজুমদার তার ফেসবুকের দেয়ালে লিখেছেন, স্যারকে ধরার সাথে সাথে ওই ছেলে ফেবুতে স্ট্যাটাস দিছে যে আগামীকাল ডেইলি স্টারে নিউজটা আসবে। ভাই মিডিয়া কি পকেটে নিয়া ঘুরেন যে ধরার ৫ মিনিটের মধ্যে বলে দিলেন কোন নিউজপেপারে আসবে। নাকি আগে থেকে প্ল্যান করা ছিল স্যারকে ফাঁসায়ে ডেইলি স্টারের সাংবাদিক ডাকুম? আর সাভারের মত জায়গায় এত ছোট একটা কলেজের প্রিন্সিপালের ঘটনা ঘটতে না ঘটতেই সব টিভি চ্যানেল আর সাংবাদিকদের মধ্যে প্রচার হয়ে গেল কিভাবে যদি কেউ ইন্টেন্শনালি ইনফর্ম না করে থাকে??

মোফাজ্জল- মোমেনা চাকলাদার মহিলা কলেজ পরিচালনা পরিষদের সভাপতি আবদুল গনি বাংলানিউজকে বলেন, এ ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত করে কঠোর শাস্তির দিলেই কেবল এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করা যাবে।

সূত্রঃ বাংলা নিউজ

Exit mobile version