যেসব বিখ্যাত আলেম নারী শিক্ষকের কাছে পড়াশোনা করেন

নারী শিক্ষকের কাছে পড়াশোনা করেছেন যেসব বিখ্যাত আলেম

মুসলিম সভ্যতার বিখ্যাত ইমামগণের অনেকেই নারীদের কাছে জ্ঞানার্জন করেন। তাঁদের একাধিক নারী শিক্ষক ছিলেন। কেউ কেউ তো প্রায় ১০০ নারী শিক্ষকের কাছে জ্ঞানার্জন করেন এবং যেসব নারী শিক্ষিকার কাছে জ্ঞানার্জন করেন গর্বের সাথে তাদের নাম, জীবনী উল্লেখ করেন।

একটি বিষয় বুঝতে হবে। এখনকার যুগে সার্টিফিকেটের ভ্যালু নির্ণয় করা হয় প্রতিষ্ঠান দিয়ে। যেমন: কেউ আল-আজহার থেকে পড়াশোনা করে, কেউ দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে, কেউ মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, কেউ ক্যাম্ব্রিজ বা অক্সফোর্ড থেকে। প্রতিষ্ঠান দিয়ে বুঝানো হয় তিনি কতো বড়ো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়েছেন।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রাতিষ্ঠানিক বিকাশের পূর্বে শিক্ষক দ্বারা ছাত্রের মূল্যায়ন হতো। অর্থাৎ, কতো বড়ো শিক্ষকের কাছে ছাত্র পড়াশোনা করতো, কতোজন শিক্ষকের কাছে পড়াশোনা করতো সেটার ওপর। এজন্য বিখ্যাত আলেমগণের জীবনী পড়তে গেলে দেখবেন তারা কাদের কাছে পড়াশোনা করেছেন সেটার তালিকা উল্লেখ করেছেন।

এভাবে যারা নারী শিক্ষিকার কাছে পর্দা মেনে পড়াশোনা করেছেন, তারাও সেইসব শিক্ষিকার নামোল্লেখ করেন। বড়ো বড়ো আলেম হয়েও তারা নারী শিক্ষিকার কাছে পড়েছেন এটা তাদের কাছে লজ্জার ছিল না; বরং মুসলিম ইতিহাসের শতো শতো বছরের সংস্কৃতি ছিল এটা।

শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট যুগ বা শতাব্দীর আলেমগণ নারী শিক্ষিকার কাছে জ্ঞানার্জন করেননি। বরং মুসলিম সভ্যতার প্রায় ১০০০ বছরের ইতিহাস দেখলে দেখা যায় প্রত্যেক যুগেই এমন ঘটনা পাওয়া যায়।
নারী সাহাবীদের কাছে অন্যান্য সাহাবী, তাবেয়ী পর্দার আড়ালে থেকে পড়াশোনা করেছেন এটা ইতিহাস পড়ুয়া সবাই জানেন।

লেটস ফোকাস অন রেস্ট অব দ্যা হিস্ট্রি।
ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (মৃত্যু ২৪১ হিজরি), আবু ইব্রাহীম আল তর্জুমানী (২৩৬), আলী ইবনে মুসলিম আল-তূসী (২৫৬), কাযী আবু ইয়ালা (৪৫৮) নারীদের কাছে জ্ঞানার্জন করেন।

ইমাম নাজমুদ্দিন ইবনে ফাহাদ (৮৮৫) ১৩০ জন নারীর কাছ থেকে ইলম অর্জন করেছেন। সহীহ বুখারীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাকার ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (৮৫২) তাঁর কিতাবে হিজরি অষ্টম শতাব্দীর ১৭০ জন নারী শায়েখের উল্লেখ করেছেন, যার মধ্যে ৫৪ জন থেকে তিনি নিজে হাদীস বর্ণনা করেন।

ইমাম ইবনে হাজারের ছাত্র আল্লামা সাখাবী (৯০২) ৮৫ জন নারী থেকে ইলম অর্জন করেছেন। তাঁর সমসাময়িক আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতি (৯১১) ৪৪ জন নারী আলেমের কাছ থেকে ইলম অর্জন করেছেন।
বিখ্যাত আলেম ও ইতিহাসবিদ হাফিজ ইবনে আসাকির (৫৭১) ৮০ জনের বেশি নারী আলেমের কাছে জ্ঞানার্জন করেন। যেসব নারী আলেমের কাছে তিনি জ্ঞানার্জন করেন তাদেরকে নিয়ে তিনি একটি জীবনীগ্রন্থ লিখেন।

তাঁর সমসাময়িক আবু সা’দ আল সাম’আনী (৫৬২) ৬৯ জন নারীর কাছে হাদীস শিখেন। হাফিজ আবু তাহির আল সিলাফী (৫৭৬) ১০ জন নারী আলেমের কাছ থেকে হাদীস শিখেন।

মুসলিম ইতিহাসের বিখ্যাত পলিম্যাথ, শায়খুল ইসলাম আল্লামা ইবনুল জাওযী (৫৯৭) ৩ জন নারী আলেমের কাছে জ্ঞানার্জন করেন। তাঁর সমসাময়িক আব্দুল গণী আল-মাকদিসী (৬০০) বেশ কয়েকজন নারী আলেমের কাছে জ্ঞানার্জন করেন।

বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ইমাম ইবনুল আসির (৬৩০), ইবনুল সালাহ (৬৪৩), হাফিজ আল-মুনজিরী (৬৫৬), মুহিব আল-তাবরী (৬৯৪) বেশ কয়েকজন নারীর কাছে জ্ঞানার্জন করেন।

শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া (৭২৮), ইবনে জামাহ (৭৩৩), ইবনে সায়্যিদ আন-নাস (৭৩৪), আবুল হাজ্জাজ আল-মিজ্জী (৭৪২), ইমাম আয-যাহাবী (৭৪৮), ইমাম ইবনুল কাইয়্যিম (৭৫১), তাজ উদ্দিন সুবকী (৭৭১), হাফিজ আল্লামা ইবনে কাসির (৭৭৪), আল্লামা যারকাশী (৭৯৪), আল্লামা ইবনে রজব হাম্বলী (৭৯৫), আল-বুলকিনী (৮০৫), হাফিজ আবুল ফযল আল-ইরাকী (৮০৫), আল্লামা ইবনুল জাজারী (৮৩৩), হাফিক শামসুদ্দীন আশ-শাখাওয়ী (৯০২) -সহ অনেক বিখ্যাত ইমামের নারী শিক্ষিক ছিলেন।

সেসব শিক্ষিকাদের কারো কারো ঘরের দরজায় পর্দা টানানো থাকতো, পর্দার আড়ালে থেকে তারা দারস দিতেন৷ কেউ কেউ মসজিদে দারস দিতেন।

সেইসব বিখ্যাত নারী আলেমা ও তাঁদের বিখ্যাত ছাত্রদের কাছে পর্দা জ্ঞানার্জনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি। বরং পর্দা মেনেও কিভাবে জ্ঞানচর্চা করা যায়, সেটা মুসলিম ইতিহাসের পূর্ববর্তী আলেমগণের জীবনী পড়লে জানা যায়।

এই ঘটনাগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বা শুধুমাত্র একটি যুগের ঘটনা নয়। উল্লিখিত আলেমগণের নামের শেষে ৮০০/৯০০ যে সংখ্যা আছে, সেগুলো ৮০০/৯০০ হিজরী সনের ঘটনা। অর্থাৎ, নবিজী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইন্তেকালের প্রায় ৮০০-৯০০ বছর পরের ঘটনা।

মুসলিম ইতিহাসে নারীরা কতো বড়ো মাপের জ্ঞানী হলে তারা সেই যুগের বিখ্যাত আলেমদেরকে পড়াতেন এটা ভাবনার বিষয়!
এমনকি বেশ কিছু সোর্স থেকে শুনেছিলাম, গত ২ বছরের মধ্যে ইন্তেকাল করা বাংলাদেশের বিখ্যাত মুহাদ্দিস, শায়খুল হাদীস একজনের নারী শিক্ষিক ছিলো। এটা গত ৫০ বছর আগের ঘটনা। ঘটনাটি শতভাগ নিশ্চিত হবার পর তাঁর নামোল্লেখ করবো, ইনশা আল্লাহ।

একজন নারী আলেম শুধুমাত্র ‘নারী’ হবার কারণে তার জ্ঞান প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি। নারী হওয়া তার জন্য ডেফিসিয়েন্সি ছিল না।

ইমাম আশ-শাওকানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:
“উলামায়ে কেরামের কারো পক্ষ থেকে এমন কথা পাওয়া যায় না যে, তিনি কোনো নারীর বর্ণনাকে ‘নারী’ হবার কারণে প্রত্যাখ্যান করেছেন। এমন বহু হাদীস রয়েছে যা একজন নারী বর্ণনা করেছেন আর গোটা উম্মত তা নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছে। ইলমে হাদীসে যার সামান্যতম জ্ঞান রয়েছে একথা অস্বীকার করতে পারবেন না।”

Scroll to Top