অন্তর মরে যাওয়া বলতে মানুষের হৃদয়ের আধ্যাত্মিক ও নৈতিক জাগ্রত অবস্থার লোপ পাওয়া বোঝায়। এটি একটি আধ্যাত্মিক অবস্থা, যখন মানুষের মন ও বিবেক আল্লাহর স্মরণ, সততার চেতনা, এবং সঠিক-ভুলের অনুভূতিতে প্রতিক্রিয়া দেখাতে অক্ষম হয়ে যায়। ইসলামী শিক্ষা অনুযায়ী, অন্তরের মৃত্যু মূলত মানুষের পাপ, আল্লাহর স্মরণ থেকে দূরে থাকা এবং নৈতিক অবক্ষয়ের ফল।
অন্তর মরে যাওয়ার লক্ষণ
- আল্লাহর স্মরণে অনুভূতিহীন হওয়া:
একজন ব্যক্তি আল্লাহর কালাম শুনলেও তার হৃদয়ে কোনো প্রভাব পড়ে না, সে আল্লাহর প্রতি নম্র বা অনুগত হয় না।
কুরআনে এসেছে:فَوَيْلٌ لِلْقَاسِيَةِ قُلُوبُهُم مِّن ذِكْرِ اللَّهِ ۚ أُو۟لَـٰٓئِكَ فِى ضَلَـٰلٍۢ مُّبِينٍ
“অতএব ধ্বংস তাদের জন্য যাদের হৃদয় আল্লাহর স্মরণ থেকে কঠিন হয়ে গেছে। তারা সুস্পষ্ট বিভ্রান্তিতে আছে।”
(সূরা যুমার: ২২) - পাপকে স্বাভাবিক মনে করা:
যখন কেউ বারবার পাপ করে এবং তাতে কোনো অপরাধবোধ অনুভব করে না, তখন এটি তার হৃদয়কে ধীরে ধীরে মেরে ফেলে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:“যখন বান্দা পাপ করতে থাকে, তার হৃদয়ে একের পর এক কালো দাগ পড়তে থাকে, যতক্ষণ না তার পুরো হৃদয় আচ্ছাদিত হয়ে যায়।” (তিরমিজি: ৩৩৩৪) - সৎ কাজ থেকে দূরে থাকা:
সৎকর্ম বা ন্যায় পথে চলার প্রেরণা হৃদয়ে জাগ্রত না থাকলে, অন্তর নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। আল্লাহ বলেন:كَلاَّ بَلۡ رَانَ عَلَىٰ قُلُوبِهِم مَّا كَانُواْ يَكۡسِبُونَ
“না, বরং তাদের হৃদয়কে তাদের কাজ কর্মের কারণে ঢেকে দেওয়া হয়েছে।”
(সূরা মুতাফফিফিন: ১৪) - আল্লাহর প্রতি ভয়ের অনুপস্থিতি:
অন্তর যখন মরে যায়, তখন ব্যক্তির হৃদয়ে আল্লাহর ভয় থাকে না। সে ভুল পথে চলে এবং পাপ করতেও দ্বিধাবোধ করে না।
মানুষের হৃদয় আল্লাহর স্মরণ, নৈতিকতা, এবং আত্মশুদ্ধির অভাবে মরে যায়। তবে পবিত্র কুরআন ও হাদিসে এ সম্পর্কে গভীর দিকনির্দেশনা রয়েছে। নিম্নে আরবি আয়াতসহ বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
হৃদয় মরে যাওয়ার কারণ
১. আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখতা
আল্লাহ বলেন:
وَمَنْ أَعْرَضَ عَنْ ذِكْرِي فَإِنَّ لَهُ مَعِيشَةً ضَنكًا وَنَحْشُرُهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَعْمَىٰ
“যে আমার স্মরণ থেকে বিমুখ থাকে, তার জীবিকা সংকীর্ণ হয়ে যায় এবং আমি তাকে কিয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় উঠাবো।”
(সূরা ত্বহা: ১২৪)
আল্লাহর স্মরণ থেকে বিমুখ হওয়া হৃদয়কে কঠিন করে তোলে, ফলে মানুষ ভুল পথে পরিচালিত হয়।
২. পাপ ও গুনাহের অভ্যাস
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন:
إِنَّ الْعَبْدَ إِذَا أَخْطَأَ خَطِيئَةً نُكِتَتْ فِي قَلْبِهِ نُكْتَةٌ سَوْدَاءُ…
“যখন বান্দা কোনো গুনাহ করে, তখন তার হৃদয়ে একটি কালো দাগ পড়ে। যদি সে তওবা করে, গুনাহ ত্যাগ করে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে, তবে তার হৃদয় পরিষ্কার হয়ে যায়। কিন্তু যদি সে গুনাহ বাড়িয়ে চলে, সেই দাগ ধীরে ধীরে পুরো হৃদয়কে ঢেকে ফেলে।”
(তিরমিজি: ৩৩৩৪)
পাপ হৃদয়কে কলুষিত করে এবং আল্লাহর দয়ার থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।
৩. দুনিয়ার প্রতি অতিমাত্রায় আসক্তি
আল্লাহ তাআলা বলেন:
بَلْ تُؤْثِرُونَ الْحَيَاةَ الدُّنْيَا وَالْآخِرَةُ خَيْرٌ وَأَبْقَىٰ
“তোমরা দুনিয়ার জীবনকে অগ্রাধিকার দাও, অথচ পরকালই উত্তম ও স্থায়ী।”
(সূরা আল আ’লা: ১৬-১৭)
দুনিয়ার প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি মানুষের আত্মাকে আধ্যাত্মিক দিক থেকে দুর্বল করে দেয়।
হৃদয় জীবিত করার উপায়
১. আল্লাহর স্মরণ ও কুরআন পাঠ
আল্লাহ বলেন:
الَّذِينَ آمَنُوا وَتَطْمَئِنُّ قُلُوبُهُم بِذِكْرِ اللَّهِ ۗ أَلَا بِذِكْرِ اللَّهِ تَطْمَئِنُّ الْقُلُوبُ
“যারা ঈমান এনেছে এবং তাদের হৃদয় আল্লাহর স্মরণে শান্ত হয়। জেনে রাখো, আল্লাহর স্মরণেই হৃদয় শান্তি পায়।”
(সূরা রাদ: ২৮)
কুরআন তিলাওয়াত হৃদয়ের অন্ধকার দূর করে এবং মানুষকে আল্লাহর পথে ফিরিয়ে আনে।
২. তওবা ও ইস্তিগফার করা
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
يَا أَيُّهَا النَّاسُ تُوبُوا إِلَى اللَّهِ فَإِنِّي أَتُوبُ إِلَيْهِ فِي الْيَوْمِ مِائَةَ مَرَّةٍ
“হে মানুষ! তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা করো, কারণ আমি নিজেই প্রতিদিন একশতবার তওবা করি।”
(সহিহ মুসলিম: ২৭০২)
তওবা এবং ইস্তিগফার হৃদয়কে পরিষ্কার করে এবং আল্লাহর রহমত লাভের পথ প্রশস্ত করে।
৩. সৎকাজ ও দান করা
রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন:
صَدَقَةُ السِّرِّ تُطْفِئُ غَضَبَ الرَّبِّ
“গোপনে দান করা আল্লাহর ক্রোধকে নিবারণ করে।”
(সুনান তিরমিজি: ৬৬৪)
সদকা বা দান হৃদয়ের কঠোরতা দূর করে এবং আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করতে সাহায্য করে।
৪. সৎ সঙ্গ নির্বাচন
নবী করিম (সা.) বলেছেন:
الْمَرْءُ عَلَى دِينِ خَلِيلِهِ، فَلْيَنْظُرْ أَحَدُكُمْ مَنْ يُخَالِلُ
“মানুষ তার বন্ধুর দ্বীনের উপর চলে। তাই তোমরা লক্ষ্য করো, তোমার বন্ধু কে?”
(সুনান আবু দাউদ: ৪৮৩৩)
সৎ বন্ধুদের সঙ্গ হৃদয়ের পাথরত্ব দূর করে এবং আল্লাহর পথে চলতে সাহায্য করে।
৫. মৃত্যু ও পরকালের কথা স্মরণ করা
আল্লাহ বলেন:
كُلُّ نَفْسٍ ذَائِقَةُ الْمَوْتِ ۖ وَإِنَّمَا تُوَفَّوْنَ أُجُورَكُمْ يَوْمَ الْقِيَامَةِ
“প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ আস্বাদন করতে হবে এবং কিয়ামতের দিন তোমাদের পুরস্কার পূর্ণভাবে প্রদান করা হবে।”
(সূরা আলে ইমরান: ১৮৫)
মৃত্যুর স্মরণ হৃদয়কে আধ্যাত্মিকভাবে জাগ্রত করে এবং মানুষকে সৎকর্মে উদ্বুদ্ধ করে।
উপসংহার
হৃদয়কে জীবিত রাখতে হলে কুরআন তিলাওয়াত, আল্লাহর স্মরণ, পাপ থেকে তওবা, এবং সৎকাজের চর্চা করতে হবে। দুনিয়ার আসক্তি পরিহার করে পরকালকে অগ্রাধিকার দেওয়া জরুরি। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে বর্ণিত এই দিকনির্দেশনাগুলো মানলে হৃদয় আধ্যাত্মিকভাবে জীবিত হবে এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভ সম্ভব হবে।