মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ। কিন্তু সেখানেও আছে ব্লাসফেমি আইন। ধর্ম সম্পর্কে এমন কিছু বলা চলে না, যাতে সৃষ্টি হতে পারে রক্তক্ষরা সঙ্ঘাত। ইচ্ছা করলেই কেউ কোনো ধর্মের, বিশেষ করে খ্রিষ্টধর্মের বিপক্ষে কিছু বলতে বা লিখতে পারেন না, যাতে করে শান্তি ভঙ্গ হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ হলেও সব মার্কিন প্রেসিডেন্ট (বারাক হোসেন ওবামাসহ) শপথ নিয়েছেন বাইবেল ছুঁয়ে। ধর্মের একটি প্রভাব এ ক্ষেত্রে চলেছে কাজ করে। যদিও এটা মার্কিন সংবিধানসম্মত নয়। মার্কিন ডলারের ওপর এখনো লেখা থাকে ওহ এড়ফ বি ঞৎহংঃ…। বাংলাদেশে সমস্যার অন্ত নেই। জানি না ইসলামকে গালমন্দ দিয়ে আরো সমস্যার সৃষ্টি করা হচ্ছে কেন। মানুষকে ক্ষুব্ধ করে কী প্রমাণ করার চেষ্টা চলেছে, বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে একটি জঙ্গিবাদী মুসলিম দেশ? ব্লগার ব্যাপারটা আমি ঠিক বুঝি না। তবে ধর্মের বিপক্ষে আবোলতাবোল কথা বললে এখনো অনেক গণতান্ত্রিক দেশেই পড়তে হয় ব্লাসফেমি অর্থাৎ ধর্ম তথা ঈশ্বর নিন্দার অপরাধে। দাঁড়াতে হয় আদালতে বিচারের কাঠগড়ায়। মনে হচ্ছে, যথেষ্ট উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই বাংলাদেশে মুসলিম মানসকে ক্ষিপ্ত করার চেষ্টা হচ্ছে। আগে এ রকম কিছু ঘটার নজির নেই। ব্রিটিশ শাসনামলে স্বামী শ্রদ্ধানন্দ বলে এক ব্যক্তি বই লিখেছিলেন ‘রঙ্গিলা রসুল’ নামে। এজন্য মুসলমানেরা তাকে করেছিলেন খুন। মুসলমানেরা তাদের রসূলের নিন্দা সহ্য করতে পারেন না। কলকাতায় অবশ্য ইংরেজ আমলেই নির্মাণ হয়েছিল শ্রদ্ধানন্দ পার্ক, যা এখনো আছে। যে দু’জন ব্যক্তি স্বামী শ্রদ্ধানন্দকে খুন করেছিলেন, তারা ছিলেন উর্দুভাষী মুসলমান। কিন্তু বাংলাভাষী মুসলমানও খুশি হয়েছিলেন এই হত্যাকাণ্ডে। এর পর এ দেশে কেউ রঙ্গিলা রসূলের মতো বই লিখতে সাহসী হননি। প্রয়োজনও অনুভব করেননি।
এখন এ দেশের ব্লগাররা কী লিখছেন আমি তা জানি না। কিন্তু তারা যদি রসূলের কুৎসা করে কিছু লিখে থাকেন, তবে সেজন্য মুসলিম মনে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার উদ্ভব হওয়া স্বাভাবিক। কেন জেনে শুনে এরকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করার চেষ্টা চলেছে, সেটা নিয়ে ভাবার প্রয়োজন আছে। মনে হচ্ছে, এর পিছনে কাজ করে চলেছে বিশেষ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। আর সেটা হলো বিশ্বের কাছে প্রমাণ করা যে, বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে একটি মুসলিম জঙ্গিবাদী দেশ। এর মধ্যে কাজ করে চলেছে বাংলাদেশ বিরোধী চক্রান্ত। রণেশ মৈত্র একটি প্রবন্ধ লিখেছেন ‘উগ্রবাদীদের দৌরাত্ম্য আর কতকাল?’ নামে (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১ এপ্রিল ২০১৫)। এতে তিনি বলেছেন, এসব ঘটছে জামায়াতে ইসলামীর কারণে। তাই জামায়াতে ইসলামী দলকে বেআইনি ঘোষণা করা উচিত। রণেশ বাবু একজন প্রগতিশীল বাম ঘরানার বুদ্ধিজীবী হিসেবে খ্যাত। তার লেখা পড়ে মনে হচ্ছে, বাম বুদ্ধিজীবী মহল ষড়যন্ত্র করে চলেছে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে। আর সম্ভবত ইসলাম বিদ্বেষপ্রসূত লেখা ব্লগাররা লিখছেন এ কারণেই। অজয় রায়ের ছেলে অভিজিৎ নিহত হয়েছেন। ছেলের শোকে বাবা অনেক কিছুই বলতে পারেন। তিনিও বলছেন, তার ছেলেকে হত্যা করেছে জামায়াতে ইসলামীর লোকেরা। তিনি যদি খুব নিশ্চিত হন, তবে সেটা তিনি আদালতে উত্থাপন না করে পত্রিকায় উত্থাপন করে রাজনীতি করতে চাচ্ছেন বলেই মনে হয়। অজয় রায় এখন যথেষ্ট শান্তির কথা বলছেন। কিন্তু তিনি যে একজন শান্তিবাদী ছিলেন, এমন নয়। শোনা যায়, তিনি নাকি ছিলেন মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের সঙ্গে। যারা ১৯৮০ সালের ২৩ জুন বলেছিলেন, বাংলাদেশে করতে হবে আফগান স্টাইলে বিপ্লব। কিন্তু এখন তাদের মুখে শান্তির খই ফুটছে। কমিউনিস্টরা মানুষ খুন করলে সেটাকে বলা হয় বিপ্লব; কিন্তু তাদের প্রতিপক্ষরা তাদের খুন করলে বলা হয় সন্ত্রাসবাদী জঙ্গি। কিন্তু সেই জামানা এখন আর নেই। সারা বিশ্বে সর্বপ্রকার বাম আন্দোলনে নামছে এখন ধস। অজয় বাবুদের অবস্থা এখন আর কোনো দেশেই আগের মতো নেই। অবশ্য বাংলাদেশে তারা কিছুটা হইচই করতে পারছেন ভারতের মদদ আছে বলে। তবে ভারতে এখন কংগ্রেস সরকার আর নাই। মোদি সরকার তাদের কতটা মদদ জোগাবেন, তা বলা যাচ্ছে না।
ধর্ম পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রাজনীতিতে প্রভাব ফেলেছে, আর এখনো ফেলছে। ইউরোপের অনেক দেশেই এখনো আছে রাষ্ট্রধর্ম। যেমনÑ ইংল্যান্ডের রাষ্ট্রধর্ম হলো অ্যাংলিক্যান খ্রিষ্টধর্ম। ইংল্যান্ডের রাজা রানী হতে গেলে, হতে হয় অ্যাংলিকান গির্জাভুক্ত। ইংল্যান্ডের রাজা রানী হতে গেলে ক্যাথলিক খ্রিষ্টান হওয়া যায় না। যদিও অ্যাংলিকান গির্জার সাথে ক্যাথলিক গির্জার সাদৃশ্য আছে। ক্যাথলিক স্পেনের হাত থেকে স্বাধীন থাকার জন্যই বিশেষভাবে হয়েছিল অ্যাংলিক্যান গির্জার উদ্ভব। তবে তারা চায়নি ক্যাথলিত মতবাদ থেকে একেবারেই আলাদা হয়ে যেতে। যা চেয়েছে, তা হলো, ইংল্যান্ডের রাজার প্রতিপত্তি এবং পোপের সব ক্ষমতার অবসান। সুইডেন একটি খুবই উন্নত আধুনিকমনা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। কিন্তু সুইডেনেরও রাষ্ট্রধর্ম আছে। সুইডেনের রাজা রানীকে হতে হয় লুথেরান গির্জাভুক্ত। ধর্মভিত্তিক দল ইউরোপে এখনো আছে। ইউরোপের দেশে দেশে আছে ক্যাথলিক ভাবধারাভিত্তিক খ্রিষ্টীয় গণতান্ত্রিক দল। জার্মানির বর্তমান চ্যান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেল খ্রিষ্টীয় গণতান্ত্রিক দলভুক্ত। কিন্তু তাই বলে জার্মানি পরিণত হয়নি এক ধর্মনৈতিক রাষ্ট্রে। খ্রিষ্টীয় গণতন্ত্রীরা খ্রিষ্টীয় মানবতন্ত্রী ভাবধারা দিয়ে উদ্বুদ্ধ। কিন্তু এ দেশে প্রগতিশীলেরা বলছেন, সর্বপ্রকার ধর্মীয় আবেগভিত্তিক দলকেই বেআইনি করতে। যার কোনো যুক্তি পাওয়া যাচ্ছে না। জামায়াতে ইসলামী ইসলামের ভিত্তিতে রাজনীতি করতে চাচ্ছে। তারা চাচ্ছে না, দেশকে একটি এক দলের রাষ্ট্রে পরিণত করতে। যারা ইসলামপন্থী নন, এমন দলকে তারা বলছেন না বেআইনি করার কথা। কিন্তু এ দেশের বাম রাজনীতিকেরা বিশেষ করে এক কালের মস্কো বামেরা বলছেন, জামায়াতে ইসলামী দলকে করতে হবে বেআইনি। কিন্তু তাদের পক্ষে এ দেশের জনমত কতটা আছে, সেটা কেবল যাচাই হতে পারে ভোটের মাধ্যমে; অন্য কিছুর মাধ্যমে নয়। কিন্তু বামপন্থীরা মুক্তভোটে আস্থাশীল বলে মনে হচ্ছে না। তারা চাচ্ছেন আওয়ামী লীগের সাথে হাত মিলিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে। এ রকমই মনে হচ্ছে অনেকের কাছে। কেননা, এ দেশের এক কালের মস্কো বামেরা করেছিলেন বাকশাল সমর্থন। সেই ইতিহাস এত সহজে ভুলে যাওয়ার নয়। জামায়াতে ইসলামী মুসলিম মূল্যবোধনির্ভর করে রাজনীতি করতে চায়। কিন্তু তারা বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হোক এটা চায়নি। বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করেছেন প্রেসিডেন্ট এরশাদ, ১৯৮৮ সালের ৭ জুন অষ্টম সংশোধনী বিল পাসের মাধ্যমে। এতে জামায়াতে ইসলামীর কোনো সংশ্লিষ্টতা ছিল না। অবশ্য এরশাদ যা করেছেন, সেটাকে একটি নজিরবিহীন ঘটনা বলা যায় না। বাংলাদেশের আগেই মালয়েশিয়া সরকার মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে ঘোষণা করে। উল্লেখ্য, মালয়েশিয়ার জনসংখ্যার শতকরা দশভাগ হলো ভারত থেকে যাওয়া তালিম বংশোদ্ভূত হিন্দু। কিন্তু মালয়েশিয়াকে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করার জন্য বলছে না একটি মুসলিম মৌলবাদী রাষ্ট্র হয়ে পড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশকে একটি মুসলিম মৌলবাদী রাষ্ট্র হিসেবে প্রমাণের চেষ্টা হচ্ছে। এই চেষ্টার পেছনে বিশেষ ইন্ধন জুগিয়েছে ভারত। আর এ দেশের ভারত সমর্থিত এক কালের মস্কোপন্থী বাম ঐতিহ্যবাহীরা। যার জের এখনো চলেছে।
মুসলিম চিন্তায় বৈচিত্র্য ছিল এবং এখনো আছে। উমাইয়া খলিফাদের সময় একদল মুসলমান নিজেদের বলতেন মুরজায়ী। মুরজা শব্দের মানে স্থগিত রাখা। মুরজায়ী মুসলমানেরা বলতেন যে, কে খাঁটি মুসলমান আর কে তা নয়, সে বিচার তারা স্থগিত রাখতে চান। কেবল আল্লাহই বিচার করতে পারেন কে খাঁটি মুসলমান আর কে নন। এই বিচার হবে রোজহাশরের ময়দানে; তার আগে নয়। মানুষ এর বিচার করার অধিকারী নয়। মুরজায়ী মুসলমানেরা ধর্মের ব্যাপারে ছিলেন খুবই উদার। অর্থাৎ গোড়া থেকেই ইসলামে প্রবহমান থেকেছে গোঁড়ামির পাশাপাশি একটি উদারপন্থী ধারা। বাংলাদেশে গোড়া ইসলামপন্থী নেই, তা বলা যাবে না। তবে এখানে উদারপন্থী ধারাই হলো প্রবল। তা না হলে কোনো মুসলমান নারীর পক্ষে সম্ভব হতো না দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট
Sign in
Welcome! Log into your account
Forgot your password? Get help
Password recovery
Recover your password
A password will be e-mailed to you.