ইউনূস সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্তব্যের বিষয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছে ইউনূস সেন্টার। গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যে আমরা অত্যন্ত দু:খ প্রকাশ করছি। এ বিষয়ে পূর্বেও ড. ইউনূসের পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণে কোন প্রকার তথ্য বা ডকুমেন্ট উপস্থাপন করেননি।
বৃহস্পতিবার এ বিবৃতি পাঠানো হয়েছে। প্রতিবাদ লিপির প্রায় সবটুকুই জিনিউজর পাঠকের জন্য তুলে ধরা হলো:
বেশ কিছু পত্রিকায় নোবেল জয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মন্তব্য অসত্য বক্তব্য। যা ভুল পথে পরিচালিত হয়েছে বলে আমরা অত্যন্ত দু:খ প্রকাশ করছি। আমরা আশা করি প্রধানমন্ত্রী প্রকৃত পক্ষে এ মন্তব্যগুলো করেননি। কিন্তু পত্রিকাগুলো প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য বলে ছাপিয়েছে। তাই প্রধানমন্ত্রীর প্রতিটি কথার ওপর সাড়া দিয়ে আমরা ড. ইউনূসের বিষয়ে গণমাধ্যমে তুলে ধরছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমি(শেখ হাসিনা) ও আমার সরকারের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণেই পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের বিনিয়োগ বাতিল করার জন্য হিলারি ক্লিনটনকে প্রভাবিত করেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি(ইউনূস) জাতির জন্য ক্ষতিকারক।
ইউনূস সেন্টার : এ ধরনের বক্তব্যের বিষয়ে ইতোপূর্বেই ড. ইউনূস বিবৃতি দিয়েছেন। পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের বিনিয়োগ বাতিল করার জন্য হিলারি ক্লিনটনকে প্রভাবিত করার কোন প্রশ্নই ওঠেনা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের। ড. ইউনূস বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থের বিরুদ্ধে কখনই কোন কাজ করেন নি। এটি অত্যন্ত দু:খজনক ব্যাপার যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণে কোন প্রকার ডকুমেন্ট বা তথ্য উপস্থাপন করেননি।
ড. ইউনূস বাংলাদেশ ও দেশের মানুষের জন্য কাজ করে এমন প্রতিষ্ঠান তৈরি করতে তিনি তার জীবন উৎসর্গ করে দিয়েছেন। দেশ ও দেশের বাইরে তার কর্ম এবং অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ নোবেল পুরস্কারসহ বিভিন্ন পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তিনি সব সময়ই বাংলাদেশ ও দেশের সাফল্যকে সবার সামনে তুলে ধরেছেন। ড. ইউনূস সব সময়ই বাংলাদেশের দারিদ্র্য দূরিকরণ ও উন্নয়নের জন্য সহয়তা করেছেন। তাকে ক্ষতিকারক বলা দূর্ভাগ্যজনক।
একনেকের বৈঠকে গরিব মানুষের উন্নয়নে গ্রামীণ ফিশারিজ অ্যান্ড লইভস্টক ফাউন্ডেশন ব্যর্থ হয়েছে এমন আলোচনার সময়ই প্রধানমন্ত্রী ড.ইউনূস সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন বলে পত্রিকাগুলো সংবাদ প্রকাশ করেছে।
ইউনূস সেন্টার : এ বিষয়ে আমাদের বক্তব্য হল, মৎস্য উন্নয়নে ১৯৮৬ সালে সরকারের কাছ থেকে ২৫ বছরের জন্য পুকুর লিজ নেয় গ্রামীণ ফিশারিজ। চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ায় ২০১০ সালে তা পুনরায় সরকারের কাছে ফিরিয়ে দেয়া হয়।
এই সময়ে গ্রামীণ ফিশারিজ সরকারের পরিত্যাক্ত পুকুর ও পানি উন্নয়ন করে ৩৩৯ টি পুকুর থেকে ৬১৫টি পুকুরে মাছ চাষের জন্য উন্নীত করা হয়। মাছ উৎপাদন ৪৬টন থেকে ২০ হাজার ৪০০ টনে উন্নীত করা হয়। মাছ বিক্রির পরিমাণ ১২ লাখ ৮৭ হাজার টাকা থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৭০ কোটি টাকার বেশি হয়েছে। এটি সবচেয়ে সফল ও লাভজনক খাতে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু ২০১১ সালে সরকারের নিকট পুনরায় ফিরিয়ে দেয়ায় এই খাতের আয় অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, গ্রামীণ ফোন ও গ্রামীণ ব্যাংক একটি যৌথ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। ড. ইউনূস গ্রামীণ ফোনের শেয়ার বিক্রি করেছেন।
ইউনূস সেন্টার : হ্যাঁ, গ্রামীণ ফোন একটি যৌথ মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। নরওয়ের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান টেলিনর ও বাংলাদেশের গ্রামীণ টেলিকম এবং পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ায় শেয়ার হোল্ডাররা প্রতিষ্ঠানটির মালিক। এর মধ্যে গ্রামীণ টেলিকম বাংলাদেশের জয়েন্ট স্টক কোম্পানি আইনে রেজিস্ট্রিকৃত একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান।
ড. ইউনূস বর্তমানে ও অতীতে কখনই গ্রামীণ ফোনের শেয়ার ধারন করেননি। এজন্য শেয়ার বিক্রি বা ক্রয়ের কোন প্রশ্নই ওঠেনা। গ্রামীণ ব্যাংক কোন সময়ই গ্রামীণ ফোনের শেয়ার ধারন করেনি। তাই গ্রামীণ ব্যাংকের গ্রামীণ ফোনের শেয়ার বিক্রি বা ক্রয়ের কোন প্রশ্নই ওঠেনা। গ্রামীণ টেলিকম গ্রামীণ ফোনের অন্যান্য অংশীদারদের মতই সাধারণ জনগণের মাঝে শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় করে থাকে।
গ্রামীণ ফোন থেকে গ্রামীণ টেলিকম যে লভ্যাংশ পায় তা গ্রামীণ জনপদের মানুষের কল্যাণ ও উন্নয়ন মূলক প্রকল্পে ব্যয় করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, মইক্রোক্রেডিটের ফাঁদে পড়ে গরিব মানুষ সংকটে পড়েছে। এটি(গ্রামীণ ব্যাংক) সবচেয়ে বেশি সুদ নেয়। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নিয়েই এটি পরিচালিত হয়।
কিভাবে গরিব মানুষ এই ফাঁদে আটকা পড়েছে গ্রামীণ ব্যাংকের ৫৪টি সহযোগী কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানই তার প্রমাণ।
ইউনূস সেন্টার : গ্রামীণ ব্যাংক তার প্রোগ্রামগুলো সমগ্র বাংলাদেশে পরিচালনা করে। এ মডেলটি বিদেশেও সমাদৃত হয়ে আসছে। ব্যাংকগুলো গরিব মানুষদের অর্থায়ন করে না। বাংলাদেশে পরিচালিত সরকারি ও বেসরকারি সকল মাইক্রো ক্রেডিট প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে গ্রামীণ ব্যাংক সবচেয়ে কম সুদ নেয়। মাইক্রো ক্রেডিট ফাঁদ গ্রামীণ ব্যাংকে নেই।
গ্রামীণ ব্যাংকের ৭৫ শতাংশ মালিকানাই ঋণ গ্রহীতা সদস্যদের বোর্ডের অধিকাংশ সদস্যই হচ্ছেন তারা।
একটি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য অনুযায়ী এক মহিলাকে প্রধানমন্ত্রী চেনেন যিনি ৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ১৬ হাজার টাকা পরিশোধ করেছেন বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
এর উত্তরে ইউনূস সেন্টার বলছে, এটা গ্রামীণ ব্যাংকে সম্ভব নয়। কারণ কোন অবস্থাতেই মূল ঋণের চেয়ে বেশি সুদ অনুমোদন করে না গ্রামীণ ব্যাংক।
কোন ঋণ গ্রহীতার মৃত্যুর পরপরই তার সকল ঋণ রাইট অফ(অবলোপন) হয়ে যায়। গ্রামীণ ব্যাংক পেনশন ফান্ড, সন্তানদের জন্য শিক্ষা ঋণ এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময়ে সহায়তা দেয়। অধিকন্তু ২০০৬ সাল থেকে শেয়ার হোল্ডাররা প্রতি বছর লভ্যাংশ পায় গ্রামীণ ব্যাংকের পক্ষ থেকে।
৫৪টি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী যা বলেছেন, সে বিষয়ে আমাদের(ইউনূস সেন্টার) বক্তব্য হল, সবগুলো প্রতিষ্ঠানই স্বাধীন এবং নিজেদের অর্থে পরিচালিত। এ প্রতিষ্ঠানগুলোতে গ্রামীণ ব্যাংকের কোন বিনিয়োগ নেই। তাই এগুলো গ্রামীণ ব্যাংকের কোম্পানি না। এই কোম্পানিগুলো মাইক্রো ক্রেডিট পরিচালনা করে না।
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য দেশের মানুষ এবং ড. ইউনূসের ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে। ড. ইউনূস সম্পর্কে এরকম বক্তব্য দেশ ও বিদেশে নেতি বাচক প্রভাব বিস্তার করছে।
আমরা পূর্বেও এ সকল বিষয়ের বিস্তারিত জবাব দিয়েছি। গণমাধ্যমও আমাদের এ বিষয়গুলো বিস্তারিত প্রচার করেছে। শুধু রেকর্ড রাখার জন্য আবারও সকল বিষয়ের উত্তর দিলাম।
প্রসঙ্গত, সম্প্রতি একনেকের এক বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন পদ্মা সেতুতে বিশ্ব ব্যাংকের বিনিয়োগ না করার জন্য হিলারি ক্লিনটনকে প্ররোচিত করেছেন নোবেল জয়ী প্রফেসর ড. ইউনূস বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। এর বাইরেও ইউনূস সম্পর্কে বেশ কিছু বক্তব্য দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর বিপরীতেই ইউনূস সেন্টার প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়ে এ বিবৃতি দিয়েছে।