প্রভাবশালী দুই মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া ও কামরুল ইসলামের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠায় ভাবমূর্তি ‘সংকটে’ পড়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। এর মধ্যে সরকারের সাবেক মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী জামিনে মুক্ত হওয়ায় অনেকটা যেন ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা’ পড়েছে।
এ সব কারণে সরকারের দুই বছরের মাথায় আওয়ামী লীগ ‘বেকায়দা’ অবস্থায় পড়তে পারে। ইতোমধ্যে ‘বিতর্কিত’ এ সব মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যের পদ বাতিলের দাবি তুলেছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজ।
মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী। এ ছাড়া তিনি মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও।
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি দুর্নীতি মামলায় গত ১৪ জুন মায়াকে খালাস করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করে নতুন করে আপিল শুনানির আদেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগ।
এই আদেশের পর মায়ার মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য পদে থাকা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
২০০৭ সালের ১৩ জুন সম্পদের তথ্য গোপন ও অবৈধভাবে ২৯ লাখ টাকার সম্পদের মালিক হওয়ার অভিযোগে মায়ার বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।
২০০৮ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বিশেষ জজ আদালত আওয়ামী লীগ এই নেতাকে ১৩ বছরের কারাদণ্ড দেন। একইসঙ্গে তাকে পাঁচ কোটি টাকা জরিমানাও করা হয়।
মায়া এই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে যান। ২০১০ সালের ২৭ অক্টোবর হাইকোর্ট বেঞ্চ তাকে খালাস দেয়, যা বাতিল হয়ে যায় আপিল বিভাগের আদেশে।
এর আগে নারায়ণগঞ্জের ৭ খুনের সঙ্গে মেয়ের জামাই জড়িত থাকার অভিযোগে ‘বেকায়দায়’ পড়েন মায়া।
কামরুল ইসলাম সরকারের খাদ্যমন্ত্রী। তিনিও মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। এর আগে আওয়ামী লীগ সরকারের তিনি আইন প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। সরকারের প্রভাবশালীর এই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ‘পচা গম’ আমদানির অভিযোগ উঠেছে।
সম্প্রতি খাদ্য মন্ত্রণালয় ব্রাজিল থেকে ২ লাখ টন গম আমদানি করে। যা ‘পচা’ বলে গণমাধ্যমে খবর বের হয়েছে।
এই দুই মন্ত্রীর ‘কেলেঙ্কারি’তে ‘বিব্রতকর’ অবস্থায় পড়েছে সরকার। বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি ইতোমধ্যে খাদ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছে। সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা মায়ার মন্ত্রিত্ব ও সংসদ সদস্য পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ারও দাবি তুলেছেন।
নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মঙ্গলবার এক প্রেস ব্রিফিংয়ে দলের মুখপাত্র আসাদুজ্জামান রিপন এই গম কেলেঙ্কারির হোতা বলে চিহ্নিত করেন খাদ্যমন্ত্রীকে।
তিনি মন্ত্রিসভা থেকে খাদ্যমন্ত্রীকে বাদ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে বলেন, ‘এতে সরকারের ভাবমূর্তি কমবে না, বরং বাড়বে।’
এ ব্যাপারে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সরকারের বিতর্কিত মন্ত্রীদের পদত্যাগ করা উচিৎ। একজন মন্ত্রী সরকারের থাকলে তার বিরুদ্ধে তদন্তে প্রভাব বিস্তারের অভিযোগ উঠতেই পারে। এতে সরকারের ভাবমূর্তিও নষ্ট হচ্ছে।’
সরকার ও বিরোধ রাজনৈতিক অঙ্গন যখন এই দুই মন্ত্রীর ‘কেলেঙ্কারি’ নিয়ে সোরগোল, তখনই সরকারের সাবেক মন্ত্রী আব্দুল লতিফ সিদ্দিকী জামিনে মুক্ত হয়েছেন।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে একাধিক মামলায় ৮ মাস সাজা ভোগ করার পর সোমবার জামিনে বের হয়েছেন তিনি।
২০১৪ সালের ২৩ নভেম্বর রাতে ভারত হয়ে দেশে ফেরেন লতিফ সিদ্দিকী। পরদিন তিনি আত্মসমর্পণ করলে আদালত তাকে কারাগারে পাঠায়।
গত বছর ২৯ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কে টাঙ্গাইল সমিতির এক অনুষ্ঠানে হজ ও তবলীগ জামায়াত নিয়ে মন্তব্য করে সমালোচনার মুখে পড়েন তৎকালীন টেলিযোগাযোগমন্ত্রী লতিফ।
এ ঘটনা পর ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে দেশের বিভিন্ন স্থানে তার বিরুদ্ধে প্রায় দুই ডজন মামলা হয়। আওয়ামী লীগ থেকেও বহিষ্কার করা হয় তাকে। যদিও তিনি এখনও আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য রয়েছেন।
লতিফ সিদ্দিকীকে গ্রেফতারের দাবিতে শুক্রবার বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দিয়েছে হেফাজতে ইসলাম। ওইদিন জাতীয় বায়তুল মোকাররম মসজিদে সমাবেশ হওয়ার কথা রয়েছে।
এ ব্যাপারে সরকারপন্থী হিসেবে পরিচিত ইসলামী ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক আল্লামা ফরিদ উদ্দিন মাসউদ বলেন, ‘লতিফ সিদ্দিকীর জামিনে সরকারের ভাবমূর্তি চরমভাবে নষ্ট হবে। সরকার চাইলে ও ইচ্ছা করলে তাতে আটকে রাখতে পারত।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের সন্দেহ এ জন্যই বাড়ছে, লতিফ সিদ্দিকীর সংসদ সদস্য পদ এখনও বহাল রয়েছে, তার কোনো শাস্তি হয়নি। এতে সাধারণ মুসলমানরা বিক্ষুব্ধ হবেন, কেউ প্রকাশ করবে কেউ করবে না। তবে সুযোগ পেলে কিন্তু এর প্রকাশ হবে ভয়ানক।’
সরকারের দুই বছরের মাথায় এমন ‘বিতর্কিত’ নেতাদের নিয়ে ভাবমূর্তি ‘সংকটে’ পড়ছে আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানিয়েছেন, শিগগির সরকার ও দলে শুদ্ধি অভিযান শুরু হবে। এ ছাড়া মহানগর আওয়ামী লীগের সামনের কমিটিতেও ‘বিতর্কিত’রা বাদ পড়বেন।
এ ছাড়া রেলে বিভিন্ন পদে নিয়োগে ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগে মন্ত্রিত্ব হারানো আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ফের দলে সক্রিয়তা নিয়েও নেতাদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ঘুষ কেলেঙ্কারি প্রকাশের পর ‘কালো বিড়াল’ খেতাবও পেতে হয়েছিল তাকে।
সপ্তাহে দুই দিন সুরঞ্জিত বঙ্গবন্ধু একাডেমী ও নৌকা সমর্থক গোষ্ঠীর ব্যানারে আওয়ামী লীগের মুখপাত্রের ন্যায় কথা বলেন। তার নানান বক্তব্যে দলের মধ্যেই অসন্তোষ বিরাজ করছে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘যাদের বিরুদ্ধে দলের নীতি ও আদর্শের পরিপন্থী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ উঠেছে, তাদের তো দলের প্রাথমিক সদস্য পদ থেকেও অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। উনাদের সঙ্গে তো দলের কোনো সম্পর্ক নেই। মামলার বিষয় আদালতের এখতিয়ার। এ নিয়ে আমরা কিছু বলতে পারব না।’
‘বিতর্কিত’ মন্ত্রীদের বিষয়ে আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, ‘মায়া সাহেব একজন বীরবিক্রম। মহান মুক্তিযুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ করে উঠে আসা একজন সফল নেতা তিনি। তার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র করছে কিনা তাও এখন খতিয়ে দেখতে হবে।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘বিতর্কিত মন্ত্রী মায়া-কামরুল ও নেতারা দলে এবং সরকারে সক্রিয় থাকায় সরকার, আওয়ামী লীগ ও দেশের ভাবমূর্তি চরমভাবে নষ্ট হচ্ছে। এই বিতর্কিতদের কারণে সংবিধান নিয়েও বিতর্কের সৃষ্টি হচ্ছে। তাদের মন্ত্রিত্ব থাকা দেশে ও জনগণের জন্য দুর্ভাগ্যজনক।’
ড. বদিউল আলম আরও বলেন, ‘আমরা শুনছি, সরকার শুদ্ধি অভিযান চালাবে। কিন্তু কবে? এই দুর্নীতি এখন পুলিশে সংক্রমিত হচ্ছে। এমন ঘটনা কখন ঘটে! যখন দেশে সরকার কার্যকর থাকে না। এটা তো দেশের জন্য অশনি সংকেত।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতা বলেন, ‘কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হলে সাথে সাথে তো আর ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। একটু অপেক্ষা করেন। এদের সবার বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। মহানগর কমিটিতেই তা দেখতে পাবেন।’সূত্র: দ্য রিপোর্ট