সমান সুযোগ ছাড়াই নির্বাচন

আগামীকাল অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচন। কিন্তু নির্বাচন কমিশন (ইসি) সবার জন্য সমান সুযোগ বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে পারেনি; সরকার সমর্থক প্রার্থী ছাড়া এ অভিযোগ এখন সব মহলের। তাই নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই ছড়িয়ে পড়ছে ভীতি আর আতঙ্ক। এত দিন পর্যন্ত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী বিরোধী প্রার্থী ও কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও তা এখন ছড়িয়ে পড়ছে ভোটার থেকে সাধারণ নগরবাসীর মধ্যে। বিশেষ করে নির্বাচনী মাঠে সেনা মোতায়েন না রেখে তাদের ব্যারাকে রাখার সর্বশেষ যে সিদ্ধান্ত ইসি নিয়েছে তাতে উদ্বেগের মাত্রা বেড়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে পরিচালিত একটি জরিপে দেখা গেছে ৮৬ শতাংশের অধিক ভোটার মনে করেন নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি হয়নি। গত ১৭ থেকে ২১ এপ্রিল পর্যন্ত ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ নির্বাচনী এলাকার ৪৬১ জন ভোটারের ওপর পরিচালিত হয় এ জরিপ।

সিটি নির্বাচনের পরিবেশ এখন এতই ভীতিজনক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে যে, বিএনপি এখন ভোটকেন্দ্রের জন্য পোলিং এজেন্ট পাচ্ছে না। যারা পোলিং এজেন্ট ও নির্বাচনী দায়িত্ব পালনের জন্য নাম জমা দিয়েছিলেন তাদের অনেকে নাম প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন ভয়ে।

এত দিন পর্যন্ত বিরোধী প্রার্থী এবং নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেয়া কর্মীদের ওপর হামলা ভয়ভীতি প্রদর্শন ও হুমকি-ধমকি চলছে। কিন্তু এখন অনেক এলাকায় ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সাবধান করে দেয়া হচ্ছে ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার ব্যাপারে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের আইডি কার্ড জব্দ করার খবর বেরিয়েছে সরকার সমর্থক প্রার্থীদের পক্ষের লোকজনের বিরুদ্ধে।

রোববার মধ্যরাত থেকে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে নির্বাচনী প্রচারণা। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিএনপি ও জামায়াত সমর্থিত বেশির ভাগ কাউন্সিলর প্রার্থী মাঠেই নামতে পারেননি। প্রচারণার মাঠ থেকে এ পর্যন্ত সাতজন কাউন্সিলর প্রার্থীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতার করা হয়েছে শত শত কর্মী-সমর্থককে। গুমেরও শিকার হয়েছেন কয়েকজন কর্মী।

ঢাকা উত্তর ও দণি সিটি করপোরেশন মিলিয়ে ৯৩টি সাধারণ ওয়ার্ডের বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিল প্রার্থী ৬১ জনের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে। কারো কারো বিরুদ্ধে আট-দশটি করে মামলা রয়েছে এবং এর প্রায় সবই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে দায়ের করা। কেউ কেউ জামিন পেলেও তারা ভয়ে নির্বাচনী প্রচারণার মাঠে নামতে পারছেন না। মামলা, গ্রেফতার ও হুমকির কারণে অনেক প্রার্থী এলাকা ছাড়া, অনেকে আত্মগোপনে রয়েছেন।
গতকাল পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের পক্ষ থেকে ইসিতে শতাধিক আবেদন জমা পড়েছে। প্রার্থী ও কর্মী-সমর্থকদের হামলা ও প্রাণনাশের হুমকি, বাড়ি, অফিস ও স্থাপনায় হামলা, ভাঙচুর, মারধরের ঘটনা, প্রার্থী ও কর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি, প্রচারণা চালাতে না দেয়াসহ গ্রেফতার বিষয়ে শতাধিক অভিযোগ করা হয়েছে প্রার্থীদের পক্ষ থেকে। কিন্তু এসবের কোনো প্রতিকার হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন প্রার্থীরা।

১৮ মার্চ সিটি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকেই ইসির বিরুদ্ধে সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরির ব্যর্থতা ও পক্ষপাতমূলক আচরণসহ বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ উঠেছে। সরকারি দল সমর্থিত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে একের পর এক আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠলেও সে ক্ষেত্রে ইসির বিরুদ্ধে নির্বিকার ভূমিকা পালনের অভিযোগ রয়েছে।
গত শনিবার রাত ৩টার দিকে কারওয়ান বাজার এলাকায় হামলার শিকার হন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন মেয়রপ্রার্থী মাহী বি চৌধুরী। এ সময় তার স্ত্রী ও গাড়িচালকও আহত হন।

একই দিন রাজধানীতে বিএনপিসমর্থিত এক কাউন্সিলর প্রার্থীর মিছিলে গুলি, জামায়াতের এক প্রার্থীর মিছিলে ককটেল হামলা এবং সরকার সমর্থক এক বিদ্রোহী প্রার্থীর ওপর হামলায় আঙুল কাটার ঘটনা ঘটেছে।

বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া নির্বাচনী প্রচারণায় নেমে চার দফা আক্রমণের শিকার হয়েছেন। বেগম খালেদা জিয়ার ওপর আক্রমণকারীদের নাম-পরিচয় ও ছবি প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। এমনকি এরা ছাত্রলীগ-যুবলীগের কোনো পদে রয়েছে তাও প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু এসব আক্রমণকারী বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এ ঘটনার পর নির্বাচন নিয়ে ভীতি ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। বিএনপি প্রার্থীদের পক্ষে পোলিং এজেন্ট প্রত্যাহার করে নেয়া একজন কর্মী জানান যেখানে সরাসরি বিএনপি চেয়ারপারসনের ওপর হামলা হয় সেখানে ভোটকেন্দ্রের মধ্যে তাদের নিরাপত্তা কে দেবে। তাই ভীত হয়ে তিনি নির্বাচনী দায়িত্ব পালন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন।
নির্বাচনী প্রচারণার শুরু থেকে প্রায় প্রতিদিন বিএনপি-জামায়াতের, কোনো না কোনো প্রার্থী ও তাদের অনেক কর্মী-সমর্থকের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটছে সরকার সমর্থক প্রার্থীর পক্ষের লোকজন কর্তৃক।

সরকারদলীয় প্রার্থীদের একের পর এক আচরণবিধি লঙ্ঘন আর বিরোধী প্রার্থীদের প্রচারণা চালাতে না দেয়া, গ্রেফতার, মামলা ভয়ভীতি, বাড়ি তল্লাশি প্রতি পদে পদে শুরু থেকে ইসির বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত নির্বাচন ঘিরে যেসব ঘটনা ঘটেছে তাতে নির্বাচন কমিশন সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে পারেনিÑ এ অভিযোগ এখন সর্বত্র। নির্বাচন কমিশন পক্ষপাতমূলক আচরণ করছে বলে অভিযোগ বিরোধী প্রার্থীদের। নির্বাচনী প্রচারে বিরোধী প্রার্থী এবং তাদের কর্মীদের ওপর সরকারদলীয় লোকজন কর্তৃক হামলার ঘটনা ঘটলেও ইসি কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বর্তমানে নির্বাচন কমিশনের অধীন। শুধু নির্বাচন কমিশন নয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধেও বিএনপি-জামায়াত প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ভূমিকা পালনের অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা গেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সামনে বিরোধীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরপেক্ষ নয়। তারা নিরপেক্ষ আচরণ করছে না ব্যাপক দলীয়করণের কারণে। এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনকে কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না।

সব মিলিয়ে নির্বাচন আদৌ সুষ্ঠু হয় কি না তা নিয়েই সংশয় ছড়িয়ে পড়েছে বিরোধী মহলে।
গতকাল দুপুরের পর নির্বাচন নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া অভিযোগ করেছেন, সেনা মোতায়েনকে ভোট ডাকাতির ক্ষেত্রে বাধা মনে করছে সরকার। তারা সশস্ত্র বাহিনীর ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। তাই এ ক্ষেত্রে সরকারকে সহায়তার জন্য কাজ করছে নির্বাচন কমিশন। সরকারের ভোট ডাকাতির পরিকল্পনার দোসর হয়ে ইসি গুপ্ত কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে।

সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ঢাকা দক্ষিণের মেয়রপ্রার্থী মির্জা আব্বাসের স্ত্রী আফরোজা আব্বাস, উত্তরের মেয়রপ্রার্থী তাবিথ আউয়ালসহ অনেক প্রার্থী। রোববার নির্বাচনী প্রচারণার সময় আফরোজা আব্বাস অভিযোগ করেছেন সরকার ৫ জানুয়ারির মতো আরেকটি নির্বাচন করতে চায়। তাবিথ আউয়াল অভিযোগ করে বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি না তা নিয়ে সংশয় আছে। সেনা মোতায়েন নিয়ে ইসির সর্বশেষ তালবাহানা এ সংশয় আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। ঢাকা দক্ষিণের মেয়রপ্রার্থী আবদুল্লাহ আল কাফী অভিযোগ করেছেন, নির্বাচনে হুমকি-ধমকি আর অর্থের ছড়াছড়ি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ নির্বাচন কমিশন।সৌজন্যে: নয়াদিগন্ত

Exit mobile version