বিএনপির অনেক সিনিয়র নেতাকে আর বিশ্বাস করতে পারছেন না দলের হাইকমান্ড। সন্দেহ আর অবিশ্বাসের বাতাবরণ তৈরি হয়েছে দলটিতে। অনেক নেতাই নিজেদের ঘনিষ্ঠজনদের কাছে নাম ধরে ধরে বলছেন, ‘অমুকে সরকারের এজেন্ট, তমুকে ওই সংস্থার এজেন্ট’। এসব কথা কানাকানি হয়ে শেষ পর্যন্ত পৌঁছে যাচ্ছে হাইকমান্ডের কানে। অত:পর তাদের কর্মকাণ্ডেও প্রমাণিত হচ্ছে তারা মুখে যত বড় কথাই বলেন, তা বেগম খালেদা জিয়াকে খুশি করার জন্যই। যা বলেন তা পদ-পদবি টিকিয়ে রাখতে, আখের গোছাতে, দলে প্রমোশন পেতে। বেগম খালেদা জিয়ার সামনে নেতাদের আদ্যপান্ত এখন খোলা বইয়ের মতো। তিনি সবই জানছেন। তাই তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না অনেক নেতাকে। যারা এক সময় তার অন্যতম পরামর্শক ছিলেন তাদের পরামর্শকেও তিনি ’সন্দেহ’ করছেন। তাই দলের নেতাদের বাদ দিয়ে কোন কোন ক্ষেত্রে তিনি শিক্ষাবিদ-পেশাজীবীদের ডেকে পরামর্শ নিচ্ছেন। কার্যত: দলের কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আর নেতাদের জানতে দেয়া হচ্ছে না। দলের কোন কর্মপন্থা আগাম জানতে পারছেন না সিনিয়র নেতারা। গুরুত্বপূর্ণ কোন নীতিনির্ধারণী বিষয় নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন হলেও বেগম খালেদা জিয়া তা করছেন কয়েকজন বিশ্বস্ত নেতার সঙ্গে। তবে সেখানেও সতর্ক থাকছেন তিনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির ’গুরুত্বপূর্ণ’ একজন নেতা ইত্তেফাককে বলেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে বৈঠকের আগের রাতেও জানানো হয়নি, বেগম জিয়ার সাথে কে কে যাবেন হোটেল সোনারগাঁওয়ে। প্রথমে তালিকা করা হয় ৮ নেতার। পরে তাদের মধ্যে ৪ জনকে বাদ দিয়ে আবারো নতুন তালিকা করা হয়। সেটাও শেষ পর্যন্ত টেকেনি। সেখান থেকে ১ জনকে বাদ দেয়া হয়। তালিকা আবার হালনাগাদ হয়। তালিকায় একজন সিনিয়র নেতার নাম দেখে বেগম জিয়া বলেন, ‘উনিতো সরকারের লোক।’ পরে তাকে ছেটে ফেলা হয় তালিকা থেকে।
দলের চেয়ারপার্সনের ঘনিষ্ঠ একজন নেতা ইত্তেফাককে বলেন, নেতাদের অবিশ্বাস করার কারণ এবং প্রেক্ষাপট একদিনে তৈরি হয়নি। ঘটনা পরম্পরায় হয়েছে। বেগম জিয়া সরল মানুষ। তবে যাকে একবার সন্দেহ করেন তাকে সবসময় সন্দেহের নজরেই দেখেন। ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’র আন্দোলনে নেতাদের দ্বিমুখি চরিত্র হাইকমান্ডের সামনে প্রথম উন্মোচিত হয়। তারপর গত ৫ জানুয়ারি থেকে টানা তিন মাসের আন্দোলনে গুলশান অফিসে বসে তিনি ‘খোলাচোখে’ দেখেছেন। বেগম জিয়াকে যে সব নেতারা তখন আশ্বস্ত করেছিলেন যে তারা আন্দোলনের পুরোভাগে থাকবেন, পরে তাদের ফোন করেও আর হদিস পাননি তিনি। ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’র পরামর্শক নেতারাই শেষ পর্যন্ত আত্মগোপনে চলে যান বেগম জিয়াকে একা ফেলে। যারা বলেছিলেন, ঢাকাকে অচল করে দিবেন তাদের মোবাইল বন্ধ ছিল। একটা মিছিলও নামেনি রাজপথে। খালেদা জিয়া বাসা থেকে বের হতে পারেননি। তার কারণ হিসাবে পরে চিহ্নিত করা হয় যে দলের কথিত ’এজেন্ট’রাই সরকারের কাছে বেগম জিয়ার পরিকল্পনা ফাঁস করে দিয়েছে। ফলে তিনি একে একে বিশ্বাস হারান অনেক নেতার ওপর।
আলাপকালে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক নেতা বলেন, আমাদের দলের হাইকমান্ড থেকে শুরু করে মাঠ নেতাদের বদ্ধমূল ধারণা দলের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম থেকে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনে সরকারের ’এজেন্ট’ রয়েছে। দলের চেযারপার্সনের আশপাশেও তাদের কেউ কেউ আছেন। তারা রুদ্ধদ্বার বৈঠক চলাকালেও মোবাইল অন করে রেখে সরাসরি শোনান সরকারি গোয়েন্দা এবং সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাকে। এমন প্রমাণও আছে। বেগম খালেদা জিয়া বিষয়টি প্রথমে বিশ্বাস করেননি। পরে তিনি ধরতে পেরে স্থায়ী কমিটির সকল সদস্যের মোবাইল জব্দ করেন বৈঠকের আগে।
স্থায়ী কমিটির ঐ নেতা আরও বলেন, আমরা বৈঠকে বসে দলের কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা সরকারের কাছে পৌঁছে যাওয়া নিয়ে হাইকমান্ডের উদ্বেগ দেখেছি। গত ৩ জানুয়ারি চেয়ারপার্সনের পরিকল্পনা ছিল কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে গিয়ে অবস্থান নিবেন। সেখান থেকেই সরকার বিরোধী আন্দোলন পরিচালনা করবেন। এই সিদ্ধান্ত জানতেন মাত্র কয়েকজন নেতা। কিন্তু এই সিদ্ধান্তও ফাঁস হয়ে যায়। বেগম জিয়া যখন রাতে নয়াপল্টনের উদ্দেশে গুলশান অফিস থেকে বের হতে যান তখন পুলিশ তাকে আটকে দেয়। এরপর থেকে দলের কোন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আর নেতাদের জানতে দেয়া হচ্ছে না। বেগম জিয়া তার ব্যক্তিগত স্টাফদেরও অনেক বিষয় জানতে দিচ্ছেন না। তিনি কোন কর্মসূচির সিদ্ধান্ত নিলে তা সরাসরি গণমাধ্যমে পাঠাচ্ছেন দফতরের মাধ্যমে। কোন কোন সময় সরাসরি মাঠ নেতাদের সঙ্গে কথা বলছেন।
দলের একজন দায়িত্বশীল নেতার সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, গত ডিসেম্বর মাসে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় কারা কারা বিএনপির মধ্যে থেকে সরকারের ‘এজেন্ট’-তাদের নাম বলেছিলেন বেগম জিয়ার কাছে। সে সময় গয়েশ্বর খালেদা জিয়াকে বলেন-‘আমাদের অনেক নেতা আছেন যারা বিগত সময় পদ-পদবী পেয়ে অনেক অর্থ কামিয়েছেন। কিন্তু এখন আন্দোলনের ডাক আসলে ময়দানে খুঁজে পাওয়া যায় না। নেতাকর্মীদের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নেই। এই সব নেতারা দলের গোপন সব কিছু সরকারের কাছে ফাঁস করে দেন।’
দলের একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এই অবিশ্বাস তৈরির পেছনে অন্যতম কারণ, নেতারা নিজেদের রক্ষা করা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। নিজেরা নানা কৌশলে চলেন। মামলার জাল, গ্রেফতার ভীতি, সম্পদ রক্ষা করাটাই তাদের কাছে মুখ্য। তারা বলেছেন, গত দুই টার্মে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন এদের অনেকেই নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন এবং অতিমাত্রায় বিলাসী জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। এছাড়া ফুলেফেঁপে ওঠা অনেকেই এখন দল রক্ষার চেয়ে নিজের অঢেল সম্পদ রক্ষায় বেশি চিন্তিত। ফলে বেগম জিয়া কি ভাবলেন তা নিয়ে তারা ততটা চিন্তিত নন।
বিএনপির প্রথম সারির একজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আমরা (নেতারা) এখন এতটাই আস্থাহীনতায় ভুগছি যে রাজপথে আন্দোলন করতে গিয়ে কেউ গ্রেপ্তার হলে তাকেও সন্দেহের চোখে দেখছি। আরাম-আয়েশে থাকতে নেতারা সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে জেলে ঢুকছে এমন প্রচারণাও রয়েছে। যা চেয়ারপার্সনও বিশ্বাস করেন।’
নেতাদের নামে গড়ে ৩০ থেকে ৪০টি বাড়ি!
কোন কোন বিএনপি নেতার নামে ঢাকায় ৩০ থেকে ৪০টি করে বাড়ি রয়েছে বলে দাবি করেছেন দলটির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম। তিনি বলেছেন, এভাবে সম্পদশালী হওয়ার প্রক্রিয়া থেকে বের হতে না পারলে সরকার বিরোধী আন্দোলন সফল হবে না। গতকাল বুধবার বিকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল আয়োজিত ‘শহীদ জিয়ার আদর্শে গড়বো বাংলাদেশ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এই মন্তব্য করেন। ইত্তেফাক