দীর্ঘ ১৯ বছর পর আগামী ৩০ ডিসেম্বর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটের রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এই নির্বাচনে যৌন নিপীড়ন, শিক্ষক লাঞ্ছনা, অস্ত্র মামলা, অবাঞ্ছিত টেন্ডারবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগে সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাও প্রার্থী হয়েছেন। তারা ভিন্ন ভিন্ন প্যানেল থেকে এ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছেন।
এদের মধ্যে শিক্ষক লাঞ্ছনাসহ বিভিন্ন অভিযোগ আছে মীর মেহেদী হাসান টিটুর বিরুদ্ধে। যিনি আসন্ন সিনেট নির্বাচনে অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবিরের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী পন্থীদের একাংশের প্যানেল ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল জোট’ থেকে নির্বাচন করছেন। মিষ্টি বিতরণ করে শত ধর্ষণ উদযাপনকারী জাবি ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জসিম উদ্দিন মানিকের অন্যতম সহযোগী ছিলেন টিটু। মানিক ও টিটু ১৯৯৯ সালের ২৩ আগস্ট নৃবিজ্ঞান বিভাগের তৎকালীন সহকারী অধ্যাপক রেহনুমা আহমেদকে লাঞ্ছিত করেন। ওই ঘটনায় ৩ সেপ্টেম্বর সিন্ডিকেট মানিককে এক বছর ও টিটুকে দুই বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করে।
এ ছাড়া টিটুর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, আর্থিক কেলেঙ্কারিসহ বিভিন্ন অভিযোগ আছে। এসব অভিযোগের বিষয়ে টিটু বলেন, ‘আমি ওই সময়ের মীমাংসিত বিষয় নিয়ে কথা বলতে চাই না।’ নিপীড়নবিরোধী আন্দোলন চলার সময় স্বীকৃতি পাওয়া রেপিস্ট গ্রুপের সক্রিয় সহযোগী ছিলেন মেহেদি জামিল। তিনিও ওই প্যানেল থেকে নির্বাচন করছেন। ওই সময় নিপীড়নবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারীদের অন্যতম ছিলেন ছাত্রফ্রন্ট নেতা মাসুম আহমেদ। তিনিও একই প্যানেল থেকে নির্বাচন করছেন।
আরেক প্রার্থী জাবি ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ সোহেল পারভেজ ২০১৪ সালে সাভার ইপিজেড এলাকায় দুই সহযোগী নিয়ে গুলিভর্তি শটগানসহ আশুলিয়া থানা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। এ ছাড়া ক্যাম্পাসে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপরাধে ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট পারভেজসহ তিন ছাত্রলীগ নেতাকে ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে; কিন্তু অবাঞ্ছিত হওয়া সত্ত্বেও তিনি শরীফ এনামুল কবিরের প্যানেল থেকে নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
ওই প্যানেলের নেতা অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবীরের বিরুদ্ধে ভিসি থাকাকালীন ছাত্রলীগের একটি অঞ্চলভিত্তিক গ্রুপ তৈরির মাধ্যমে ভিসিলীগ গঠন, বিতর্কিত শিক্ষক নিয়োগ, টেন্ডারবাজিসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আছে। তার তৈরি ভিসিলীগের হাতে ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী জুবায়ের হত্যা, তার মেয়াদেই ১৯৭ জন বিতর্কিত শিক্ষক নিয়োগ, যৌন নিপীড়কদের রক্ষা, সাংস্কৃতিক কর্মীদের মারধরসহ বিভিন্ন অভিযোগ আছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এ বিষয়ে অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির বলছেন, ‘কে যোগ্য কে অযোগ্য তা ভোটাররা বিচার করবেন। আমরা যোগ্য প্রার্থীদের মনোনয়ন দিয়েছি, যাতে বিশ্ববিদ্যালয়কে সুন্দরভাবে পরিচালনা করতে পারি।’
এ দিকে আওয়ামীপন্থী অপর অংশের প্যানেল ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও প্রগতিশীল গ্র্যাজুয়েট মঞ্চ’ থেকে নির্বাচন করছেন আধ্যাপক আব্দুল্লাহ হেল কাফী। ১৯৯৯ সালে বিতর্কিত নিয়োগের মাধ্যমে শিক্ষক হওয়া কাফীর বিরুদ্ধে একাধিক যৌন নিপীড়নের অভিযোগ আছে।
তার বিরুদ্ধে ২০১০ সালের ১৫ এপ্রিল একই বিভাগের শিক্ষিকা যৌন নিপীড়নের অভিযোগ করেন। অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় কাফীকে বিভাগীয় সভাপতি ও সব পদ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। সহযোগী অধ্যাপক থেকে পদাবনতি ঘটিয়ে তাকে সহকারী অধ্যাপক করে প্রশাসন। তার বিরুদ্ধে সাভারে এক প্রকৌশলীর স্ত্রীর সাথে অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগ আছে এবং ২০০০ সালের ২৫ জানুয়ারি নিজ এলাকা টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে এক ব্যক্তি যৌন নিপীড়ন, ডাকাতি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মামলা করেন (মামলা নং ১৭)। ওই বছরের ৬ মার্চ কাফীকে প্রধান আসামি করে ওই মামলার চার্জশিট দেয়া হয়। এসব বিষয়ে আব্দুল্লাহ হেল কাফী বলেন, ‘আমাকে হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য এসব করা হয়েছে।’
আওয়ামীপন্থী অপর অংশের প্যানেল থেকে প্রার্থী হয়েছেন মাহমুদুল আলম বাবু। বিশ্ববিদ্যালয়ের মওলানা ভাসানী হল শাখা ছাত্রলীগের তৎকালীন এ সভাপতি যৌন নিপীড়নবিরোধী আন্দোলন চলার সময় ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার হয়েছিলেন। তার নেতৃত্বে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনকারী ১৮ শিক্ষার্থীকে এক রাতে মারধর করে আহত করা হয়। আহতদের মধ্যে ভাস্কর আবেদিন ও বাম ছাত্রনেতা সৈকত শুভ্র আইচ মনন গুরুতর যখম হন; কিন্তু তারা এখন একই প্যানেল থেকে নির্বাচন করছেন।
এ দিকে বিএনপিপন্থী ‘স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, বহুদলীয় গণতন্ত্র ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী’ প্যানেল থেকে এমন কয়েকজন প্রার্থী হয়েছেন যাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ আছে। এদের মধ্যে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি মো: জিয়াউর রহমান জিয়ার বিরুদ্ধে ভাঙচুরসহ কয়েকটি মামলা আছে। তিনি ওইসব মামলায় সাত মাস কারাগারে ছিলেন। নির্বাচনে জয়ী হতে আদর্শ বিকিয়ে দিয়ে আওয়ামী ও বামপন্থীদের সাথে গোপন আঁতাতের মাধ্যমে অদৃশ্য একটি প্যানেল গঠনের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।
এ ব্যাপারে একাধিক ছাত্রদল নেতা জানান, বর্তমানে ছাত্রদল কর্মীরা ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে না পরলেও জিয়া হরহামেশাই আসছেন। আঁতাতের কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া ওই প্যানেল থেকে নির্বাচন করছেন জাবি শাখা ছাত্রদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হাসান অভি। তার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, জমি দখলসহ বেশ কিছু অভিযোগ আছে।
এসব বিষয়ে তিনি বলেন, এগুলো মিথ্যা ও ভিত্তিহীন। ধর্ষক ও ভিসিবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক অধ্যাপক সাঈদ ফেরদৌস বলেন, ‘অনেক বিতর্কিতই প্রার্থী হয়েছেন এটা দুঃখজনক। নিপীড়কসহ বিতর্কিতরা যে প্যানেলেরই হোক তাদেরকে বর্জন করাই উত্তম হবে।’
বিতর্কিতদের প্রার্থিতা নিয়ে রিটার্নিং অফিসার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ শেখ মো: মঞ্জুরুল হক বলেন, ‘আচরণবিধি না থাকায় এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে পারব না।