পদোন্নতি ঝড়ে লণ্ডভণ্ড জনপ্রশাসন। অন্যবারের মতো দলীয়করণের প্রভাব এবারো রয়েছে। পদোন্নতির আনন্দের চেয়ে বঞ্চিতদের বেদনার জোয়ারে যেন এখনো ভাসছে জনপ্রশাসন। এক সপ্তাহ আগে পদোন্নতির ঘটনায় পদসংখ্যার দ্বিগুণেরও বেশি কর্মকর্তা বর্তমানে জনপ্রশাসনে। যারা পদোন্নতি পেয়েছেন তাদের পদবি পরিবর্তন হলেও পদ সঙ্কট চরমে। এর ফলে পদোন্নতিপ্রাপ্ত বেশির ভাগ কর্মকর্তার পূর্বপদে বহাল থাকার আদেশ জারি হয়েছে ইতোমধ্যে। অন্য দিকে পদোন্নতিবঞ্চিত ১১ শ’ কর্মকর্তা। জুনিয়র অনেকেই তাদের ডিঙিয়ে ওপরের পদে আসীন। ফলে সামাজিক ও মানসিকভাবে তারা ভেঙে পড়েছেন। অন্য দিকে পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা দীর্ঘ দিন ধরে পদ না পেলে তারাও হতাশায় নিমজ্জিত হবেন। পাশাপাশি যারা পদোন্নতিবঞ্চিত হয়ে জ্যেষ্ঠতা হারিয়েছিলেন, তাদের জ্যেষ্ঠতা দিয়ে পদোন্নতির বিষয়টি এবারের পদোন্নতির সময় বিবেচনা করা হয়নি। এর ফলে এসব কর্মকর্তার মধ্যেও হতাশা আর ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, এবারের পদোন্নতি থেকে অনেক মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাও বঞ্চিত হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে জনপ্রশাসনের একজন কর্মকর্তা জানান, যারা মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবি করেছেন তাদের কাগজপত্র যাচাই-বাছাইয়ের জন্য পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো ফেরত আসার আগেই পদোন্নতি আদেশ হয়ে গেছে। এসব মুক্তিযোদ্ধা কর্মকর্তাও এখন হতাশায় ডুবেছেন। এসব বিষয় প্রশাসনের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ডে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশঙ্কা কর্মকর্তাদের। গেল ৬ এপ্রিলের পদোন্নতি ঝড়ে লণ্ডভণ্ড জনপ্রশাসন। সেদিন একসাথে তিন স্তরে ৮৭৩ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে। এ পদোন্নতি ঝড়ে প্রশাসনে ‘চেইন অব কমান্ড’ ঠিক রাখাটাই এখন সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন অভিজ্ঞ কর্মকর্তারা।
৬ এপ্রিল রাতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা আদেশে ৮৭৩ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়। এতে অতিরিক্ত সচিব পদে ২৩১ জন, যুগ্ম সচিব পদে ২৯৯ জন এবং উপসচিব পদে ৩৪৩ জন কর্মকর্তা পদোন্নতি পান। এ পদোন্নতির ফলে বর্তমানে জনপ্রশাসনে অতিরিক্ত সচিবের ১০৭ পদের বিপরীতে কর্মকর্তা ৩৭৩ জন, যুগ্ম সচিবের ৪৩০ পদের বিপরীতে ৮৬৯ জন এবং উপসচিবের ৮৩০ পদের বিপরীতে কর্মকর্তার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৮১৮ জনে। ধারণাগত জ্যেষ্ঠতা না দিয়ে জুনিয়রকে পদোন্নতি দেয়ায় ােভ অসন্তোষের শেষ নেই। এর ফলে যারা অতিরিক্ত সচিব হওয়া থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তাদের কেউ কেউ এ পদোন্নতিকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন বলে জানিয়েছেন। সব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও যারা যুগ্ম সচিব ও উপসচিব পদে বঞ্চিত হয়েছেন তাদেরও কষ্টের শেষ নেই। পদোন্নতি না পওয়ার কোনো কারণ তারা খঁজে পাচ্ছেন না। ােভ-হতাশায় ভুগছেন। ইচ্ছে করলেও তারা স্বাভাবিকভাবে অফিসের কাজ করতে পারছেন না।
চাকরি জীবনে কোনো কর্মকর্তা একবার শাস্তি পেলে তিনি আর পদোন্নতি পাবেন না। এমনটাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি)। তবে বিশেষ বিবেচনায় শুধু উপসচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হতে পারে। কর্মকর্তারা জানান, এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণে এবার তিন স্তরে একযোগে পদোন্নতি দেয়ার সময় অন্তত আড়াই শ’ কর্মকর্তা পদোন্নতি থেকে ছিটকে পড়েছেন। এ ছাড়া বেঞ্চ মার্ক (প্রয়োজনীয় পাস নম্বর) না থাকা, গুরুতর অভিযোগে বিভাগীয় মামলাসহ অন্য আরো কিছু কারণে পদোন্নতি পাননি কয়েক শ’ কর্মকর্তা। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেয়ার জন্য এবার প্রায় দুই হাজার কর্মকর্তার নাম বিবেচনায় নেয়া হয়েছিল। চূড়ান্তপর্বে পদোন্নতি পেয়েছেন ৮৭৩ জন। বাদ পড়েছেন সব মিলিয়ে প্রায় ১১ শ’।
বর্তমানে ১৯৮১ ব্যাচের একজন এবং ১৯৮২ ও ১৯৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তারাই বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে সিনিয়র সচিব ও সচিবের দায়িত্ব পালন করছেন। এ ছাড়া অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতিপ্রাপ্তদের মধ্যে ১৯৮২, ১৯৮৩, ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ ব্যাচের কর্মকর্তারা রয়েছেন। ১৯৮২ ব্যাচের যারা এখন অতিরিক্ত সচিব হলেন তারা কিভাবে একই ব্যাচ, ’৮৩ কিংবা ’৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তার অধীনে কাজ করবেন এ নিয়ে তাদের মধ্যে সংশয় দেখা দিয়েছে। যুগ্ম সচিব পদেও ১৯৮২, ১৯৮৩, ১৯৮৪ ও ১৯৮৫ ব্যাচের ছাড়াও দশম ব্যাচের কর্মকর্তারা রয়েছেন। উপসচিব পদে মূলত ২০তম ব্যাচের কর্মকর্তারাই বেশি পদোন্নতি পেয়েছেন।
অন্য দিকে যারা পদোন্নতি পেয়েছেন তারা পোস্টিং পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন। সংশ্লিষ্টরা জানান, পদোন্নতিপ্রাপ্ত প্রায় সবাইকেই পদোন্নতিপূর্ব পদে রাখা হচ্ছে। ভালো জায়গায় পদায়ন পেতে কর্মকর্তাদের তদবির এখন চরমে। গতকালও এসব কর্মকর্তাকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে বিভিন্ন কর্মকর্তার কক্ষে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গেছে। মাঠ প্রশাসনে পদোন্নতিপ্রাপ্ত বিভাগীয় কমিশনার, ডিসি, জেলা পরিষদের সিইও, সচিব, এনআইএলজির পরিচালক, উপপরিচালকদের নিজ নিজ পদে রাখা হয়েছে। মন্ত্রণালয়, বিভাগ, উন্নয়ন প্রকল্পের পিডিদেরও এ মুহূর্তে আগের পদ থেকে সরানো হচ্ছে না। কর্মকর্তারা জানান, এবারের বড় পদোন্নতির কারণে জনপ্রশাসনে বিশৃঙ্খলার পাশাপাশি সরকারের ব্যয়ও বেড়ে যাবে। যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পাওয়া ২৯৯ কর্মকর্তাকে সার্বণিক যানবাহন সুবিধা দিতে হবে। এর সাথে প্রতিটি স্তরের কর্মকর্তার অতিরিক্ত বেতনভাতার বোঝা চাপবে সরকারের ঘাড়ে। চাইলে বিনা সুদে সরকারের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঋণ নিয়ে গাড়িও কিনতে পারবেন তারা। সে সাথে পাবেন ৩০ হাজার টাকার মাসিক যানবাহন ভাতা। আর যারা ওএসডি থাকবেন তাদের কাছ থেকে সেবা গ্রহণ ছাড়াই মাসে মাসে বেতনভাতা গুনতে হবে সরকারকে। সূত্র: নয়াদিগন্ত
Sign in
Welcome! Log into your account
Forgot your password? Get help
Password recovery
Recover your password
A password will be e-mailed to you.