ফাঁসি না দেওয়ার অনুরোধ পেয়েছি: প্রধানমন্ত্রী

নির্যাতিত, ক্ষতিগ্রস্তের কথা না ভেবে যারা তাদের ওপর মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে তাদের মানবাধিকার নিয়েই ‘সবাই সোচ্চার’ বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সাজা কার্যকর করতে গিয়ে ‘বড় বড়’ জায়গা থেকে বাধা পাওয়ার কথা তুলে ধরে এ মন্তব্য করেছেন তিনি।

বুধবার গণভবনে কলামনিস্ট, লেখক, টকশোর আলোচক ও সঞ্চালকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “আমরা রায় কার্যকর করতে শুরু করেছি। আপনারা দেখেছেন যে, এ বিচারের রায় কার্যকর করতে গিয়ে কত উঁচু জায়গার টেলিফোন, ফাঁসি যেন দেওয়া না হয় সেই অনুরোধ পর্যন্ত করা হয়েছে।

“মানবাধিকারের কথা বলব, কিন্তু মানবাধিকার যারা লংঘন করবে তাদের মানবাধিকার রক্ষা করতে হবে নাকি? এখানে আমার একটা প্রশ্ন- যারা মারা গেল বা নির্যাতিত হল বা ক্ষতিগ্রস্ত হল তাদের কথা চিন্তা না করে যারা ক্ষতি করছে, যারা মানবাধিকার লংঘন করেছে, সেই মানবাধিকার লংঘনকারীদের মানবাধিকার নিয়ে সবাই যেন খুব বেশি সোচ্চার হয়ে পড়ে।

“এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে গিয়ে ওই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হল আমাদের। মানবাধিকার লংঘনকারীদের মানবাধিকার নিয়ে সবাই খুব ব্যস্ত।”

একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরদের হাতে নির্যাতিত, নিহতদের কথা না ভেবে তাদের যারা হত্যা, ধর্ষণ করেছে তাদের প্রতি ‘সহানুভূতি’ দেখানোর সমালোচনা করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।

“এই একটা অদ্ভুত বিষয় আমি সব সময় দেখি যে, অপরাধীদের জন্য সবার মায়াকান্না। আর এই অপরাধীদের জন্য যারা জীবনটা দিল তাদের জন্য অত দুঃখ নাই।”

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফাঁসি কার্যকর করা নিয়েও এ সময় কথা বলেন শেখ হাসিনা।

“আন্তর্জাতিকভাবে ফাঁসি নিয়ে এত কথা হচ্ছে। ফাঁসি কি হচ্ছে না? ফাঁসি কি হয় নাই? ঈদের দিনে সাদ্দামকে ফাঁসি দিল। যারা ফাঁসির বিরুদ্ধে এত কথা বলে, তারাই তো আবার সাদ্দামের ফাঁসি দেখে হাততালি দিয়ে খুশি হয়।”

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সাদ্দাম যে অপরাধ করেছে, ওই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বা তাদের দোসর আল-বদর, রাজাকার, আল-শামস তারাও কি একই অপরাধ করেনি বাংলাদেশে? তার থেকে জঘন্য অপরাধই তো তারা করেছে।

“তাহলে তাদের অপরাধটা অপরাধ না কেন? এদেশের মানুষের কি জীবনের মূল্য নেই? এদেশের মানুষের কোনো অধিকার নাই বিচার চাওয়ার?”

লিবিয়ার প্রয়াত নেতা মুয়াম্মার গাদ্দাফি ও লাদেনের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “এই লাদেন বা সাদ্দাম বা গাদ্দাফি কাদের সৃষ্টি বা কারা সৃষ্টি করেছে, কারা মেরেছে, কারা আবার তাদের মেরে আবার খুশি হচ্ছে। তারা অপরাধ করলে তাদের শাস্তি দেওয়া যাবে, আর আমার দেশে একই ধরনের অপরাধ যারা করেছে তাদের যদি শাস্তি দেওয়া হয় তাহলে সেটা কেন মানবাধিকার লংঘন হবে বা তার জন্য বিবেকে এত তাড়া করে কেন?

“কিন্তু যারা ক্ষতিগ্রস্ত, যাদের ওপর এত জুলুম, যারা সবকিছু ত্যাগ স্বীকার করেছে তাদের কথা কেউ চিন্তা করবে না?”

হরতাল-অবরোধে যখন একের পর এক গাড়িতে আগুন দিয়ে মানুষ হত্যা করা হয় তখন সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে, বরং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে কেউ মারা পড়লে তার সমালোচনা হয় বলে মন্তব্য করেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, “অপরাধীরা যখন মারা গেছে সেই অপরাধীদের জন্য কান্না। কি? ক্রসফায়ারে মানুষ মারা হচ্ছে। ক্রসফায়ার তো না। কেউ যখন অপরাধ করতে যায়, পুলিশের তো রাইট আছে সেই মানুষের জানমাল বাঁচানো। আর সেটা বাঁচানোর জন্য তাদের যেটা করার তা তাদের করতে হবে। আমরা বাধ্য হয়েছি পুলিশকে সেই নির্দেশ দিতে।

“স্পষ্ট বলেছি- অস্ত্র পকেটে রেখে দেওয়ার জন্য নয়, অপরাধীকে দমন করার জন্য। অপরাধীকে দমন করতেই হবে। মানুষকে পুড়িয়ে মারছে, বাসের মধ্যে আগুন দিচ্ছে, রেলে আগুন দিচ্ছে, রেললাইন তুলে ফেলছে, মানুষ হত্যা করছে। আর সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবে যে, ও আগুন দিচ্ছে ওকে কিছু করা যাবে না! আর কিছু করলেই মানবাধিকার লংঘন হয়ে যাবে।

“আর যারা পুড়ছে সেই মানুষগুলির কী অপরাধ?”

মতিঝিল থেকে হেফাজতে ইসলামীর কর্মীদের সরিয়ে দেওয়ার ঘটনা নিয়ে ‘মিথ্যাচার’র কথাও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।

“রটনা করা হলো ২০০০ মানুষকে মেরে ফেলা হয়েছে। যখন বারবার ডিমান্ড করা হল, তালিকা চাওয়া হল তারা তো ২০০ মানুষের তালিকা দিতে পারেনি। ৬১ জনের যে তালিকা দেওয়া হলো সেখানেও অনেককে দেখা গেল যে, ‘আমি তো মরি নাই, আমি এখনো বেঁচে আছি’। এরাই হল মানবিধকার সংরক্ষণ করার দায়িত্বে আছে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটা ধোঁকাবাজি খেলা হল।”

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার কারণেই এসব অপপ্রচারের মুখোমুখি হতে হচ্ছে বলে মনে করেন শেখ হাসিনা।

তবে যতো বাধাই আসুক না কেন তা পেরিয়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্পন্ন করার প্রত্যয় জানিয়ে তিনি বলেন, “প্রচার-অপপ্রচার, লেখা-নানা ধরনের কথাবার্তা। স্বাভাবিকভাবেই এটা মোকাবিলা করতে আমি জানি। কারণ যে মুহূর্তেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে শুরু করেছি তখন অনেক কিছু মোকাবিলা করতে হবে।”

বাংলাদেশকে ‘উন্নত, সমৃদ্ধ’ এবং ২০২০ সালের মধ্যেই মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে বলে জানান শেখ হাসিনা।

মতবিনিময়ে অংশগ্রহণকারীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “সমালোচনা আপনারা করবেন, তাতে কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু এমন কিছু করবেন না যাতে, ওই সন্ত্রাসী গ্রুপ বা যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাই চায়নি, তাদের হাত শক্তিশালী হয়। এটুকুই সহযোগিতা চাইব।”

মতবিনিময়ে অন্যদের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শাসসুজ্জামান খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, লেখক সেলিনা হোসেন, তথ্যমন্ত্রী হাসানুক হক ইনু, সমকালের সম্পাদক গোলাম সারওয়ার, প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী, মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল, কলামনিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব এ কে এম শামীম চৌধুরী, বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিল, উপ-প্রেস সচিব আশরাফুল আলম খোকন, মামুন-অর-রশিদ উপস্থিত ছিলেন।

Exit mobile version