আল জাজিরা : গত মাসে ঢাকার একটি ব্যস্ত সড়ক থেকে অপহরণ করা হয় এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে। এক মাসেরও বেশি সময় পরে বাসায় ফিরেছেন তিনি।
ফেরার পর তিনি বলেছেন, “অজ্ঞাত অপহরণকারীরা’ তুলে নিয়ে যায় তাকে। তিনি মোবাশার হোসেন। ঢাকার নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপক মোবাশারকে অপহরণ করা হয়েছিল ৭ নভেম্বর।
গত শুক্রবার তাকে ঢাকার কাছে একটি মহাসড়কে মাইক্রোবাস থেকে ফেলে যাওয়া হয়। মোবাশার বলেন, এ সময় হুশিয়ারি দিয়ে তাকে বলা হয়, ‘সোজা চলে যা, যদি পেছন ফিরে তাকাস, তোকে খুন করে ফেলব।’
তিনি জানান, অন্ধকার একটি রুমে তাকে আটকে রাখা হয়েছিল ৪৪ দিন। এরপর চোখ বঁাধা অবস্থায় টানতে টানতে তাকে মাইক্রোবাসে উঠানো হয়।
মুক্তি পাওয়ার প্রায় ১২ ঘণ্টা পর শুক্রবার সকালে তার বাসার বাইরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন মোবাশার। তিনি বলেন, ‘অনেক দিন পর আমি দিনের আলো দেখছি।’ তার অপহরণের ঘটনাটি এর আগের আরেকটি ঘটনার সঙ্গে মিলে যায়।
মোবাশার বাসায় ফেরার মাত্র দু’দিন আগে ঢাকার সাংবাদিক উত্পল দাসকে মুক্তি দেয়া হয়। তাকে আটকে রাখা হয়েছিল ৭১ দিন। উৎপল দাসও বলেন, ঢাকা থেকে তাকে অপহরণ করে চার বা পাঁচ অজ্ঞাত অপহরণকারী’।
অপহরণকারীরা এই দুই ব্যক্তিকেই প্রকাশ্য দিনের আলোয় তাদের গাড়িতে তুলে নেয়। উত্পল দাস আরও বলেন, তাকেও চোখ বাঁধে একটি মাইক্রোবাসে তোলা হয়। এরপর তাকে ফেলে যাওয়া হয় একটি মহাসড়কে।
মোবাশার জানান, অপহরণকারীদের একজন তার চোখের ভেতর কিছু একটা ঘঁষে দেয়। এতে তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। উত্পল দাস বলেন, কালো কাপড় দিয়ে তার গলা চেপে ধরা হয়েছিল।
তবে তাদের দু’জনের কেউই অপহরণকারীদের চিনতে পারেননি। তাদের এমন একটি সময়ে মুক্তি দেয়া হয়েছে, যখন বাংলাদেশে মারুফ জামানসহ সুপরিচিত অনেক মানুষের গুমের ঘটনা ঘটেছে।
মারুফ জামান ৪ ডিসেম্বর থেকে নিখোঁজ রয়েছেন। তিনি কাতার ও ভিয়েতনামে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত ছিলেন। এ বছরের শুরুর দিকে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রকাশিত এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৩ সাল থেকে কয়েকশ’ মানুষকে অবৈধভাবে আটক করেছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা।
শুধু গত বছরেই ‘জোরপূর্বক গুমের শিকার’ হয়েছেন ৯০ জন। ওই রিপোর্ট প্রকাশের সময় হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়াবিষয়ক পরিচালক ব্রাড এডামস এক বিবৃতিতে বলেন, ‘গুমের ঘটনাগুলো প্রমাণিত এবং এসব বিষয়ে রিপোর্ট হয়েছে।
তা সত্ত্বেও কোনো আইনের তোয়াক্কা না করে সরকার এ চর্চা অব্যাহত রেখেছে। বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনী লোকজনকে মুক্তহসে্ত আটক করছে।
তারা অপরাধী হবে নাকি নিরপরাধী হবে- সে সদ্ধিান্তও নিচ্ছে তারা। তাদের শাসি্ত দেয়ার বিষয়টিও তারা নিশ্চিত করছে। এমনকি তাদের বেঁচে থাকার অধিকার আছে কিনা তাও তারা নির্ধারণ করছে।’
ঢাকা ট্রিবিউনের রিপোর্ট অনুযায়ী, গত চার মাসে ঢাকা থেকে নিখঁোজ হয়েছেন ১৪ জন। এর মধ্যে মোবাশার হাসান ও উৎপল দাসসহ এখন পর্যন্ত বাসায় ফিরেছেন পাঁচজন। স্থানীয় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হওয়া তিনজন রয়েছেন নিখোঁজ। মারুফ জামানসহ অন্যদের কী পরিণতি হয়েছে, তা এখনও জানা যায়নি।
মানবাধিকার বিষয়ক আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, চলমান এ অপহরণের ঘটনাগুলো শুধুই অর্থ আদায়ের উদ্দেশ্যে এটা মনে করেন না তিনি। বরং রাষ্ট্রের জন্য হুমকি এমন যে কারও প্রতি একটা ভীতিকর বার্তা দিতেই এগুলো করা হচ্ছে। শাহদীন মালিক আলজাজিরাকে বলেন, ‘আমার মনে হয় যারা সরকারের সমালোচক তাদের রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে বিবেচনা করছে আইন প্রয়োগকারী এজেন্সিগুলো।’
মোবাশার হাসান রাজনীতিতে ইসলাম এবং জঙ্গি ইসু্যতে বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখেছেন। অন্যদিকে উৎপল দাস বাংলাদেশের একটি বাহিনীকে নিয়ে খবর লিখেছেন।
সাবেক কূটনীতিক মারুফ জামান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচক ছিলেন। ফেসবুকে সরকারবিরোধী অন্যদের পোস্ট শেয়ার দিতেন তিনি।
শাহদীন মালিক বলেন, মোবাশার হাসান ও মারুফ জামানের মতো ব্যক্তিরা রাষ্ট্রের স্বার্থের বিরুদ্ধে যায় এমন কর্মকাণ্ডে জড়িত বলে সন্দেহ হতে পারে আইন প্রয়োগকারী এজেন্সিগুলোর।
এর ফলে তাদের আটক ও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়ে থাকতে পারে। শাহদীন মালিক বলেন, ‘এ প্রবণতা ভুল এবং মানবাধিকারের মারাত্মক লঙ্ঘন।’
কর্তৃপক্ষ এসব ঘটনাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে কিনা সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মানবাধিকার বিষয়ক কর্মীরা। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ভাষ্যকার আফসান চৌধুরী বলেন, গুম দেশে একটি গ্রহণযোগ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
আর সমস্যাটা এখানেই। শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের মানবাধিকার বিষয়ক কর্মী ও পরিচালক নূর খান লিটন জানতে চান, আইন প্রয়োগকারী এজেন্সিগুলো কেন এসব ‘নিখোঁজ মানুষগুলোকে’ খুঁজে বের করার চষ্টো করছে না, যাদের দৃশ্যত অনেক ক্ষমতা রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, ‘মোবাশার হাসান অথবা উত্পল দাস পরিষ্কার করে বলেছেন, তাদের তুলে নিয়েছিল অজ্ঞাত ব্যক্তিরা। তাদের প্রকাশ্য দিনের আলোতে কাউকে তুলে নেয়ার ক্ষমতা আছে।
তুলে নিয়ে দীর্ঘ সময় অজ্ঞাত স্থানে আটকে রাখার এবং সেখান থেকে তাদের ছেড়ে দেয়ার ক্ষমতা আছে।’ অপহরণকারীদের খুঁজে বের করতে কর্তৃপক্ষের প্রতি তিনি সব রকম পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘এটা একটি গভীর উদ্বেগের বিষয়।’