নির্বাচন নিয়ে আবার ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। ২৮ এপ্রিল অনুষ্ঠিত ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ এনে স্বচ্ছ তদন্তের দাবি জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘও নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে শুক্রবার তিন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে কথা বলেন সংস্থাটির মহাসচিব বান কি মুন। এছাড়া ভোটের দিনই কারচুপির অভিযোগ এনে দুপুরের আগেই বিএনপি নির্বাচন বর্জন করে।
আন্তর্জাতিক মহলের এমন প্রতিক্রিয়ায় সরকার বিচলিত নয় জানালেও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর শাসক দলটি আবারও চাপের মুখে পড়েছে। সেক্ষেত্রে এবারের নির্বাচনের দৃষ্টান্ত আগামীতে সরকারবিরোধী আন্দোলনের মূল অস্ত্র হলে শাসক দলের জন্য তা মাথাব্যথার কারণ হতে পারে। তাদের মতে, শাসক দল আগে থেকেই দাবি করে আসছে তাদের অধীনেই অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন করা সম্ভব। উন্নয়ন সহযোগীসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সামনে সরকারের পক্ষ থেকে নানা সময়ে এ ধরনের বক্তব্য দেয়া হয়েছে। কিন্তু ২৮ এপ্রিল তিন সিটি নির্বাচনে যা ঘটেছে, এরপরও কি শাসক দলের পক্ষ থেকে দাবি করা হবে যে, তাদের অধীনে নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব। আর বিদেশীরা কি সরকারি দলের এ ধরনের বক্তব্যের ওপর আস্থা রাখতে পারবেন। মার্কিন কংগ্রেসের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল সংক্রান্ত উপকমিটির শুনানিতে শাসক দলকে অচলাবস্থা নিরসনে বিরোধী দলের সঙ্গে সংলাপে বসতে চাপ দেয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ৩০ এপ্রিল এ শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এতে এশিয়া স্টাডিজ সেন্টার, দ্য হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো লিসা কার্টিজ বলেন, অচলাবস্থা নিরসনে যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই অধিকতর সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। যৌথ উদ্যোগের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রকেই ভারতের সঙ্গেও কাজ করতে হবে। যদিও নয়াদিল্লি এরই মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতায় বসতে প্রভাব খাটানোর ইচ্ছা থেকে দূরে রয়েছে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার রোববার বলেন, তারা (সরকার ও আওয়ামী লীগ) যদি মনে করে তাহলে ভাবমূর্তি সংকট। না মনে করলে নয়। এগুলোতে যদি ভ্রুক্ষেপ ও বিব্রত বোধ না করে তাহলে কোনো সংকটই নয়। তবে আমি মনে করি, সত্যিকারে আমরা একটা সংকটের মধ্যে আছি। কেউ যদি এটা মনে না করে তবে তা দুঃখজনক। এর মাশুল সবাইকে দিতে হবে।
মঙ্গলবার ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন শুরুর চার ঘণ্টা পর বিএনপি অনিয়মের অভিযোগ এনে বর্জনের ঘোষণা দেয়। ফলে এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীরা সহজেই বিজয়ী হন। ওই দিন ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা স্টিফেনস ব্লুম বার্নিকাট টুইটারে লেখেন, যে কোনো মূল্যে জয়, প্রকৃতপক্ষে কোনো জয় নয়। রাতে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাস জানায়, বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোট জালিয়াতি, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন নির্বাচনের অনিয়মের সব অভিযোগের দ্রুত ও নিরপেক্ষ তদন্ত জরুরি বলে মন্তব্য করেন। বাংলাদেশ সফররত মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের আন্ডার সেক্রেটারি ওয়েন্ডি শারম্যান শনিবার ঢাকায় এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে সুষ্ঠু ভোট অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সিটি নির্বাচনের সব অনিয়মের স্বচ্ছ তদন্তের প্রতি গুরুত্বারোপ করছে। দুদেশের (বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) মধ্যে অনুষ্ঠিত চতুর্থ অংশীদারি সংলাপের পর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় যৌথ এ সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে শুক্রবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন।
তবে জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুনের ফোন এবং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ আন্তর্জাতিক মহলের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ায় সরকার বিচলিত নয় বলে জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী। শনিবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, নির্বাচনে কোনো প্রাণহানি না হওয়ার বিষয়টি একটি বড় সাফল্য। একই দিন বেসরকারি একটি টেলিভিশনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে কথা বলার আগে যুক্তরাষ্ট্রকে আয়নায় নিজের চেহারা দেখার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি- এটি বলার অধিকার যুক্তরাষ্ট্রের নেই। এইচটি ইমাম যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোরে সাম্প্রতিক কৃষ্ণাঙ্গ-শ্বেতাঙ্গ দাঙ্গার প্রসঙ্গও আনেন। এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা তিন সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছে বলে দাবি করেছেন। শনিবার অনুষ্ঠিত ১৪ দলের বৈঠকে শরিকরা নির্বাচনে অনিয়মের বিষয় তুলে ধরেন।
তবে বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে জোটের মুখপাত্র, স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, সিটি নির্বাচনে দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া কোনো ধরনের অঘটন ঘটেনি। অবশ্য প্রকাশ্যে দল ও সরকারের প্রধান এবং শাসক দলের নেতারা নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ দাবি করলেও অনেকে ভেতরে ভেতরে আত্মসমালোচনায় দগ্ধ হচ্ছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের এক উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য বলেন, আওয়ামী লীগকে এভাবে জিততে হবে তা তিনি মনে করেন না। পাঁচ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের সব কটিতে পরাজিত হতে পারলে এখানে একটি আসন ছেড়ে দিলে কোনো ক্ষতি হতো না। ওই নেতার মতে, বাড়তি কিছু না করলেও চট্টগ্রাম এবং ঢাকা দক্ষিণে আওয়ামী লীগ সমর্থিত দুই প্রার্থী জয়ী হতেন। ভোটের ব্যবধানে সে চিত্র ফুটে উঠেছে বলে ওই নেতার দাবি। মেহেদী হাসান
যুগান্তর