সিটি নির্বাচন ঘিরেও কঠোর অবস্থানে রয়েছে সরকার। চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা কাটিয়ে উঠতে বিএনপি নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোটকে কিছুটা ছাড় দেয়ার দাবি উঠলেও তাতে কর্ণপাত করছে না সরকারের নীতি নির্ধারক মহল। বিশেষ করে নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে বিরোধী জোটের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার বন্ধ, দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় খুলে দেয়াসহ প্রার্থীদের সমান প্রচারণার সুযোগ দেয়ার ব্যাপারে সরকার নীরব। উল্টো নির্বাচনের সমান মাঠ তৈরি করতে সাঁড়াশি অভিযানের দাবি তুলছেন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের কেউ কেউ। আবার কেউ বলছেন, সিটি নির্বাচনে জনগণ বিএনপির সন্ত্রাসীদের চায় না। সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকবে, কিন্তু সন্ত্রাসীদের জন্য নয়। তাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বুধবার জাতীয় সংসদে বলেছেন, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের নামে বিএনপি নেত্রী আবার কী সুর তুলেছেন। এর মধ্যে ‘বেসুর’ আছে।
আওয়ামী লীগের নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র জানায়, রাজনৈতিকভাবে বিএনপিকে ঘুরে দাঁড়ানোর কোনো সুযোগ দেবে না সরকার। সিটি নির্বাচনের মাধ্যমে দলটি যাতে প্রাণশক্তি ফিরে না পায় সে জন্য রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সব ধরনের পদক্ষেপই অব্যাহত রাখবে মতাসীন আওয়ামী লীগ। তারই আভাস দিয়ে যাচ্ছেন দল ও সরকারের কর্তাব্যক্তিরা।
দলটির নীতিনির্ধারকেরা মনে করছেন, বিএনপি টানা কর্মসূচি দিয়ে কান্ত ও ব্যর্থ হয়েছে। দলটির শীর্ষ ও মধ্যম সারির বেশির ভাগ নেতা নাশকতার অভিযোগে জড়িত। সিটি নির্বাচন কেন্দ্র করে তারা এখন নতুন করে রাজনীতির মাঠে আসতে চাচ্ছে। এতে দলের ভবিষ্যৎ কর্মসূচি ও রাজনীতিতে গতির সঞ্চার হতে পারে। কিন্তু সরকার তাদের সেই সুযোগ দিতে চায় না। তারই অংশ হিসেবে বিরোধী জোটের সম্ভাব্য প্রার্থীদের বাড়ি বাড়ি তল্লাশি ও নেতাকর্মীদের গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত রেখেছে পুলিশ। ইতোমধ্যেই ঢাকা উত্তর ও দণি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা আব্দুল আউয়াল মিন্টু ও দলের সহসাংগঠনিক সম্পাদক নাসিরউদ্দিন আহমেদ পিন্টুর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়েছে। গত প্রায় তিন মাসব্যাপী বিএনপির চলমান আন্দোলনে নাশকতার ‘দায়ে’ অভিযুক্তরাও নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নিতে পারবে না। আর যাদের অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে এমন কেউ নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন না। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থীদের ফৌজদারি মামলার তালিকা ইতোমধ্যেই নির্বাচন কমিশনে জমা দিয়েছে পুলিশ। আর কাউকে গ্রেফতার করার জন্য নির্বাচন কমিশনের অনুমতি নিতে হবে না বলেও জানিয়ে দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। তবে আওয়ামী লীগের অপর একটি সূত্র জানায়, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এখনো প্রমাণিত হয়নি তাদের বিষয়ে সরকার ছাড় দিতে পারে। তাদের কোনো হয়রানি করা হবে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, আন্দোলনমুখী বিএনপিকে নির্বাচনমুখী করতে সমর্থ হওয়ায় আওয়ামী লীগ আপাতত এটিকে রাজনৈতিক বিজয় মনে করলেও এ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণে চাপে পড়েছে মতাসীনেরা। সিটি নির্বাচন কেন্দ্র করে বিএনপির আঁটঘাট বেঁধে মাঠে নামাকে ভেতরে ভেতরে বাড়তি চাপ মনে করছে সরকারি দল। তাদের ধারণা এ ধারাবাহিকতায় নির্বাচনে জয়-পরাজয় যাই হোক বিএনপি কোনো ইস্যু সৃষ্টি করে নতুন উদ্যমে রাজনীতির মাঠে থেকে যেতে পারে। আর ইস্যু সামনে রেখে আন্দোলন চাঙ্গা করতে চাইবে তারা। আর বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও এমন তথ্য দিয়ে সরকারকে সতর্ক থাকতে বলেছে। এ জন্যই সরকার বিএনপিকে রাজনীতির মাঠে কোনো রকম সুযোগ বা ছাড় দিতে চায় না। আর সরকার মনে করছে, বিএনপি মাটি কামড়ে হলেও নির্বাচনে থাকবে। নির্বাচনের ফলাফল যাই হোক তা নিয়েই আগামীর আন্দোলনের সূত্রপাত করবে সরকারবিরোধীরা।
এ জন্য নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে আইনি বিষয়ে বিএনপিকে এখনই কোনো ছাড় দিতে নারাজ সরকার। বিশেষ করে ইতোমধ্যেই গ্রেফতার হওয়া এবং বিভিন্ন মামলা ও গ্রেফতারের ভয়ে পলাতক বিরোধী জোটের প্রভাবশালী নেতাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ইতিবাচক চিন্তা নেই সরকারের।
এ বিষয়ে বেসামরিক বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন গত মঙ্গলবার এক বৈঠক শেষে বলেন, সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড থাকবে। কিন্তু সন্ত্রাসীদের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হয় না। প্রশাসন আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।
গতকাল আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ও সাবেক মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, বিএনপি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের দাবি তুলেছে। আমরা বিএনপির সন্ত্রাসী ও নাশকতাকারীদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযানের মাধ্যমে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড চাই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পদক মাহবুব-উল আলম হানিফ নয়া দিগন্তকে বলেন, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সব দলের জন্য নির্বাচনী আইন সমানভাবে প্রযোজ্য। আইনের বাইরে কিছুই করা হচ্ছে না। এ ব্যাপারে সরকার নির্বাচন কমিশনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে যাচ্ছে। তবে ডিসিসি নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের নামে কোনো সন্ত্রাসী, নাশকতায় অভিযুক্ত ও অভিযোগ প্রমাণিতদের পুনর্বাসন করার সুযোগ নেই। নাশকতায় যারা জড়িত ছিল তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই সরকারের আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনী ব্যবস্থা নেবে।
হানিফ বলেন, বিএনপির যেসব নেতাকর্মী পেট্রলবোমা মেরে নিরীহ মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে, যাদের বিরুদ্ধে পেট্রল দিয়ে গাড়িতে আগুন দেয়ার অভিযোগ আছেÑ তারা যদি মনে করে, নির্বাচনের ধুয়া তুলে মাঠে পুনর্বাসিত হয়ে যাবে সে সুযোগ তারা পাবে না। যাদের নামে অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।
দলের সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, সরকার নৈরাজ্যকারীদের বরদাশত করবে না। যারা মানুষ হত্যাকারী, যারা শিশু ও নারীদের গায়ে আগুন দিয়েছে নির্বাচনে অংশ নিলেই তারা নিরপরাধী হয়ে যাবেন না। যারা অপরাধী তাদের সে অনুযায়ী বিচার হবে। এটাই সভ্যতা, এটাই আইনের শাসন।