সুইস ব্যাংকে অর্থ নিরাপদ থাকবে এমন আস্থা রেখে বাংলাদেশিরা অর্থ পাচার করে থাকেন বলে মনে করা হয়। কিন্তু অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। এমনকি বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের মধ্যে কার কত টাকা জমা রাখছেন সেটির তথ্যও কোনো সংস্থাকে দেওয়া হয় না। সুইস ব্যাংক গ্রাহকের তথ্যের গোপনীয়তা বজায় রাখার কারণে বাংলাদেশিদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশীদের টাকা কত?
সুইস ব্যাংকে থাকা বাংলাদেশি ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের নামে বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা জমা রাখার হালনাগাদ পরিসংখ্যান জানিয়ে প্রকাশ করেছে সেখানকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বৃহস্পতিবার (১৭ জুন) সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশি ব্যক্তি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে থাকা ৫৭ কোটি ৩ লাখ সুইস ফ্রাঁ জমা রয়েছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রার হিসেবে ৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা।
সুইস ব্যাংকের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর জমা রাখা টাকার সুনির্দিষ্টভাবে এক এক করে কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। গোপনীয়তার কথা মাথায় রেখে সকল ডাটা একসঙ্গে করে প্রকাশ করা হয়েছে।
সুইস ব্যাংক কী? সুইস ব্যাংক কোথায় অবস্থিত?
সুইস ব্যাংক নামে আসলে এখন কোনো ব্যাংকই নেই। এই ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৫৪ সালে ৬টি ব্যাংক মিলে সুইচ ব্যাংক কর্পোরেশন নামে এবং ১৯৯৮ সালে এই ব্যাংকটি বন্ধ হয়ে যায়।
অবাক হচ্ছেন? তাহলে এই যে কোটি কোটি টাকা সুইস ব্যাংকে পড়ে থাকার গল্প শুনা যায় এই সবই কি মিথ্যে? না, এই সব কথা মিথ্যে না। সুইস ব্যাংক নামে আলাদা করে কোনো ব্যাংক না থাকলেও Swiss Financial Market Supervisory Authority (FINMA) এর অধীনে সুইজারল্যান্ডের সকল ব্যাংক যেমনঃ UBS,Credit Suisse ইত্যাদিই বর্তমানে সুইচ ব্যাংক নামে পরিচিত। মানে ১৯৯৮ সালে সুইচ ব্যাংকের বিলুপ্তির মাধ্যমে আরেকটি নতুন ব্যাংকিং ব্যাবস্থা শুরু হয়।
সুইস ব্যাংকের ইতিহাস
আজ থেকে প্রায় ৩০০ বছর আগে থেকেই সুইজারল্যান্ডের একটি ব্যাঙ্কে গোপন একাউন্ট খুলে টাকা জমা রাখার ব্যবস্থা ছিল। ফ্রান্সের রাজাদের সঞ্চিত অর্থ গোপন রাখার প্রবণতা থেকেই এই ব্যবস্থা চালু হয়।
সপ্তদশ শতকের শুরুতে ইউরোপের বিভিন্ন জায়গা থেকে অর্থ ব্যবসায়ীরা সুইজারল্যান্ডে এসে পৌঁছায়, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন ইহুদি। জেনেভাকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু আর্থিক লেনদেনের প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল সেই সময়।
১৭১৩ সালে ট্রেড কাউন্সিল অব জেনেভা ব্যাঙ্কিং-এর নীতিমালা প্রকাশ করা হয়। যে নীতির মূল কথাই ছিল কেবল গ্রাহক ছাড়া অন্য কারও কাছে একাউন্ট সম্পর্কিত কোনও তথ্য জানানো যাবে না। শুধু তাই নয়, এই নীতিমালায় যারা কর ফাঁকি দেন, তাদেরও সুস্পষ্টভাবে ছাড় দেওয়া হয়েছিল বলে অনেকে মনে করেন।
১৭৪১ সালে অনুষ্ঠানিকভাবে সুইজারল্যান্ডের প্রথম ব্যাঙ্ক Wegelin and Co প্রতিষ্ঠিত হয়। এর পরে ১৮৫৪ সালে ৬টি ব্যাঙ্ক মিলে একই ছাতার তলায় সমবেত হয়ে একটি যৌথ সংগঠন তৈরি করে।
উনিশ শতকে সুইজারল্যান্ড সরকার দেশের সমস্ত আর্থিক কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করতে এবং আর্থিক লেনদেনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে, এমন সব প্রতিষ্ঠানের তদারকি করতে সুইস ফিন্যান্সিয়াল মার্কেট সুপারভাইজারি অথরিটি বা সংক্ষেপে এফআইএনএমএ (FINMA) গঠন করেন। এই অথরিটির অধীনে যত ব্যাঙ্ক আছে তাদের সবগুলোকেই একসঙ্গে বলা হয় সুইস ব্যাংঙ্ক। জানলে অবাক হবেন, বর্তমানে সুইজারল্যান্ডের প্রায় ৩০০ বেশি ব্যাঙ্ক এই এফআইএনএমএ(FINMA)-এর তালিকাভুক্ত।
সুইস ব্যাংক কেন জনপ্রিয়?
সুইস ব্যাঙ্কের আইন অনুসারে একজন ব্যাঙ্কার কোনোভাবেই কোনো গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট সংক্রান্ত তথ্য অন্য কোথাও প্রকাশ করতে পারবেন না। এমনকি কারোর অ্যাকাউন্ট সুইস ব্যাঙ্কে আছে কিনা তাও ব্যাঙ্কার কাউকে জানাতে পারবেন না।
চুক্তি অনুযায়ী সুইস ব্যাঙ্ক যদি কখনও এই গোপনীয়তা ভঙ্গ করে তাহলে ব্যাঙ্কের বিরুদ্ধে আইনত ব্যবস্থা নিতে পারবেন গ্রাহক। অভিযোগ প্রমাণিত হলে, একজন ব্যাঙ্কারের সর্বোচ্চ ৬ মাস জেল হতে পারে এবং তার সাথে হতে পারে ৫০,০০০ সুইস ফ্রাঙ্ক অর্থদণ্ড। এই চুড়ান্ত গোপনীয়তার শর্তেই সারা বিশ্বে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সুইস ব্যাঙ্ক।
সুইস ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলার যোগ্যতা
সুইস ব্যাঙ্ক নিয়ে অনেকেরই ধারণা, হয়তো বিত্তশালী ব্যবসায়ী, দুর্নীতিবাজ নেতা কিংবা কুখ্যাত মাফিয়ারাই শুধুমাত্র এই ব্যাঙ্কের গ্রাহক হতে পারেন। কিংবা সেইসব মানুষ, যারা নিজের কালো টাকার খোঁজ-খবর কাউকে জানতে দিতে চান না।
কিন্তু এই ধারণা একেবারেই সঠিক নয়। সাধারণ যেকোনও ব্যাঙ্কের মতোই সুইস ব্যাঙ্কেও প্রায় যে কেউ অ্যাকাউন্ট খুলতে পারেন। বিশেষ করে যেসব দেশের সরকার অস্থিতিশীল, সেইসব দেশের বাসিন্দারা মূলত আর্থিক সুরক্ষার জন্য সুইস ব্যাঙ্কে একাউন্ট তৈরি করে থাকেন।
অবশ্য ইদানীংকালে সুইস ব্যাংকের এই গোপনীয়তার নীতি শিথিল করা হয়েছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে। কিছু কিছু দেওয়ানি মামলা, যেমন বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত মামলা বা মানি লন্ডারিং, কর ফাঁকি অথবা সুইস আইনে যা অবৈধ সেইসব ক্ষেত্রে গোপনীয়তার কড়াকড়ি কিছুটা শিথিল হয়েছে। তার মানে এইসব ক্ষেত্রে মামলা হলে সুইস ব্যাঙ্ক বাধ্য থাকবে গ্রাহকের তথ্য প্রকাশ করতে।
সুইস ব্যাংকে টাকা রাখার নিয়ম
অনেকভাবেই অ্যাকাউন্ট খোলা যায় সুইস ব্যাঙ্কে, তবে গোপনীয়তা রক্ষাই যদি অ্যাকাউন্ট খোলার মূল কারণ হয় তাহলে নাম্বারড অ্যাকাউন্ট খোলাই শ্রেয়। ব্যাঙ্কের কিছু হাই অফিশিয়াল কর্মকর্তা ছাড়া এই অ্যাকাউন্টগুলোর তথ্য সচরাচর জানতে দেওয়া হয়না আর কাউকে। আর যদি কেউ নাম্বারড অ্যাকাউন্ট খুলতে চান তাহলে তাঁকে অবশ্যই সশরীরে উপস্থিত থাকতে হবে আর পূরণ করতে হবে বেশ কিছু ফর্মালিটিজ।
সুইস ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলতে কত টাকা লাগে?
নাম্বারড অ্যাকাউন্টে প্রাথমিক অবস্থায় কমপক্ষে ১,০০,০০০ ডলার ডিপোজিট করতে হবে। আর বছরে ৩০০ ডলার গুনতে হবে শুধুমাত্র অ্যাকাউন্ট মেইনটেইনেন্সের জন্যে!
এর বাইরে ১৮ বছর বয়সী যেকোনো প্রাপ্তবয়স্ক মানুষই সাধারণ অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে এই ব্যাঙ্কে। অ্যাকাউন্ট খোলার পর একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ জমা রাখতে হয় গ্রাহককে, সেই অর্থের পরিমাণ অবশ্য ব্যাঙ্ক-ভেদে ভিন্ন হয়।
সুদের হার
সুইস ব্যাঙ্কের একাউন্টে টাকা রাখার সুদের হার কতো জানেন? -০.৭৫ শতাংশ। রাশির আগে মাইনাস চিহ্নটা দেখে অবাক হবেন না। অন্যান্য ব্যাঙ্কের থেকে এখানেই আলাদা সুইস ব্যাঙ্ক। এই ব্যাঙ্কে টাকা রাখলে সুদের টাকা ব্যাঙ্ক দেবে না, উল্টো গ্রাহককেই নিজের গাট থেকে গুনতে হবে সেই টাকা।
এই অদ্ভুত নিয়মের পরও বহু মানুষ টাকা জমা রাখেন এখানে। কারণ সুইজারল্যান্ডের ব্যাঙ্কিং সিস্টেমকে পৃথিবীর অন্যতম স্থিতিশীল ব্যাঙ্কিং সিস্টেম বলা হয়।
আসলে প্রতিদিনের লেনদেনের জন্য কেউ একাউন্ট খোলেনা সুইস ব্যাঙ্কে। এখানে একাউন্ট খোলার মূল কারণই হল গ্রাহকের গোপনীয়তা রক্ষা করা। আরও একটা বড় কারণ সুরক্ষা।
ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ডের সাহায্যে প্রতিদিনের লেনদেন করার উদ্দেশ্য নিয়ে যদি একাউন্ট খুলতে চান, তাহলে কিন্তু সুইস ব্যাঙ্ক সেই অনুমতি দেবেনা আপনাকে। খোলা বাজারে এইরকম লেনদেনের মাধ্যমে গ্রাহকের গোপনীয়তা ভঙ্গ হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকে। অর্থাৎ যে নিরাপত্তা রক্ষার জন্য এত আয়োজন, তা পুরোপুরি ভেস্তে যেতে পারে।
সমাপনী কথা
সুইজারল্যান্ডের অর্থনীতি ব্যাবস্থা খুবই মজবুত। রাজনৈতিক কোনো বিশৃঙ্খলা না থাকায় সুইজারল্যান্ড শুধু তাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে নজর দিতে পেরেছে। সুইজারল্যান্ডে সর্বশেষ যুদ্ধ হয়েছিল ১৫০৫ সালে। সবাই যখন রাজ্য বিস্তারে দিক-বিদিক হয়েছে, সুইজারল্যান্ড তখন তাদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে নতুন নতুন পদক্ষেপ নিয়েছে। ঊনিশ শতকে দুইটি বিশ্ব যুদ্ধের কেন্দ্র ছিল ইউরোপ। কিন্তু সুইজারল্যান্ড এখানেও কোনো যুদ্ধে না জড়িয়ে নিরপেক্ষ থেকেছে। বর্তমানেও সুইজারল্যান্ডকে অত্যন্ত নিরাপদ রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তাই ব্যাংকিং ব্যাবস্থাও এখানে নিরাপদ।
কিন্তু আইনের আড়ালে কর ফাঁকি এবং অবৈধ অর্থের ভান্ডার হয়ে ওঠায় সুইস ব্যাংকের সুনামের থেকে দুর্নামই অনেক বেশি। যদিও বর্তমানে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে সুইস ব্যাংকগুলো কিছুটা শিথিল হয়েছে। ২০০৫ সাল থেকে ক্রমাগত আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০১৩ সালে তথ্য বিনিময় করার একটা আইন করা হয়। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিংবা সুস্পষ্ট প্রমাণের ভিত্তিতে রাষ্ট কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে আসলে সুইস ব্যাংক বিশেষ শর্তের ভিত্তিতে তাদের একাউন্টের হিসাব প্রকাশ করে।
তবে একটা ভুল ধারণা আছে মানুষের মধ্যে যে, সুইস ব্যাংকে হয়তো অনেক বেনামি অ্যাকাউন্ট আছে। যে কথার আসলে কোনো ভিত্তি নেই। যদি কোনো একাউন্টে ৬০ বছরের বেশি সময় ধরে কোনো লেনদেন না থাকে তবে সেই একাউন্টের তথ্য প্রকাশ করা হয়। ১ বছরের মধ্যে কোনো গ্রাহক পাওয়া না গেলে সেই অর্থ সুইস ব্যাংকের কোষাগারে গচ্ছিত করা হয়।
সুইস ব্যাংকের গোপনীয়তা ধীরে ধীরে শিথিল হচ্ছে,এবং রাষ্ট্রদ্রোহী ও স্বৈরশাসকদের টাকা জব্দ করছে। দেশের টাকা বিদেশের একাউন্টে পড়ে থাকলে দেশের বা নিজের কোনো লাভ হয় না। অলস টাকার থেকে বরং বিনিয়োগের টাকা বেশি সম্ভাবনাময়।
সূত্র
- ইত্তেফাক
- দ্য ওয়াল ম্যাগাজিন
- ডেইলি বাংলাদেশ