পর্যটকে মুখরিত কক্সবাজার সৈকত

দেশী-বিদেশী অসংখ্য পর্যটকের পদচারণায় মুখর বিশ্বের দীর্ঘতম কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। তবে তাদের ভ্রমণ সময় কাটছে এক ধরনের উদ্বেগের মধ্য দিয়ে। সম্প্রতি এক পর্যটক ছিনতাইকারী ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছেন। ইতঃপূর্বে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে প্রাণ গেছে এক পুলিশ সদস্যেরও।

এসব কারণে স্বাভাবিকভাবেই উদ্বেগ ও আতঙ্ক তৈরি হয়েছে পর্যটকদের মনে। তবে এরই মধ্যে কক্সবাজার অভিমুখে ঢল নেমেছে লাখো পর্যটকের। বছর শেষে স্বপরিবারে ঘুরে বেড়ানো, একই সাথে বেলাভূমিতে বছরের শেষ সূর্যাস্ত অবলোকন ও নতুন বছরকে স্বাগত জানানো। এসব কারণে ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত কক্সবাজারের হোটেল-মোটেলগুলোতে কোনো সিট খালি নেই। সংশ্লিষ্টরা থার্টি ফাস্ট নাইটকে কেন্দ্র করে ব্যাপক পর্যটকের আগমন প্রত্যাশা করলেও এখনই কিন্তু চলে এসেছেন কয়েক লাখ পর্যটক।

সৈকতের কলাতলী থেকে ডায়াবেটিস পয়েন্ট পর্যন্ত যতদূর দৃষ্টি যাবে শুধু পর্যটক আর পর্যটক। সকাল, বিকেল কিংবা দুপুর কোনো সময় বাদ দিচ্ছেন না পর্যটকেরা সমুদ্রে গোসল করা থেকে। এ ছাড়া বালুচরে সপরিবারে নিজকে উজাড় করা হই চই তো আছেই। কেউ মেরিন ড্রাইভ দিয়ে যাচ্ছেন হিমছড়ি ঝরনার দিকে, কেউ বা ইনানী। কেউ একেবারে পরীর দ্বীপ মানে শাহপরীর দ্বীপ। কেউ যাচ্ছেন পছন্দের জাহাজে করে সেন্টমার্টিন।

মোটকথা কক্সবাজারের সব পর্যটনস্পটে এখন পর্যটকের উপচেপড়া ভিড়। তবে পর্যটনের এই ভরা মওসুমে দেশের নানা জায়গা থেকে আসা মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন অনেকে। এক অজানা শঙ্কা নিয়েই ঘুরছেন সবাই। তবে টুরিস্ট পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো অত্যন্ত সতর্ক অবস্থায় রয়েছে যেন, আর কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে।

টুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার জোনের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার রায়হান কাজেমি সাংবাদিকদের বলেন, সৈকতের ডায়াবেটিস পয়েন্ট থেকে কলাতলী পর্যন্ত চার কিলোমিটারে টুরিস্ট পুলিশ ২৪ ঘণ্টা এবং মেরিন ড্রাাইভসহ ইনানী সৈকতে সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। এ ছাড়া সেন্টমার্টিন ভ্রমণের সময় পর্যটকদের সাথে থাকছে একদল টুরিস্ট পুলিশ। এ দিকে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকেও জেলার অন্যান্য পর্যটনস্পটগুলোতে পর্যটকদের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। হোটেল মালিকেরা জানান, গত বৃহস্পতিবার থেকে শনিবার পর্যন্ত কক্সবাজার ভ্রমণে এসেছেন অন্তত তিন লাখ পর্যটক। এর মধ্যে এক লাখ পর্যটক ফিরে গেলেও অবশিষ্ট দুই লাখ পর্যটককে সামাল দিতে টুরিস্ট পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। শনিবার সকালে সৈকতের সি ইন পয়েন্টে দেখা গেছে হাজার হাজার পর্যটক সাগরের ঢেউয়ের সাথে গা ভাসিয়ে আনন্দ উল্লাস করছেন। কেউ আবার জেডস্কি ও স্পিডবোটে চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সাগরের ঢেউয়ের তালে তালে।

কক্সবাজার ট্যুর অপারেটর সমিতির নেতা এস এম কিবরিয়া খান ও পিপলস ফোরাম সংগঠনের নজরুল ইসলাম বলেন, ১৫ ডিসেম্বর সমুদ্র সৈকতের পাশে জাম্বুর দোকান এলাকায় দিনদুপুরে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে নিহত হন ফেনীর আবু তাহের নামে এক পর্যটক। পুলিশ এখনো ঘটনায় জড়িত কাউকে আটক করতে পারেনি।

তাই শঙ্কাতো রয়েছেই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ কয়েকজন হোটেল ব্যবসায়ী বলেন, সমুদ্র সৈকতে নামার সি-ওয়ার্ল্ড সড়ক, সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের সামনে, জাম্বুর দোকান, কলাতলী মোড়, সৈকতের ঝাউবাগান এলাকা, হোটেল-মোটেল গেস্টহাউস এলাকা, বাইপাস সড়ক, বাস টার্মিনাল, বিজিবি ক্যাম্প ও সাবমেরিন কেবল ল্যান্ডিং স্টেশন এলাকায় দিন-রাত ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। ছিনতাইকারী চক্রের সাথে যুক্ত রয়েছে কিছু টমটম ও রিকশাচালক। পর্যটকেরা গাড়ি থেকে নামার সাথে সাথে তাদের রিকশা বা টমটকে উঠানো জন্য পর্যটকের লাগেজ ধরে রীতিমতো টানাটানি শুরু করে। এসব রিকশা ও টমটমে উঠলেই ঘটে যাচ্ছে নানা বিপদ। এসব ব্যবসায়ীদের মতে, কক্সবাজার ভ্রমণে আসা পর্যটকদের উচিত সর্তক থেকে নিজস্ব নিরপত্তার মধ্যে থাকা।

কক্সবাজার গেস্ট হাউস মালিক সমিতির নেতা শফিকুর রহমান বলেন, শহরের চার শতাধিক হোটেল-মোটেল গেস্ট হাউস, কটেজের কোথাও এখন কক্ষ খালি নেই। আগামী ২ জানুয়ারি পর্যন্ত অন্তত ১০ লাখ পর্যটকের আগমন ঘটতে পারে। ইতোমধ্যে বড়দিন ও থার্টি ফার্স্ট নাইটকে কেন্দ্র করে ৯০ শতাংশ হোটেলকক্ষ অগ্রিম বুকিং হয়ে গেছে। সব দিক বিবেচনা করে নিরাপত্তা আরো বাড়ানো দরকার। এ দিকে কক্সবাজারে এবার অবস্থান করছেন রেকর্ডসংখ্যক বিদেশী নাগরিক। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত এসব বিদেশী রাতযাপন করছেন কক্সবাজারের সায়মান বিচ রিসোর্ট, ওশান প্যারাডাইস, লং বিচ, সি-গাল, সি-পার্লসহ তারকা মানের হোটেলগুলোতে। এসব হোটেলে সহস্রাধিক বিদেশী নাগরিক রয়েছেন। বিদেশী নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য হোটেলের পক্ষ থেকেও বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

এ দিকে ব্যাপক দেশী-বিদেশী পর্যটকের কক্সবাজার আগমনের প্রেক্ষিতে অবিশ্বাস্যভাবে বেড়ে গেছে সব কিছুর দাম। খাদ্যদ্রব্য, হোটেল ভাড়া থেকে শুরু করে মাছ-মাংসের দামও। কোনো ঘোষণা ছাড়াই বিমান ভাড়াও বাড়ানো হয়েছে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া ভাড়ায় চালিত মাইক্রোবাসগুলো ইচ্ছেমতো আদায় করছে ভাড়া। পাঁচ হাজার টাকার ভাড়া নিচ্ছে আট হাজার টাকা। এসব নিয়ন্ত্রণের কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে জেলা প্রশাসক মো: আলী হোসেন জানান, হোটেলকক্ষ ভাড়া ও খাবারের দাম নিয়ন্ত্রণের জন্য চারটি ভ্রাম্যমাণ আদালত মাঠে নেমেছে।

প্রশাসনের পক্ষ থেকে পর্যটকদের নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করা হলেও দেশী-বিদেশী পর্যটকদের নিরাপত্তা নিয়ে ভাবিয়ে তুলেছে প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট সব মহলকে। কারণ, ব্যাপক রোহিঙ্গার আগমনের ফলে কক্সবাজারে আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখার পাশাপাশি অসংখ্য ভিভিআইপি, ভিআইপিদের আগমনের ফলে তাদের প্রটোকল ও নিরাপত্তা নিয়ে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। জনবল সঙ্কট নিয়ে এসব করতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ। উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের ২৩ জুলাই জাম্বুর দোকান এলাকায় জাকের হোসেন নামে এক পর্যটকের কাছ থেকে টাকা ও মোবাইল ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে একদল ছিনতাইকারী। এ সময় সাদা পোশাকে দায়িত্বরত কক্সবাজার টুরিস্ট পুলিশের কনস্টেবল পারভেজ হোসেন পর্যটককে উদ্ধারে এগিয়ে গেলে ছিনতাইকারীরা পেছন থেকে তাকে ছুরিকাঘাত করে। পরে হাসপাতালে নেয়ার পথে এই পুলিশ কনস্টেবল মারা যান।

Exit mobile version