ইতালি ২৪টি দেশ থেকে ১৩ হাজার মওসুমি শ্রমিক নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেও সে তালিকা থেকে বাদ পড়েছে বাংলাদেশ। এ বছরও ইতালির শ্রম মন্ত্রণালয়ে কালো তালিকাভুক্ত বাংলাদেশ। ২০০৮ থেকে ২০১২ পর্যন্ত চার বছরে ১৮ হাজার বাংলাদেশী শ্রমিক ইতালি গিয়ে আর ফিরে আসেননি। এ জন্য ২০১৩ সাল থেকে বাংলাদেশী শ্রমিক নিয়োগ নিষিদ্ধ করেছে ইতালির শ্রম মন্ত্রণালয়। গত ২৭ এপ্রিল ‘দেকরেতো ফোসি ২০১৫’ বা মওসুমি শ্রমিক নিয়োগের গেজেট প্রকাশ করেছে ইতালির শ্রম মন্ত্রণালয়। ওয়েবসাইটে ২৪টি দেশের শ্রমিক নিয়োগের বিবরণ দেয়া আছে।
দালালচক্র এখনো সক্রিয় : ইতালিতে বাংলাদেশী শ্রমিক নিয়োগ নিষিদ্ধ হওয়ার পরও দালালচক্র সম্পূর্ণ উল্টো প্রচারণা চালাচ্ছে। ‘ইতালিতে বাংলাদেশীদের ওয়ার্ক পারমিট দেয়া হচ্ছে’ এ ধরনের অপপ্রচারে অভিবাসী বাংলাদেশীরা সাবধান করে দিয়েছে ফাঁদে পড়ে যেন কেউ দালালদের টাকা-পয়সা না দেয়, ইতালি আসার চেষ্টা না করে সে জন্য সবাইকে সতর্ক করছে।
যেসব দেশের শ্রমিক নেয়া হবে : এশিয়ার ছয় দেশ- জাপান, উত্তর কোরিয়া, ফিলিপাইন, ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা। বাংলাদেশ থেকে কোনো শ্রমিক নেয়া হবে না। ইউরোপের আটটি দেশ- বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, সার্বিয়া, কসোভো, ইউক্রেন, মরিশাস, মালদোভিয়া, মোন্টিনেগ্রো ও মেসিডোনিয়া। আফ্রিকার ১০টি দেশ- আলজেরিয়া, আলবেনিয়া, ঘানা, গাম্বিয়া, মরোক্কো, মিসর, নাইজার, নাইজেরিয়া, সেনেগাল ও তিউনিসিয়া।
কোন মহাদেশের কোন দেশ থেকে কত শ্রমিক নেয়া হবে তা শ্রম মন্ত্রণালয়ের গেজেটে স্পষ্ট সংখ্যা উল্লেখ করা আছে। মওসুমি শ্রমিক ছাড়া ইতালিতে সব ধরনের শ্রমিক নেয়া বন্ধ আছে। এসব শ্রমিক গ্রীষ্মকালের ৯ মাস কাজ করতে পারবেন, তারপর তাদের নিজ দেশে ফিরে যেতে হবে।
কৃষি খামারে নানা রকম কাজ, ফল বাগানে, আঙুর, ব্ল্যাকবেরি, জলপাই, লেবু, কমলালেবু আহরণ, ফুলবাগানে কাজ, পরিচর্যা ও ফুল তোলা, গম, ভুট্টা মাড়াই, হাল চাষ, সবজি আহরণ ও প্যাকেজিং, ঘাস কাটা, গরু ও শূকরের খামারের কাজ, কসাইখানার কাজ, সবজি, কৃষিপণ্য, ফল, লোড-আনলোড করার কাজ করবেন এসব মওসুমি শ্রমিক।
কালো তালিকায় বাংলাদেশ : ইতালির রাজধানী রোমে বসবাসরত বাংলাদেশী অভিবাসী আব্দুস সালাম জানান, কৃষিকাজের জন্য গ্রীষ্মকালে ৯ মাসের ওয়ার্কপারমিট ও ভিসা দেয়া হয়। কাজ শেষে শ্রমিকদের আবার নিজ দেশে ফেরত যেতে হয়। যেসব শ্রমিকের কাজের দতা ও সুনাম হয় তারা পরের বছর আবারো ইতালিতে কাজ করার ভিসা ও ওয়ার্কপারমিট পান। তবে কোনো শ্রমিক নিজে আবেদন করতে পারেন না। ইতালির নাগরিক অথবা বৈধ অভিবাসী, খামারি, কৃষি কারখানার মালিক শ্রম দফতরের শর্ত মেনে বিদেশী শ্রমিকের জন্য আবেদন করেন। এ বছরও শ্রম মন্ত্রণালয় ৮ মে থেকে ৩১ মে ইতালির সময় বিকেল ৫টা পর্যন্ত তালিকাভুক্ত ২৪টি দেশের শ্রমিকদের পে আবেদন করতে বলেছে। (এ বছর বাংলাদেশী শ্রমিকদের জন্য কেউ আবেদন করতে পারবে না)। ইতালিতে প্রবেশের আট দিনের মধ্যে পুলিশের কাছে রিপোর্ট ও শ্রম মন্ত্রণালয়ে নিবন্ধন করতে হয় শ্রমিকদের। শ্রমিকেরা যে ইনকাম করেন তার ট্যাক্স দিতে হয় ইতালির সরকারকে। ভালো কাজ ও ওভার টাইম করতে পারলে ৯ মাসে ট্যাক্স, খাবার, বাসা ভাড়া বাদে ৬ থেকে ৮ লাখ টাকা আয় হয় প্রত্যেকের।
১৮ হাজার বাংলাদেশী ইতালি গেছেন, ফিরেছেন ৫১ : ইতালি ২০০৮ সাল থেকে বেশি সংখ্যক মওসুমি শ্রমিক আমদানি শুরু করে। সে সময় পৃথিবীর অন্য দেশের মতো বাংলাদেশী শ্রমিকদের ৬ হাজারের কোটা ছিল। ২০১২ সাল পর্যন্ত ১৮ হাজার বাংলাদেশী শ্রমিক ইতালি যান। এর মধ্যে গত তিন বছরে চুক্তিমাফিক মাত্র ৫১ জন দেশে ফিরেছেন। বাকি সবাই ইতালি ছাড়াও ইউরোপের অন্য দেশ গ্রিস, জার্মানি ও ফ্রান্সে পালিয়ে গেছেন। এসব শ্রমিকের ৯৫ শতাংশ ইতালি সরকারকে কোনো ট্যাক্স দেয়নি।
এ ১৮ হাজার বাংলাদেশী ইতালি সরকারের তালিকায় এখন অবৈধ। তারা পালিয়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে থাকেন। কারখানা বা গার্মেন্টে অবৈধ শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন। কসাইখানা, শূকরের খামারে কাজ করেন। কোনো কোনো শ্রমিক অবৈধ ফেরিওয়ালা হিসেবে ফুল, ছাতা, খেলনা, পপকর্ণ বিক্রি করেন। পুলিশের হাতে ধরা পড়লে পাহাড় বা জঙ্গলে নামিয়ে দিয়ে আসে। ইতালির মিলান সিটির অভিবাসী আলিম মিয়া এসব তথ্য এ প্রতিবেদককে জানান।
দুর্বিষহ জীবন : মিলান সিটি থেকে ১২০ মাইল দূরে ছোট্ট একটি শহরে থাকেন অবৈধ শ্রমিক (ছদ্মনাম আবুল মিয়া) জানান, তিনি এই শহরের অবৈধ ফেরিওয়ালা। ঢাকার বিক্রমপুরে তার ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান ছিল দালালের খপ্পরে পড়ে ২০১০ সালে ১৮ লাখ টাকায় ইতালি আসেন। ভালো কোনো কাজ না পাওয়ায়, আয় ইনকাম ভালো না হওয়ায় ইতালি থেকে ফিরে আসেননি। দালালচক্র বলেছিল, পাঁচ তারকা হোটেলে চাকরি দেবে। ইতালি এসে তাকে শূকরের খামারে কাজ দেয়া হয়। সেখান থেকে পালিয়ে অন্য শহরে গিয়ে ফেরিওয়ালা হয়েছেন। কিছু দিন ভিাও করেছেন। দেশে ফিরে যেতে পারছেন না। দেশে ফিরে আর কী করবেন। দোকান-পুঁজি সব শেষ করে ইতালি এসেছেন সোনার হরিণের আশায়। এর মধ্যে বাবা তার শোকে মারা গেছেন, বউ ছোট মেয়েকে রেখে চলে গেছেন। তিনি বলেছেন, দালালের ফাঁদে পড়ে ইতালি বা ইউরোপের কোনো দেশে যেন কেউ না আসে। দেশে শান্তিতে ছিলাম সব ছিল। এ জীবন কখনো কল্পনাও করিনি। এমন লোভে যেন কেউ না পড়ে। দুর্বিষহ জীবন এখন আমার। দেশে ফিরে আর কী হবে। কান্নায় ভেঙে পড়ে আবুল মিয়া ফোন ছেড়ে দেন।
বাংলাদেশ মিশনের অসহযোগিতা : ভারত ও শ্রীলঙ্কার প্রায় সাত হাজার শ্রমিক মওসুমি ভিসায় গিয়ে ইতালিতে অবৈধ হয়ে আছেন। শ্রীলঙ্কা ও ভারতের শ্রম মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা ইতালি সরকারের সাথে দেনদরবার করে মওসুমি ভিসায় ইতালি যাওয়ার সুযোগ করে নিয়েছেন। ভারত, পাকিস্তানি, শ্রীলঙ্কান ও আফগানরা তাদের দেশের অবৈধদের শেল্টার দেন। নিজেরা টাকা খরচ করে মামলা মোকদ্দমা করে বৈধ করে নেন। বাংলাদেশীরা নিজ দেশের লোকজনদের সহযোগিতা করেন কম। বাংলাদেশ মিশনের অসযোগিতার কারণে কালো তালিকাভুক্ত হয়েছেন মওসুমি শ্রমিকেরা। তারা দেশে ফিরছেন না, নতুন শ্রমিকদের জন্য ইতালির দ্বার খুলছে না বলেছেন ইতালির অভিবাসী আইনুল হক।
আশার আলো : ইতালির অর্থনীতি মন্দা কাটিয়ে উঠছে। নাগরিক ও অভিবাসীসহ প্রায় দুই লাখ বেকার শ্রমিকের কর্মসংস্থান হয়েছে এ বছর। ১৮ হাজারের মধ্যে ১০ হাজার অবৈধ বাংলাদেশী দেশে ফেরত গেলে দেশের শ্রম মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তারা ইতালির শ্রম মন্ত্রণালয়ের সাথে সফল বৈঠক করতে পারলে বাংলাদেশীদের জন্য মওসুমে কাজের দরজা আবারো খুলে যেত। এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন রোমের অভিবাসী হাসান আলী, আবু বকর, জলিল মিয়া, রায়হান আলী ও আব্বাস মিয়া। তারা এ বিষয়ে সরকারকে দ্রুত পদপে নিতে অনুরোধ করেছেন।