চলে গেলেন ভাস্কর নভেরা আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর শোক

33

একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাস্কর নভেরা আহমেদ আর নেই। তিনি মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় ফ্রান্সের প্যারিসে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর।
বুধবার রাতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে। তার মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
নভেরা আহমেদ ১৯৩০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। বাংলাদেশের ভাস্কর্য শিল্পের অন্যতম অগ্রদূত ছিলেন তিনি। নভেরা আহমেদ ভাস্কর হামিদুর রহমানের সাথে জাতীয় শহীদ মিনারের প্রাথমিক নকশা প্রণয়ন করেছিলন। দীর্ঘদিন পর ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি থেকে প্যারিসে তার রেট্রোসপেকটিভ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৯৭-এ বাংলাদেশ সরকার তাকে একুশে পদক-এ ভূষিত করে।
তার বাবা সৈয়দ আহমেদ কর্মরত ছিলেন সুন্দরবন অঞ্চলে। সেই সূত্রে নভেরার জন্ম সুন্দরবনে। চাচা আদর করে নাম রাখেন নভেরা। এ ফার্সি শব্দটির অর্থ নবাগত, নতুন জন্ম। পৈতৃক নিবাস চট্টগ্রামের আসকারদিঘির উত্তর পাড়া। চাকরি সূত্রে পিতা সাইদ আহমেদ পরবর্তীতে কলকাতায় ছিলেন। নভেরার শৈশব কেটেছে কলকাতায়। কলকাতার লরেটা থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন তিনি। স্কুল জীবনেই তিনি ভাস্কর্য গড়তেন।
১৯৪৭-এ ব্রিটিশ শাসনাধীন ভারত ভাগ হয়ে যাওযার পর তারা পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) কুমিল্লায় চলে আসেন। এ সময় নভেরা কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হন। পিতার অবসরের পর তারা সবাই আদি নিবাস চট্টগ্রামে গিয়ে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। চট্টগ্রাম কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন নভেরা।
১৯৫০ সালে তিনি লন্ডনে যান । লন্ডনে তখন তার মেঝ বোন শরীফা আলম বিবিসির একটি অনুষ্ঠান পরিচালনা করতেন। তখন বিবিসির বাংলা বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন নাজির আহমেদ। নাজির আহমেদের ছোট ভাই হামিদুর রাহমান তখন ঢাকা আর্টস কলেজে পড়েন। কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্রদের একজন তিনি। তার সহপাঠী ছিলেন আমিনুল ইসলাম।
হামিদ যখন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, তখন নাজির আহমেদ তাকে নিয়ে গিয়ে প্যারিসের বোজ আর্টস স্কুলে ভর্তি করে দিলেন। কিন্তু হামিদ প্যারিসে থাকতে পারেননি, তিনি লন্ডনে ফিরে ভাইয়ের ফ্ল্যাটেই উঠলেন। আর তখনই নভেরার সঙ্গে পরিচয় হামিদের। লন্ডনে হামিদ সেন্ট্রাল স্কুল অব আর্টে ভর্তি হলেন। এখানে ভর্তি হবার জন্য আর্টের ওপর প্রাথমিক কিছু জ্ঞানের প্রয়োজন হতো।
নভেরা ১৯৫১ সালে ক্যাম্বারওয়েল স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফ্টসের ন্যাশনাল ডিপ্লোমা ইন ডিজাইনের মডেলিং ও স্কাল্পচার কোর্সে ভর্তি হন। এখানে ভর্তি হতে শিল্পকলা বিষয়ে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানের প্রয়োজন ছিল না। ১৯৫১-৫২ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ন্যাশনাল ডিপ্লোমা ইন ডিজাইন প্রথম প্রবর্তিত হয়। এ সম্পর্কে প্রসপেক্টাসে বলা ছিল, ‘শিল্পকলার শিক্ষকদের জন্য এটি একটি স্বীকৃত যোগ্যতা হবে।’ কোর্সটি চার বছরের প্রথম দুবছর পর ইন্টারমিডিয়েটে পরীক্ষা, পরবর্তী দুবছর পর ডিপ্লোমার জন্য ফাইনাল পরীক্ষা। নভেরা ১৯৫৫ সালে কোর্স শেষ করে ডিপ্লোমা পেলেন।
ক্যাম্বারওয়েলে স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফ্টসে ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত ভাস্কর্য বিভাগের অধ্যক্ষ ছিলেন ডক্টর ক্যারেল ভোগেল।
১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে নভেরা আহমেদ ও হামিদুর রহমান একসঙ্গে ফ্লোরেন্সে যান। প্রথমে তারা শিল্পী আমিনুল ইসলামের আতিথ্য গ্রহণ করেন এবং পরে তিনজন একত্রে একটি স্টুডিওতে উঠে যান। নভেরা মাস দুয়েক শুধু ঘুরে দেখলেন। ডক্টর ফোগেল ভেন্তুরিনো ভেন্তুরির নামে এক ইতালীয় শিল্পীর কাছে নভেরার নাম উল্লেখ করে একটি চিঠি দিয়ে দিয়েছিলেন। এই শিল্পীর সাহচর্যে নভেরা দোনাতেলোসহ প্রাচীন কয়েকজন শিল্পীর কাজের সঙ্গে পরিচিত হন এবং দুই মাস তার কাছে কাজ শেখেন। এরপর ফ্লোরেন্স থেকে ভেনিসে যানন নভেরা ও হামিদ এবং সেখান থেকে লন্ডন। ১৯৫৪ সালের ক্রিসমাসের ছুটিতে নভেরা ও হামিদ প্যারিসে রঁদার মিউজিয়াম দেখতে গিয়েছিলেন। ভাস্কর্যের ছাত্রী স্বভাবতই অত্যন্ত অভিভূত হয়েছিলেন রঁদার কাজ দেখে।