আমরা এখনও জানি না তিনি কী অপরাধ করেছিলেন? আমেরিকানরা বলেছে, তিনি এখনও বেঁচে আছেন কিন্তু কোন দেশে আছেন, কোথায় আছেন তা আমরা জানি না। আমরা মনে করি তিনি ফেডারেল মেডিকেল সেন্টারের কার্সওলে আছেন, যেটি ভয়াবহ নির্যাতন সেন্টার হিসেবে পরিচিত। হ্যাঁ আমরা বলছি ড. আফিয়া সিদ্দিকীর কথা।
তার বোন ডাক্তার ফাওজিয়া সিদ্দিকী বলেন, একজন আইনজীবি তার সাথে দেখা করার চেষ্টা করেছিলেন। তারা জানায়, আফিয়া তার সাথে দেখা করবেন না। তিনি কারো সাথে দেখা করার জন্য রাজি হননি। তিনি কারো সাথে জানাতে চায় না যে অতীতের ৪ বছরে তার সাথে কী হয়েছিল। তারাও কাউকে দেখা করার অনুমতিও দেয়নি। যেটা আমাদের মনে ভয়ের তৈরি করছে। তারা কী তাকে শারীরিকভাবে ধ্বংস করেছে? নাকি তারা মানসিক নির্যাতন করেছে?
আমরা সত্যিকার অর্থে জানি না তিনি বেঁচে আছেন কি-না? নাকি মৃত্যুর মতো বেঁচে আছেন? সত্যিকার অর্থে আমরা কিছুই জানি না।
তার মুক্তির দাবিতে অনেক অন্দোলন হয়, তারা বলে আফিয়া নির্দোষ, তাকে আমরা ফেরত চাই। যতদিন তার মুক্তি না দেওয়া হবে ততদিন আমরা ঘরে ফিরে যাব না।
তার বড় বোন বলেন, আমি পেশায় একজন স্নায়ু বিশেষজ্ঞ। কিন্তু জনসাধারণ আমাকে চেনে শুধু ডা. আফিয়া সিদ্দিকীর বোন হিসেবে।
ডাক্তার আফিয়া সিদ্দিকী ছিলেন পাকিস্তানের নিউরোলজিস্ট বা স্নায়ু বিজ্ঞানী। তিনি লেখাপড়া করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে। ১৯৯৫ সালে ম্যাসাচুয়েটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) থেকে তিনি স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ২০০১ সালে ব্রানডিস ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। এর কিছুদিন পরেই তিনি পাকিস্তানে ফিরে আসেন।
যুক্তরাষ্ট্রের নাইন ইলেভেন হামলায় রহস্যজনকভাবে ডাক্তার অফিয়া সিদ্দিকীকে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়। তিনি পাকিস্তানে কন্যা হওয়ার কারণেই এ সন্দেহের তালিকায় আনা হয়। আবার আমেরিকানরা কেউ কেউ বলেন- তিনি লেডি আল কায়দা। সেই সাথে তাকে আরো অনেক অপরাধের সাথে সামিল করে আমেরিকার আদালত। এরপর তাকে ৮৬ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে টেক্সাসের কারাগার ফেডারেল মেডিকেল সেন্টারে পাঠানো হয়।
তার বোন ফাওজিয়া সিদ্দিকী বলেন, ১৮ বছর হলো আফিয়া কিডন্যাপ হয়েছে। আফিয়া কারাবন্দী রয়েছেন। তারা তাকে ভয়াবহ উপায়ে নির্যাতন করে চলছে। পাকিস্তানি এজেন্সির মাধ্যমে কিডন্যাপ করা হয়েছে। এরপর তারা আমেরিকার এজেন্সির কাছে তুলে দেয়।
আফিয়া লেখাপড়া শেষ করে ২০০২ সালে পাকিস্তানে ফিরেছিলেন। তিনি তার তিন সন্তানসহ ইসলামাবাদে ছিলেন। তার সন্তান আহমেদের বয়স ছিল ৫ বছর, মরিয়মের ৩ বছর এবং সুলেমানের মাত্র ৬ মাস।
তিনি তার শিক্ষা ব্যবস্থাকে ইসলামাবাদে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ব্যবস্থা নিচ্ছেলেন, যাতে পাকিস্তানেও নিউরোলোজিস্ট তৈরি হতে পারে।
তখনই তিনি ৫ বছরের জন্য অপহৃত হয়েছিলেন। তখন কেউ জানত না কী হয়েছে তার সাথে।
২০০৩ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত আফিয়া গোপন কোনো স্থানে বন্দী ছিলেন। যেখানে তাকে শারীরিক নির্যাতন এবং ধর্ষণ করা হয়। আমেরিকান এজেন্টরা তার সাথে এ আচরণ করেছে। যার তথ্য পাওয়া যায় তার নিজের হাতে লেখা একটি চিঠি থেকে। যখন তিনি যৌনমিলনে রাজি না হতেন, তাকে অত্যাচার করা হতো এবং তার সন্তানদের হত্যা করার হুমকি দিত। এমনকি বন্ধী ড্রাগ দিয়েও তাকে ধর্ষণ করা হতো। তাদের হাতে এ ধরনের শারীরিক অত্যাচার সহ্য করতে করতে তিনি পুরোপুরি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।
২০০৮ সালে বৃটিশ সাংবাদিক ইয়াবোনি রিডলি আফগানিস্তানে যান। সেখানে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করেন যে একজন পাকিস্তানি নারী বাগরামে বন্ধি রয়েছেন। যার নম্বর ৬৫০।
তিনি বলেন, আমেরিকানরা জানিয়েছে এখানে কোনো মহিলা নেই। তারা পুরোপুরি মহিলাবন্দীর কথা অস্বীকার করেন। কিন্তু আমি তাদের কথায় সম্মতি দিতে পারিনি। কারণ সেখানের অনেক মানুষ এ ব্যাপারে আমাকে বলেছেন। তারা তাকে দেখেছেন এবং তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
কারাগারে বন্দী থাকা মোয়াজ্জেম বেগ বলেন, আমি যখন সেখানে বন্দি ছিলাম তখন আমি জিজ্ঞাসাবাদের কক্ষ থেকে মহিলাদের চিৎকারের শব্দ শুনেছি।
যখন ইয়াবোনি রিডলি এই নিয়ে গবেষণা শুরু করেন- তখন আফিয়া সিদ্দিকীকে খুঁজে পান। তখন তিনি পাকিস্তান গিয়ে এ তথ্য জানান এবং পাকিস্তানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান আফিয়াকে মুক্তির দাবি তোলেন। দুর্ভাগ্যবশত ১৮ বছর হতে চললো কিন্তু এখনও আফিয়া মুক্তি পাননি। তিনি এখনও কারাগারে।
এফবিআই একটি রিপোর্ট বের করে যে, আফিয়ার সাথে আল কায়দার যোগসাজশ রয়েছে। তারা পাকিস্তানি জঙ্গি খালিদ শেখ মাহমুদকে গ্রেফতার করে এবং অত্যাচারের মুখে আফিয়ার বিষয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করে। যিনি ছিলেন নাইন ইলেভেন হামলার মূল আসামি।
বলা হয়, আফিয়া ছিলেন আলকায়দার অর্থ যোগানদাতা এবং সংবাদদাতা। এফবিআই দাবি করে তারা খালিদ মাহমুদ শেখের মুখে আফিয়ার নাম বলতে শুনেছে। অথচ অসল ঘটনা হচ্ছে, যখন খালিদ মাহমুদকে ২৭ বার পানিতে ডুবিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছিল, তখন তিনি পড়ছিলেন, আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকাল আফিয়া। এটি ছিল একটি ছোট দোয়া এবং যেখানে শান্তি চাওয়া হয়েছে। যে দোয়া প্রার্থনার জন্য পড়া হয়েছিল, সেখানে আফিয়া নাম ব্যবহার করে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয় ডাক্তার আফিয়াকে। এ সবই ছিল- মিথ্যা এবং আমেরিকানদের তৈরি করা।
তারা দাবি করে যে আফিয়া অন্য কাউকে বিয়ে করেছে। যেদিন তাকে অপহরণ করা হয়েছিল সেদিন তিনি কিভাবে বিয়ে করলেন? তার প্রথম স্বামীর ডিভোর্স থেকে ইদ্দতের শেষ দিন ছিল কিডন্যাপের আগের দিন। আফিয়ার বোন বলেন, এ ব্যপারে তারা কোনো চূড়ান্ত প্রমাণ দিতে পারেনি। কিডন্যাপের পর কোথাও দেখা গেছে- এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
ইয়াবেনি রিডলি তাকে উদ্ধারের ব্যাপারে বলেন, আমি দ্রুতই আফগানিস্তানে ফিরে যাই। সেখানে জানতে পারি- তাকে পাওয়া গেছে। তাকে মেরে ফেলা হবে।
তাকে ফিরে পাওয়ার বিষয়ে তার বড় বোন বলেন, ২০০৮ সালে আমরা তাঁকে খুজে পাই। তারা তাকে টেকনিকালি মুক্তি দিয়েছিল। সেখান থেকে একটি খবর প্রচারিত হয় যে, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর কাছে ধরা পড়েছেন। বলা হয় তিনি একজন গভর্নরের বাড়িতে ছিলেন। সেখান থেকে বলা হয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী তাকে ৩টি গুলি করে। তারা মনে করেছিল যে তিনি মারা গেছেন। কিন্তু তারা তাকে জীবিত পেয়েছেন এবং এখনও জীবিত আছেন। তাকে বাগরামে নিয়ে চিকিৎসা করালে আবারও তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন।
তখনও আফিয়াকে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের হাতেই রাখে। এরপর তাকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। বিচারক জানিয়ে দেন যে, এটা সম্পূর্ণ অবৈধ। তিনি একজন পাকিস্তানি নারী। কিভাবে পাকিস্তানি নারীকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দেন কোন ধরনের চুক্তি ছাড়াই? এ কেসের বিষয়টি সম্পূর্ণ পরিষ্কার। তাকে ফেরত দেওয়া প্রয়োজন ।
আফিয়ার আইনজীবী এলিজাবেথ ফিংক বলেন, তিনি একজন মানসিক ও শারীরিকভাবে ভয়াবহ আঘাতপ্রাপ্ত মানুষ। তার মানবাধিকার কমিশনের সাহায্য পাওয়া প্রয়োজন। তাকে খুব দ্রুতই কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া উচিৎ। খুব দ্রুতই চিকিৎসার প্রয়োজন। তার প্রয়োজন মায়ের কাছে থাকা। অন্যান্যদের কাছ থেকেও তার সাহায্যের প্রয়োজন। কিন্তু তিনি তা পাচ্ছেন না।
এরপর দ্বিতীয় বিচারক রিচার্ড ব্রমনের কাছে গেলে এবং নতুন সরকারি আইনজীবী প্রিত বাহারা এ কেসটি আবারও শুরু করেন। সেখানে তারা আফিয়াকে ৮৬ বছরের কারাদণ্ড দেয়।
সেখানে প্রিত বাহারা বলেন, সর্বসম্মতভাবে তার ওপর অভিযোগগুলো সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয়েছে। সাথে আরও অন্তর্ভুক্ত করেন যে, তিনি আফগানিস্তানে আমেরিকানদের মারার চেষ্টা করেছেন। এমনকি তার সঙ্গে থাকা আফগান কলিগকেও মারতে চেয়েছিলেন। তিনি বর্তমানে ভয়াবহতার চরম পর্যায়ে রয়েছেন।
এ বিষয়ে তার আইনজীবী হোয়াইটেলফিল সার্প বলেন, আপনারা দেখেছেন তাকে যে খুবই অসুস্থ এবং শীর্ণকায়। নিজেকে প্রশ্ন করুন এসব করা কী তার পক্ষে সম্ভব। তিনি কিভাবে অস্ত্র নিয়ে ৫/৬ জন সেনা সদস্যের সামনে দাঁড়িয়ে লড়াই করেন? তিনি কিভাবে তাদের সামনে দাঁড়িয়ে গুলি করেন? আপনারা কি পারবেন এর উত্তর দিতে? অবশ্যই পারবেন না।
এ রায়ের পর সাংবাদিক ইয়াবোনি রিডলি বলেন, ফৌজদারি তদন্তে আজকাল আমরা অনেক বিজ্ঞানের ওপর নির্ভর করি। সেখানে আমেরিকার সেনাদের মতে- আফিয়া তাদের গুলি করেছে। এরপর তারা তার বন্দুক ছিনিয়ে নিয়ে গুলি করেছে। কিন্তু বন্ধুকের গুলির অবশিষ্ট অংশ আফিয়ার কাছাকাছি পাওয়া যায়নি। তাহলে আমরা কিভাবে বলতে পারি যে, আফিয়া কোনো গুলি করেছিল?
আফিয়া মার্কিন সামরিক কর্মীদের হত্যার চেষ্টার জন্য দোষী সাব্যস্ত হন এবং তাকে ৮৬ বছরের জন্য কারাগারে পাঠানো হয়।
কোর্টে সরকারি আইনজীবী আফিয়ার নিজের হাতের লেখা একটি নোট বের করেন, যেখানে বলা হয় যে, সেখানে বোমা তৈরিতে যে সকল উপাদান দরকার সে সম্পর্কে লেখা আছে এবং নিউইয়র্কে হামলার ছক কষা আছে। তিনি আরও বলেন যে, আফিয়ার সাথে সোডিয়াম সায়ানেট পাওয়া গেছে, যাতে সে আত্মহত্যা করতে পারে।
যদি এটি সত্যি হতো তাহলে ব্যাগ থেকে এগুলো বের করার আগেই সোডিয়াম সায়ানেট খাওয়া তার জন্য সহজ ছিল। তিনি পারতেন সেটি করে পৃথিবীকে স্তম্ভিত করে দিতে।
যদিও বিচারক রিচার্ড ব্রমন তাকে জঙ্গিবাদের জন্য সাজা শোনাননি, কারণ এর কোনো কিছুই সত্য ছিল না।
লাখ লাখ মানুষ আফিয়ার জন্য আন্দোলন করেছিলেন। প্রত্যেকেই আফিয়ার মুক্তির দাবিতে অবরোধ করে রেখেছিলেন। কিন্তু আফিয়া শাস্তির পাওয়ার পরে সকলকে আন্দোলন করতে নিষেধ করে বলেছিলেন, আমি চাই না আমার নাম কোনো সংঘাতের সাথে জড়িত হোক।
সর্বশেষে বলেছিলেন, আমি কোনো রক্তপাত চাই না। আমি চাই না এটা নিয়ে কারো মধ্যে সম্পর্ক খারাপ হোক। আমি সত্যিকার অর্থেই শান্তি চাই। আর এ যুদ্ধ এখানেই শেষ হোক।
অনেকের কাছে আমেরিকা জঙ্গি দমনের নামে যে সন্ত্রাসবাদ চালিয়েছে, তার প্রতীক হয়ে রয়েছেন আফিয়া সিদ্দিকী। অনেকেই আফিয়ার এই পরিস্থিতির জন্য পাকিস্তানের হাত রয়েছে বলে সমালোচনা করেছেন। অনেকই সমালোচনা করে বলেছেন, পাকিস্তান তার মাকে হত্যা করেছে।
ড. আফিয়া সিদ্দিকী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন স্নায়ুবিজ্ঞানী। অসামান্য ধীসম্পন্ন পিএইচডিধারী এ মহিলার সম্মানসূচক ডিগ্রি ও সার্টিফিকেট রয়েছে প্রায় ১৪৪টি। যুক্তরাষ্ট্রের ব্রন্ডেইস বিশ্ববিদ্যালয় ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেছে। তিনি হাফিজে কুরআন ও আলিমা।
পবিত্র কুরআন ও হাদিসে পারদর্শিনী এ নারী ব্যক্তিগত জীবনে অত্যন্ত দ্বীনদার। ইসলামী আদর্শ, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি রয়েছে তার দৃঢ় অঙ্গীকার।
মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায়, আলকায়েদার সাথে যোগাযোগ থাকার কথিত অভিযোগে ২০০৩ সালে ড. আফিয়াকে তার তিন সন্তান আহমদ, সুলায়মান ও মরিয়মসহ করাচির রাজপথ থেকে অপহরণ করে।
পাকিস্তানের কোনো কারাগারে না রেখে এবং পাকিস্তানি আদালতে উপস্থাপন না করে তাকে আফগানিস্তানের কুখ্যাত বাগরাম সামরিক ঘাঁটিতে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। এরপর চলে তার ওপর অমানুষিক শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতন।