আল কায়েদা সংগঠনটির নাম আমরা সবাই জানি। ওসামা বিন লাদেন এ সংগঠনের প্রতিষ্ঠা করেন। নাইন ইলেভেন তথা আমেরিকার টুইন টাওয়ারে হামলার পরে সংগঠনটি পৃথিবীব্যাপী আলোচিত সমালোচিত হয়।
টুইন টাওয়ার হামলায় প্রায় ৩০০০ মানুষের মৃত্যু হয়। এরপরই ওসামা বিন লাদেন পৃথিবীর মোস্ট ওয়ান্টেড ব্যক্তিতে পরিণত হন। আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ ক্ষিপ্ত হন। তিনি বলেন- আমরা এর বিচার চাই। এই ব্যক্তিকে জীবিত অথবা মৃত্যু যেকোনোভাবে খুঁজে বের করতেই হবে।
যুক্তরাষ্ট্র তাকে ১০ বছর ধরে খোঁজার পর ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করতে সক্ষম হয়। কিন্তু বর্তমানেও এ সংগঠনটি পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে আছে। আল কায়েদা এখনও বিশ্বব্যাপী একটি শক্তিশালী সংগঠন।
নাইন ইলেভেন হামলার ২০ বছর হয়েছে। এ বিশ বছরে আল কায়েদার মধ্যেও পরিবর্তন এসেছে। এখন
প্রশ্ন হলো- আল কায়েদা কারা?
আল কায়েদার লক্ষ্য কী বা তারা কী চায়?
আফগানিস্তানে আবার তালেবানরা ক্ষমতায় এসেছে। তাহলে কি আল কায়েদারও নতুন করে উত্থান ঘটবে? এসব বিষয়ে জানব আজকের লেখায়।
আল কায়েদার প্রতিষ্ঠা
১৯৮০ সালের শেষের দিকেই আল কায়েদার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ৯/১১ এর টুইন টাওয়ার হামলার আগে থেকেই তাদের দিকে নজর রেখেছিল। কারণ তারা এর আগেও অনেক হামলার সাথে জড়িত ছিল। এর মধ্যে রয়েছে- ১৯৯২ সালে ইয়েমেনে আমেরিকান একটি হোটেলে বোমা হামলা, ১৯৯৩ সালে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে বোমা হামলা, তানজানিয়া ও কেনিয়ায় আমেরিকান অ্যাম্বাসিতে ১৯৯৮ সালে হামলা, ২০০০ সালে আমেরিকার একটি নেভি জাহাজে বোমা হামলা চালিয়ে ধংস করা ইত্যাদি। তাহলে ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছেন যে, আল কায়েদার মূল টার্গেট কী ছিল?
ওসামা বিন লাদেনের পরিচয়
এরপর অবশ্যই জানা উচিৎ লাদেনের পরিচয়।
ওসামা বিন লাদেন সৌদি আরবে জন্মগ্রহণ করেছেন। তিনি একটি ধনী পরিবারে জন্ম নেন। মধ্যপ্রাচ্যে তাদের আছে বড় কনস্ট্রাকশন কোম্পানি আছে। ১৯৮০ সালে বিন লাদেন আফগানিস্তানে গিয়ে সেখানে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যুক্ত হন। সেখানে তিনি নিজেকে একজন নিষ্ঠাবান মুসলিম হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। যার দায়িত্ব ছিল বিদেশি শক্তির থেকে অন্য মুসলমানদের রক্ষা করা।
১৯৮০ সালের শেষের দিকে তিনি আল কায়েদা প্রতিষ্ঠা করেন। যোদ্ধাদের তৈরি করতে নিজেই অর্থ ব্যয় করেন। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত বাহিনী আফগানিস্তান থেকে সেনাবাহিনী ফিরিয়ে নেয়। এরপর বিন লাদেন তার লক্ষ্য পরিবর্তন করেন।
টার্গেট যুক্তরাষ্ট্র
প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের প্রভাবে, লাদেনের টার্গেটে পরিণত হয় যুক্তরাষ্ট্র। এ যুদ্ধে ইরাক কুয়েতকে আক্রমণ করেছিল। তখন যুক্তরাষ্ট্র কুয়েতের পক্ষ নেয়, যার সূত্র ধরে যুক্তরাষ্ট্রের কয়েক হাজার সেনা সৌদি আরবে অবস্থান নেয়। তখনই মাত্র সোভিয়েত ইউনিয়ন মুসলিম শক্তির কাছে পরাজিত হয়েছিল। তাই বিন লাদেন তখন মুসলিমদের রক্ষার্থে উদ্বুদ্ধ ছিলেন।
এ বিষয়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারাহ পন্ডিত বলেন, এটা অনেক বড় শক্তি ছিল যে তারা সোভিয়েতকে পরাজিত করেছে। পশ্চিমারা যাতে মুসলমানদের ওপর আক্রমণ না করে, সে ভয় ধরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন বিন লাদেন।
সেজন্য ওসামা বিন লাদেন মনে করেন- আমেরিকাকে সরাসরি আক্রমণ করা উচিৎ।
এখন প্রশ্ন হলো আল-কায়েদা ছিল তখনকার একটি ছোট সংগঠন। তারা কিভাবে আমেরিকাকে আক্রমণ করবে?
১৯৯৬ সালে আফগানিস্তানে তালেবানরা দেশটির মুজাহিদিনকে সরিয়ে ক্ষমতায় আসে। এরপরই আল কায়েদা একটি ভূমি পায় যেখানে তারা তাদের যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করে। যদিও ৯০ সালের পরে আফগানিস্তানে থাকা অবস্থায়ই বিভিন্ন জায়গায় আক্রমণ করার পরিকল্পনা করে কাজ শুরু করে আল কায়েদা। সেই প্লানের একটি অংশ ছিল নাইন ইলেভেনের টুইন টাওয়ার হামলা।
আল কায়েদা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
টুইন টাওয়ার হামলার পরে জর্জ ডাব্লিউ বুশ বলেন, আল কায়েদা জঙ্গিদের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ শুরু। এটা এখানেই শেষ হওয়ার নয়। পৃথিবীতে যত জঙ্গি গ্রুপ রয়েছে তাদের শেষ না করে আমরা থামবো না। যাকেই পাব, তাকেই পরাজিত করবো।
এরপরেই শুরু হয় কথিত জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ, যার শুরু হয়েছিল আফগানিস্তান থেকে। যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সেনারা একত্রিত হয়ে আফগানিস্তানে হামলা চালায়। এরপর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডাব্লিউ বুশ ২০০৩ সালে ইরাকে হামলা চালান। কিন্তু ইরাকের সাথে টুইন টাওয়ারে হামলার কোনো যোগাযোগই ছিল না।
এরপর কয়েকবছর আমেরিকা ড্রোন হামলা চালিয়ে আল কায়েদার অনেক নেতাকে হত্যা করে। কিন্তু এখনও যুক্তরাষ্ট্র আল কায়েদার হুমকিতে রয়েছে। কারণ আল কায়েদার সদস্য সংখ্যা বর্তমানে অনেক বেড়েছে। ইন্টারনেট এবং বিভিন্ন ওয়েবসাইটের মাধ্যমে তাদের যোগাযোগ এখন অনেক সহজ হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রও জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে এর অপব্যবহারও করেছে। এর নামে তারা অনেক মানুষকে হত্যা ও নির্যাতন করেছে। যুদ্ধের মাধ্যমে হত্যা ছাড়াও তাদের নির্যাতনের নমুনা পাওয়া যায় আবু গারিব, গুয়েনতানামো, বাগরাম ইত্যাদি কারাগারে। তারা হাজার হাজার মানুষকে বিচার ছাড়াই নির্যাতন চালিয়েছে।
আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুতের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের পরিচালক রামি খোরল বলেন, কথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে যে কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে, এর মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়ার কোটি কোটি মানুষের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে, মানুষের হতাশা বেড়েছে। অনেক সময় ড্রোন হামলায় হঠাৎ অনেক সাধারণ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। সেসব মানুষ জানতও না যে, মিসাইল কোথা থেকে এসেছে। যেটা মানুষের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করছে।
নাইন ইলেভেনের পরে আল কায়েদা আরো অনেক জায়গায় হামলা করেছে। তার মধ্যে রয়েছে- ২০০৩ সালে বালিতে বোমা হামলা, ২০০৪ সালে মাদ্রিদে ট্রেনে হামলা, ২০০৫ সালে লন্ডনে হামলা, ২০০৬ সালে প্যারিসে হামলা। এ হামলাগুলো ওসামা বিন লাদেনের পরিচালনায় হয়েছিল।
বিন লাদেন ২০১১ সালে মারা যান। টুইন টাওয়ার হামলার ১০ বছর পর যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের একটি গোপন গুহায় তাকে খুঁজে পায় এবং সেখানে তাকে হত্যা করে।
যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা উল্লাস করে বলেন, আমরা তাদের প্রধানকে ছেটে দিয়েছি। আমরা এবার তাদের সম্পূর্ণভাবে শেষ করবো।
বিন লাদেনের মৃত্যুর পর নতুন নেতা জাওয়াহিরি
ওসামা বিন লাদেনের মৃত্যু ছিল আল কায়েদার জন্য বড় ধরনের আঘাত। নতুন নেতা হন আয়মান আল জাওয়াহিরি। তিনি মিশরের নাগরিক। তিনি আল কায়েদার ৯০ দশকের একজন সদস্য। এরপর তিনিও মোস্ট ওয়ান্টেড টার্গেটে পরিণত হন। কয়েকটি রিপোর্টে বলা হয় যে, আয়মান আল-জাওয়াহিরি নিহত হয়েছেন। কিন্তু এর কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। গোয়েন্দারা মনে করেন, তিনি আফগানিস্তানের কোথাও লুকিয়ে আছেন।
আল কায়েদা নেতারা সবসময়ই অনেক চাপের মধ্যে থাকেন। যে কোনো সময় তাদের ওপর আক্রমণ হতে পারে। কিন্তু তার মধ্যে দিয়েও তারা সংগঠন পরিচালনা করে আসছে এবং নতুন হামলার পরিকল্পনা তারাই করেন।
বিশ্বব্যাপী আল কায়েদা নেটওয়ার্ক
আল কায়েদার যারা প্রতিনিধিত্ব করেন তাদের মধ্যে সকলকে ঐক্যবদ্ধ রাখার মতো চুম্বকের মতো ক্ষমতা রয়েছে। তারা সবসময় নতুন শক্তি তৈরি করে এগিয়ে নিচ্ছেন। বর্তমানে আলকায়দা পৃথিবীব্যাপী নেটওয়ার্ক তৈরি করে চলেছে।
আফগানিস্তান, পাকিস্তান এলাকায় কাজ করে একটি দল। এছাড়া আল কায়েদার হয়ে কাজ করছে আফ্রিকার আল শাবাব, সোমালিয়ান আল-কায়দা, ইসলামিক মাগরিব রয়েছে আলজেরিয়া, লিবিয়া ও তিউনিসিয়ায়।
অন্য একটি গ্রুপ রয়েছে মালিতে। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ ও ইন্ডিয়ায় আল কায়েদার নেটওয়ার্ক প্রসারণের চেষ্টা চালাচ্ছে বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে বলা হচ্ছে।
এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতার সুযোগ নিচ্ছে সংগঠনটি। সিরিয়া, ইরাক ও ইয়েমেন যুদ্ধের জন্য নতুন শাখার উন্নয়ন করে চলছে।
আল কায়েদা ও তালেবান
বর্তমানে তালেবানরা আবার আফগানিস্তান দখল করেছে। তার জন্য আল কায়েদা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সাহায্য করেছে। যদিও তালেবানরা ভিন্ন কথা বলছে।
তালেবান মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ বলেন, আফগানিস্তানের মাটি আফগানিস্তানের প্রতিবেশী বা অন্য দেশকে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে মিল রেখে চলতে চাই এবং আমরা যা কথা দিয়েছি তা মেনে চলব।
কিন্তু আল কায়েদা ছিল তালেবানদের বিশ্বস্ত। তাহলে কি আল কায়েদার ব্যাপারে তালেবানদের বিশ্বাস করা যায়?
প্রিয় পাঠক, এ বিষয়ে আপনার মতামত জানান মন্তব্যে।
আমেরিকার সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধের প্রভাব
এদিকে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ৯/১১ এর পরে যুক্তরাষ্ট্র যে ধরনের হামলা চালিয়েছে, তাতে এর পরিণাম আরো ভয়ংকর হতে পারে। হামলা হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদের ওপরেও।
আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুতের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের পরিচালক রামি খোরল বলেন, আপনি পাকিস্তান, সিরিয়া বা ইয়েমেনের একজন গরিব মানুষের কথা চিন্তা করেন, যার ঘর বাড়ি যুক্তরাষ্ট্রের ড্রোন হামলায় ধ্বংস হয়েছে। নিজের পরিবারের সদস্যদের হারিয়েছেন। তাদের এই ক্ষোভ হতাশা আল কায়েদার জন্য তাকে নতুন সদস্য করতে সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। মানুষ বলে যে, আমার পক্ষে যিনি দাঁড়ান আমি তার জন্য যুদ্ধ করতে রাজি আছি।
সূত্র : আল জাজিরা