শাহেদ ইশরাক : বাংলাদেশে ২০১৮ অর্থাৎ এ বছরই বাণিজ্যিকভাবে জেনেটিক্যালি মোডিফাইড ধান “গোল্ডেন রাইস” উৎপাদন শুরু হবে। এ নিয়ে দেশব্যাপী বিতর্কের শেষ নেই। সবাই একে প্রাণঘাতী, সর্বনাশা, ষড়যন্ত্রের ফসল ইত্যাদি নামে আখ্যা দিচ্ছেন। কিন্তু কিভাবে এই গোল্ডেন রাইসের উৎপত্তি হলো আর কিভাবে সেটা আমাদের দেশে পৌঁছালো সেটা নিয়েই আজকের এই লিখা।
১৯৭৪ সালে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরী কিসিঞ্জার অনুন্নত দেশগুলোতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে আমেরিকার রাষ্ট্রীয় স্বার্থ বিষয়ক একটি প্রস্তাবনা “National Security Study Memorandum 200” মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের পক্ষ হতে হোয়াইট হাউসে জমা দেয়। সেখানে হেনরী সতর্ক করে যে, অনুন্নত দেশ (যার মধ্যে সে বাংলাদেশের নাম উল্লেখ করে) এর জনসংখ্যা বৃদ্ধি আমেরিকার নিরাপত্তার জন্য হুমকি স্বরুপ। এ জন্য ওই সমস্ত দেশের জনগণের উর্বরতা অথবা “সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা” হ্রাস করার প্রয়োজন। তার এই প্রস্তাবনাকে পরের বছর প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড মার্কিন অফিসিয়াল পলিসিরুপে গ্রহন করে। (PDF Copy from USAID Site: goo.gl/9YTsEv ; দ্বিতীয় চ্যাপ্টার, ৩৪-৩৯ পৃষ্ঠায় লক্ষ্য করুন)
এর পর ১৯৮৪ সালে রকফেলার ফাউন্ডেশন এর পক্ষ থেকে একটি মিটিংয়ের আয়োজন করা হয় যেখানে আমেরিকান কৃষিবিদদের সম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে তারা ফসলের বীজের মধ্যে জেনেটিক্যাল মডিফিকেশন অর্থাৎ জীনগত পরিবর্তন ঘটাবে। অতঃপর রকফেলার ফাউন্ডেশনের অর্থে পরিচালিত হতে থাকে এই গবেষণা। ১৯৯৯ সালে সুইজারল্যান্ডের এক কৃষিবিদ রকফেলার ফাউন্ডেশনের পৃষ্ঠপোষকতায় ধানের মধ্যে জীনগত পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়। তারা জরুরী ভিত্তিতে সরকারী অনুমোদন না নিয়েই চীনের বাচ্চাদের মাঝে ওই চালের পরীক্ষা চালায়। তখন এটা নিয়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়, সবাই মনে করে যে এখানেই গোল্ডেন রাইসের সমাপ্তি ঘটবে। (সুত্র: goo.gl/GnYdQk)
কিন্তু সেখানে গোল্ডেন রাইসের ইতি ঘটেনি। আমেরিকার জায়ান্ট কোম্পানি Syngenta ও Monsanto এবং আমেরিকার পররাষ্ট্রীয় সহায়তা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান USAID এর যৌথ উদ্যোগে GMO (Genetically Modified Organism) ফসল সারা বিশ্বে বিচ্ছিন্নভাবে প্রবেশ করানোর প্রচেষ্টা চলতেই থাকে। সাথে সাথে চলতে থাকে GMO এর সংক্রমনের ঘটনা। (সুত্র: goo.gl/uvgA7S)
খোদ আমেরিকাতেই ২০১১ সালে Syngenta কোম্পানির নামে ডজন ডজন মামলা হয় যে, সিনজেনটা কোম্পানির চাষকৃত GMO ফসল এর কারণে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত ভুট্টার উপর Contamination অর্থাৎ সংক্রমন হয়েছে। এজন্য চীনা আমদানীকারকরা প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের ভুট্টার শিপমেন্ট বাতিল করে। (সুত্র: goo.gl/31zpH3) এধরণের ভিন্ন ভিন্ন মামলায় Syngenta কোম্পানি কয়েক’শ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। (সুত্র: goo.gl/MK5Vm2) আবার, GMO ফসল থেকে তৈরীকৃত খাবার শুকরকে খাইয়ে পরীক্ষা করা হয়েছে এবং শুকরের পাকস্থলীতে অস্বাভাবিক বিষক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। (সুত্র: goo.gl/BGiJmE)
গোল্ডেন রাইস এর সংক্রমনের চরিত্রটি অতি মাত্রায় আগ্রাসী। যে জমিতে গোল্ডেন রাইস চাষ করা হয়, শুধু যে সে জমি অথবা তার আশেপাশের ক্ষেতে এর সংক্রমন হবে- ব্যাপারটা এত সহজ নয়। পানি, মাটির মাধ্যমে তো বটেই, ক্রস পলিনেশন অথবা এক প্রজাতির পরাগ রেণু দ্বারা আরেক প্রজাতির ফসলকে নিষিক্তকরণের প্রক্রিয়া প্রাকৃতিক উপায়ে যে কয়টি মাধ্যমে সংঘটিত হয়, গোল্ডেন রাইসের সংক্রমনও সেই সমস্ত প্রক্রিয়ায় হতে পারে। উদাহরণস্বরুপ- বাতাসে গোল্ডেন রাইসের পরাগ রেণু উড়ে গিয়ে অনেকদুরে অবস্থিত ক্ষেতের ফসলে গিয়ে পড়তে পারে অথবা উড়ন্ত পোকা-মাকড়ের দেহের মাধ্যমেও এই সংক্রমন হতে পারে। অর্থাৎ বাউন্ডারী দিয়ে আলাদাভাবে চাষ করলেও এর সংক্রমনের হাত থেকে বাঁচার উপায় নেই। পরীক্ষা করে সবাই এ ব্যাপারেও একমত হয়েছে যে রাইস অর্থাৎ ধানের মধ্যে এর সংক্রমনের হার সবচেয়ে বেশী। (পড়তে পারেন: goo.gl/h2GdJg)
পুর্বেই বলা হয়েছে যে, Syngenta এবং Monsanto কোম্পানী USAID এর সাথে মিলে গোল্ডেন রাইসের প্রচার-প্রসার করে। এখন আমরা আলোচনা করবো যে, বাংলাদেশে এর কিরুপ প্রভাব পড়বে।
National Security Study Memorandum 200 এর মধ্যে হেনরী কিসিঞ্জার কয়েকটি দেশের নাম উল্লেখ করেছিলো যেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। পরবর্তীতে এই পলিসির আওতায় যত কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে, সবগুলোতে বাংলাদেশকে অন্যতম টার্গেট রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। ২০০৮ সালে রকফেলার ফাউন্ডেশনের প্রেসিডেন্ট জুডিথ রোডিন বক্তব্য দেয় যে, তারা বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে গোল্ডেন রাইসের সরকারী অনুমোদন প্রাপ্তির জন্য আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট (IRRI) কে ফান্ড দিবে। (সুত্র: goo.gl/3dhmWq)
সম্প্রতি মার্কিন সরকারের Feed The Future প্রোগ্রামের টার্গেট লিস্টের ১ নং দেশ হলো বাংলাদেশ। (সুত্র: goo.gl/NS3iG7) মার্কিন সরকার Feed the Future প্রোগ্রাম এর মাধ্যমে পাঁচ বছর মেয়াদী পরিকল্পনা U.S. Government Global Food Security Strategy (FY 2017-2021) গ্রহন করেছে। সেখানে তারা যে সমস্ত সহযোগীর মাধ্যমে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে তাদের ব্যাপারে উল্লেখ করেছে। তারা হলো জাতীয় ও স্থানীয় সরকার, এলাকাভিত্তিক ও স্থানীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠান, দ্বি-পাক্ষিক দাতা সংস্থা, আন্তর্জাতিক এবং এলাকা ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, এনজিও, ধর্ম বিষয়ক সংস্থা, বিভিন্ন পেশাজীবি এবং সামাজিক সমিতি, প্রাইভেট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান যারা কৃষি ও সংশ্লিষ্ট পণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করে, নারী ও ক্ষুদ্র উৎপাদনকারী, কৃষি গবেষণা ও শিক্ষামূলক প্রতিষ্ঠান, ভূমি সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য।
পরিকল্পনা মোতাবেক তারা বাংলাদেশের “প্রাণ” কোম্পানির সাথে চুক্তি করেছে এবং $5 million (প্রায় ৪০ কোটি টাকা) ঋণ দিয়েছে যাতে প্রাণ কোম্পানি তাদের প্রোডাক্ট বাজারজাত করতে পারে। (সুত্র: PDF Copy from “Feed The Future” Site: goo.gl/Cy4RKr ; ৯ এবং ৯০ পৃষ্ঠায় লক্ষ্য করুন)
বরাবরের মতো এই প্রোগ্রামের অন্যতম বাস্তবায়নকারী হলো USAID এবং Syngenta কোম্পানী। তারা শুধু বাংলাদেশ নয়, টার্গেট রাষ্ট্রগুলোতে প্রবেশের জন্য কিছু কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। তারা ”Syngenta-USAID Ag Students Connection” বা “সিনজেনটা-ইউএসএআইডি কৃষি শিক্ষার্থী সংযোগ” নামে একটি প্রোগ্রাম শুরু করেছে যেখানে তারা টার্গেট রাষ্ট্রগুলো থেকে কৃষি শিক্ষার্থীদেরকে বাছাই করবে, ট্রেনিং ও বৃত্তি দিবে। ২০১৭ সালে তন্ময় কুমার ঘোষ নামে বাকৃবির এক ছাত্রকে এই প্রোগ্রামে বাছাই করে ভিয়েতনাম নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সুত্র: (goo.gl/52yCbG)
শুধু তাই নয়, Syngenta কোম্পানি বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট এর থেকে ২০১৫ সালে গোল্ডেন রাইস পরীক্ষামূলক উৎপাদনের অনুমোদন নিয়েছে। (সুত্র: goo.gl/U1imKc) আমেরিকার পরে বাংলাদেশই একমাত্র রাষ্ট্র যা গোল্ডেন রাইসকে এরুপ অনুমোদন দিয়েছে। এর পিছনে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে উক্ত ইন্সটিটিউটের তৎকালীন মহাপরিচালক “জীবণ কৃষ্ণ বিশ্বাস”। সবকিছু ঠিক থাকলে এই বছরের মধ্যেই “গোল্ডেন রাইস” সরকারী ও বেসরকারী উদ্যোগে বাংলাদেশের সর্বত্র বাজারজাত করা হবে। (সুত্র: goo.gl/HKQSi8)
পরিশেষে, এখনো বাংলাদেশে গোল্ডেন রাইস বাজারজাতকরণ শুরু হয়নি। আরো হয়ত মাসখানেক সময় পাওয়া যাবে। বাংলাদেশের মানুষের উর্বরতা অর্থাৎ “সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা” এবং বাংলাদেশের কৃষিকে গোল্ডেন রাইসের সংক্রমন থেকে রক্ষা করার জন্য গোল্ডেন রাইসকে কোনক্রমেই বাজারজাত করতে দেওয়া যাবে না। গোল্ডেন রাইসের সংক্রমনের কোন মাত্রা নেই, নেই কোন প্রতিষেধক। একবার ছড়িয়ে গেলে আর কখনো এটা রোধ করা যাবে না। (সুত্র: goo.gl/NDZa1s) এই আশংকায় ফিলিপাইনের কৃষকরা গোল্ডেন রাইসের পরীক্ষামূলক চাষের ক্ষেতকে ধ্বংস করে নিজেদের জীবন বাঁচিয়েছে। (সুত্র: goo.gl/EdL1dg)