আনসারুল্লাহ বা হাউছি আন্দোলন ইয়েমেনের রাজনীতিতে বর্তমানে শীর্ষ অবস্থানে পৌঁছানোর আগে বেশ কয়েকবার চড়াই উৎরাই পার হয়। শিয়াদের জায়দি শাখার রীতিনীতি রক্ষার উদ্দেশ্যে ১৯৯০ এর দশকে প্রধানত তরুণরা সংগঠনটি গড়ে তোলে। তবে ২০০০ সাল নাগাদ এটি একটি শক্তিশালী সশস্ত্র গেরিলা সংগঠনে পরিণত হয়। ইয়েমেনের উত্তরের প্রত্যন্ত প্রশাসনিক এলাকা সাদায় উপজাতীয়দের রাজনীতি এ আন্দোলনকে ঘিরে দানা বাঁধে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল প্রেসিডেন্ট আলি আবদুল্লাহ সালেহের সেনাবাহিনীর হাত থেকে নিজেদের ও নিজেদের মিত্রদেরকে রক্ষা করা। ২০১১ সালে আরব বসন্ত শুরু হলে আনসারুল্লাহ ছিল প্রেসিডেন্ট আলি আবদুল্লাহ সালেহের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের ঘোর সমর্থক। সালেহের পতনের পর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংলাপে তারা সক্রিয় অংশগ্রহণ করে এবং তারা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, জাতিগত বৈচিত্র্যের প্রতি সম্মান ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা জোরদারের পক্ষে অবস্থান নেয়। কিন্তু ২০১৪ সালের প্রথম দিকে প্রেসিডেন্ট আবদু রাব্বিহ মানসুর হাদির অন্তর্বর্তী সরকারে অচলাবস্থার সৃষ্টি হলে আনসারুল্লাহ বাহিনী উত্তরাঞ্চলে ব্যাপক সামরিক অভিযান শুরু করে এবং জেনারেল আলি মুহসিন আহমার ও ইসলাহ পার্টির সামরিক জোটকে পরাজিত করে। শেষ পর্যন্ত ওই বছরের সেপ্টেম্বরে তারা রাজধানী সানা দখল করে। আনসারুল্লাহর ঘোষিত লক্ষ্য জাতীয় সংলাপের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে একটি শক্তিশালী অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠা করা। তবে ওই অঞ্চলে সামরিক প্রাধান্য প্রতিষ্ঠাও তাদের লক্ষ্য। গত বছর তাদের সাবেক শত্রু সালেহের সাথে জোট গঠন আনসারুল্লাহকে ইয়েমেনে প্রধান সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উপসাগরীয় দেশগুলোর সমর্থিত হাদি সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ও ইয়েমেনের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে নিজের নিরাপদ অবস্থান তৈরি করতে আনসারুল্লাহর সাথে মৈত্রীকে কাজে লাগান সাবেক প্রেসিডেন্ট আলি আবদুল্লাহ সালেহ। তবে আনসারুল্লাহর শক্তির উৎস ধর্মীয় নয়, বরং অভ্যন্তরীণ ও রাজনৈতিক। জায়দি শিয়ারা নিজেদের মহানবী হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বংশধর বলে দাবি করে। ১৯৬২ সাল পর্যন্ত প্রায় এক হাজার বছর ধরে উত্তর ইয়েমেন শাসনকারী জায়দি ইমামদের সরকারে বিশেষ ভূমিকা পালন করে তারা। কিন্তু তাদেরকে হুমকি মনে করে নতুন ইয়েমেন প্রজাতন্ত্রের নেতারা তাদের সাথে বৈষম্যমূলক আচরণ করেন। ১৯৯০ এর দশকে জায়দিরা প্রজাতান্ত্রিক ইয়েমেনে নিজেদের অবস্থান সৃষ্টির চেষ্টা করে। এ জন্য তারা দুইটি রাজনৈতিক দল গঠন করে- আল হক (সত্য) ও ইত্তেহাদুল কুওয়াতিশ শা‘বিয়্যাহ (জনশক্তি সঙ্ঘ)। এ দিকে সৌদি আরবে প্রচলিত সালাফিদের দ্বারা শিয়া তরুণরা প্রভাবিত হতে থাকলে জায়দি ভাবধারা রক্ষার লক্ষ্যে শাবাবুল মুমিনীন নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন হুসাইন আল হাউছি। এটিই আনসারুল্লাহর পূর্বসূরি। শাবাবুল মুমিনীনের ওপর সালেহ সরকারের দমন অভিযানই তাদেরকে ইয়েমেনের রাজনীতিতে সামনে নিয়ে আসে। প্রেসিডেন্ট সালেহর বৈধতাকে চ্যালেঞ্জ করে হুসাইন আল হাউছি বলেন, সালেহ দুর্বল এবং তিনি যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছেন। ইরাকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন হামলার সময় সানার জামে মসজিদে তিনি স্লোগান দেন, নিপাত যাক আমেরিকা, নিপাত যাক ইসরাইল, অভিশাপ ইহুদিদের, ইসলাম দীর্ঘজীবী হোক ইত্যাদি। অবশ্য তার স্লোগানের লক্ষ্য যুক্তরাষ্ট্র বা ইসরাইল নয়, ছিলেন সালেহ। প্রেসিডেন্ট বলপ্রয়োগে দমন করতে চাইলেন হাউছিদের। কিন্তু হুসাইনের বিরুদ্ধে ইয়েমেনের সামরিক বাহিনী যেভাবে অভিযান চালায়, তাতে উত্তর এলাকার জনগণ ক্ষিপ্ত হয়। সালেহ সরকারের প্রতি জনগণের ক্ষোভকে কাজে লাগায় আনসারুল্লাহ। কারণ তারা ইয়েমেনি সমাজ ও উপজাতীয় সংগঠনগুলোকে ভালো করে জানত। সাদায় আনসারুল্লাহর সফল বিদ্রোহ ছিল সালেহ সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যর্থতা। এ দিকে দক্ষিণাঞ্চলেও ব্যর্থ হয় সালেহ সরকার। জনগণ সালেহ সরকারকে প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু তাদের কোনো কার্যকর নেতৃত্ব ছিল না। মধ্যাঞ্চলের তায়েজ, পূর্বাঞ্চলের মারিব ও জওফ এবং সানার শিক্ষিত তরুণদের সমর্থন পায় আনসারুল্লাহ। যারা সালেহ সরকারের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিল, তাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলে আনসারুল্লাহ। এরই মধ্যে হাদির সরকার গঠিত হয়। কিন্তু জাতীয় সংলাপ অনেক দীর্ঘায়িত হয় এবং ইয়েমেনকে ফেডারেশন গঠনের প্রশ্নে সহজে মীমংসা হলো না। সালেহ পরবর্তী সরকারে স্থান করে নেয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলার প্রতিযোগিতার মধ্যে সরকার হয়ে পড়ল অচল। আর অর্থনীতি ভেঙে পড়ল। এই পরিস্থিতিতে ২০১৪ সালের প্রথম দিকে এগিয়ে এলো আনসারুল্লাহ। বিবিসি অবলম্বনে। সৌজন্যে: নয়াদিগন্ত