ফিলিস্তিনি জনগণের সাথে ইসরাইলের রক্তক্ষয়ী সংঘাত চলছে বহু বছর ধরে। ইসরাইলি আঘাতের পাল্টা জবাবে কয়েক দিন ধরে ফিলিস্তিন থেকে শত শত রকেট ছোড়া হচ্ছে ইসরাইলকে লক্ষ্য করে। তবে এসব রকেটের অধিকাংশই ঠেকিয়ে দেওয়ার দাবি করছে দেশটি। রকেট হামলা ঠেকানোর জন্য ইসরাইলের হাতে আছে আয়রন ডোম নামের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর দাবি, তারা আয়রন ডোমের মাধ্যমে ৯০ শতাংশ রকেট হামলা আকাশেই ঠেকিয়ে দিয়েছে। আয়রন ডোম কী, আর তা কিভাবে ইসরাইলের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে জানাবো এই নিবন্ধে।
আয়রন ডোম কী?
আয়রন ডোম (ইংরেজি: Iron Dome; হিব্রু ভাষায়: כִּפַּת בַּרְזֶל, kipat barzel, আক্ষরিক অর্থ “লৌহ কিপ্পাহ”)। এটি অন্তঃপ্রক্ষেপণ এবং স্বল্প-সীমা রকেটসমূহ ধংস এবং ৪ থেকে ৭০ কিলোমিটার দূর থেকে আসা আর্টিলারি শেল হামলা প্রতিহত করতে নকশা করা হয়েছে। ইসরায়েল আশা করছে যে তারা ভবিষ্যতে ইণ্টারেসেপ্টিং রেঞ্জ ৭৫ কিলোমিটার (৪৫ মাইল) থেকে ২৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত বাড়ানো যাবে। একে আরো ভারসেটাইল করার চিন্তা রয়েছে যাতে করে এটি দু’দিক থেকে আসা হামলাকে প্রতিহত করতে পারে।
সহজ ভাষায় বলা যায়- আয়রন ডোম বিশ্বের একটি অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। এ ব্যবস্থা বিশেষভাবে স্বল্পপাল্লার (শর্ট রেঞ্জ) হুমকির বিরুদ্ধে কাজ করে থাকে। ইসরাইলের রাফায়েল অ্যাডভান্সড ডিফেন্স সিস্টেমস ও ইসরায়েল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ আয়রন ডোম তৈরি করেছে। আয়রন ডোম তৈরির ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে সহায়তা পেয়েছে ইসরায়েল।
প্রকৃতপক্ষে আয়রন ডোমের মূল শক্তি বা ইন্টারসেপ্টর মিসাইলের প্রযুক্তি আমেরিকার । এমনকি এটির প্রজেক্ট বাজেট এবং প্রযুক্তিগত দিক দিয়েও আমেরিকার ডিফেন্স জায়ান্ট লকলিড মার্টিন প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করেছে।
তৈরির প্রেক্ষাপট
১৫ বছর আগের পরিকল্পনা : সর্বশেষ ২০০৬ সালেও একবার বড় যুদ্ধে জড়িয়েছিল ইসরায়েল৷ লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর সঙ্গে সেই যুদ্ধে হিজবুল্লাহর ছোঁড়া রকেটে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল ইসরায়েলের৷ সেই যুদ্ধের পরই খুব শক্তিশালী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার ঘোষণা দেয় ইসরায়েল৷
হিজবুল্লাহর সঙ্গে ওই যুদ্ধের পর ইসরায়েল ঘোষণা দেয়, তারা একটি নতুন ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে যাচ্ছে।
পাঁচ বছরে বাস্তবায়ন: হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে সেই যুদ্ধের পাঁচ বছর পর, অর্থাৎ ২০১১ সালে অত্যাধুনিক এক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষাব্যবস্থা গড়ায় সাফল্যের ঘোষণা দেয় ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়৷ আকাশে স্বল্প পাল্লার সব ধরনের ক্ষেপণাস্ত্রকে নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম এই প্রতিরক্ষাব্যবস্থার নাম দেয়া হয় ‘আয়রন ডোম’৷
আয়রন ডোম কিভাবে কাজ করে?
এই পদ্ধতি স্বল্প-সীমা রকেটসমূহের মোকাবেলা করার জন্য নকশা করা হয়েছে এবং ১৫৫ মিমি বিশিষ্ট্য আর্টিলারি শেল যার পরিসীমা ৭০ কিলোমিটারের উপরে। আয়রন ডোম দিন এবং রাতের যে কোনো প্রতিকূল আবহাওয়াতে কাজ করার উপোযোগী। এটি একই সাথে কয়েকটি রকেট হামলা প্রতিহত করতে পারে।
আয়রন ডোম ব্যবস্থার প্রধান দিক তিনটি।
- রাডার ব্যবস্থা
- কন্ট্রোল ব্যবস্থা
- মিসাইল ফায়ারিং ব্যবস্থা। এ তিন ব্যবস্থা মিলেই গড়ে ওঠে সুদৃঢ় প্রতিরক্ষাব্যবস্থা।
ইসরাইলের দিকে ধেয়ে আসা রকেটকে চিহ্নিত ও তার গতিপথ শনাক্ত (ট্র্যাক) করে রাডার ব্যবস্থা। তারপর কন্ট্রোল ব্যবস্থা ধেয়ে আসা রকেটের সম্ভাব্য ‘হিট পয়েন্ট’ নির্ধারণ করে। ‘হিট পয়েন্ট’ নির্ধারণের পর কন্ট্রোল ব্যবস্থা মিসাইল ফায়ারিং ব্যবস্থাকে নির্দেশনা দেয়। মিসাইল ফায়ারিং ব্যবস্থা থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুটে যায় আকাশে। আকাশে গিয়ে ধেয়ে আসা রকেটের কাছে ক্ষেপণাস্ত্র বিস্ফোরিত হয়। এতে রকেট আকাশেই ধ্বংস হয়ে যায়।
এর ওজন ৯০ কেজি (২০০ পাউন্ড), দৈর্ঘ্য ৩ মিটার (৯.৮ ফুট), ডায়ামিটার ১৬০ মিমি, ডেটোনেশন মেকানিজম Proximity Fuze,
এক ব্যাটারিতে ৩টি লঞ্চার সিস্টেম থাকে। প্রতিটি লঞ্চারে ২০টি মিসাইল থাকে।
আয়রন ডোমের প্রতিটি ব্যাটারির দাম ৫০ মিলিয়ন বলা হলেও প্রকৃতপক্ষে ৬০-৭০ মিলিয়ন ডলার। এক ব্যাটারিতে ৩টি লঞ্চার সিস্টেম থাকে। প্রতিটি লঞ্চারে ২০টি মিসাইল থাকে। একেকটি ইন্টারসেপ্টর তামির মিসাইলের দাম ৪০০০০ ডলার বলা হলেও এগুলোর বর্তমান দাম ৭০০০০ ডলার।
বলে রাখা ভালো হামাসের প্রতিটি ৮০০ ডলারের রকেটের বিপরীতে ইসরাইলকে কমপক্ষে দুইটি তামির মিসাইল নিক্ষেপ করতে হয়। মানে প্রতিটি ৬৬ হাজার টাকার রকেট আটকাতে ইসরাইলের ১১ কোটি ৬ লাখ টাকা খরচ করতে হয়।
আয়রন ডোমের ব্যবহার
সাধারণত কোনো দেশ তাদের আকাশ বা জলপথের সীমানায় এই ধরণের আয়রন ডোম ইনস্টল করে থাকে। রকেট, মর্টার থেকে যাবতীয় দূরপাল্লার বিভিন্ন অস্ত্রকে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন অদৃশ্য এক দেয়াল এই আয়রন ডোম।
ইসরাইল যে আয়রন ডোম পরিষেবা ব্যবহার করে তা বানিয়েছে ফ্রান্সের বিখ্যাত রাফাল অ্যাডভান্স ডিফেন্স সিস্টেম। এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে গাজা প্রদেশ নিয়ে উত্তেজনার জেরে ২০১১ সালেই ইসরাইল সরকারের ছাড়পত্রে সেদেশের সেনাবাহিনী ইনস্টল করেছিল প্রথম আয়রন ডোম।
ইসরাইলের পরে আমেরিকাও এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। আমেরিকার ‘আয়রন ডোম’-এর নাম স্কাই হান্টার।
নিখুঁত নয় আয়রন ডোম
আয়রন ডোম তৈরি করেছে ইসরাইলের রাফায়েল অ্যাডভান্সড ডিফেন্স সিস্টেমস ও অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ৷ অত্যাধুনিক এই প্রতিরক্ষাব্যবস্থা তৈরিতে যুক্তরাষ্ট্রও সহায়তা করেছে৷ তবে আয়রন ডোম পুরোপুরি নিখুঁত নয়৷ এক সঙ্গে ঝাঁকে ঝাঁকে রকেট ছুঁড়লে এর প্রতিরক্ষাব্যুহে কিছুটা হলেও যে ফাটল দেখা দেয় তা খুব স্পষ্ট৷ সেকারণেই হামাসের কিছু রকেট ইসরাইলে আঘাত হানতে পারছে বলে মনে করেন সমরবিশেষজ্ঞরা৷
হামাসের রকেট এবং আয়রন ডোমের কার্যকারিতা
শর্ট রেন্জ এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমগুলোতে আয়রন ডোমকে অবশ্যই সেরা বলা যায়। বিশেষকরে লো অবজারবেল টার্গেটগুলোর জন্য এটি খুবই কার্যকর। তবে তা গাজা এবং ইসরাইলের ভিতরে।
এটি ২০১১ সালে সার্ভিসে আসে। ২০১২ সালে আয়রন ডোম প্রায় ৪০০ রকেট ইন্টারসেপ্ট করে এবং ২০১২-২০১৪ সাল পর্যন্ত আইরন ডোম প্রায় ১২০০ হামাসের রকেটকে ইন্টারসেপ্ট করতে সক্ষম হয়।
কিছুদিন আগেও হামাস ১৫০০ রকেট নিক্ষেপ করে। তারমধ্যে ২০০+ মতো রকেট আইরন ডোম ইন্টারসেপ্ট করতে সক্ষম হয়।
হামাসের রকেটগুলো আটকাতে পারার বেশ কিছু কারণ রয়েছে। যেমন-
১) হামাস কোথা থেকে রকেটগুলো উৎক্ষেপণ করবে অর্থাৎ লঞ্চ সাইট হতে পারে এরকম বেশ কয়েকটি স্থান আগে থেকেই আয়রন ডোমের ফায়ার কন্ট্রোল রাডারে সেট করে দেওয়া থাকে। যার কারণে রকেট ফায়ার করার সাথেসাথেই আয়রন ডোম অ্যাকশন নিতে পারে।
২) আয়রন ডোমের রাডার রেন্জ অনেক বেশি। যার রকেট ফায়ার করার সাথে সাথেই আয়রন ডোমের রাডার খবর পেয়ে যায়। যেমন- আমরা যদি আমাদের চট্টগ্রামে এস-৪০০ মোতায়েন করি ইন্ডিয়ার ভিতরে আরো ৪০০ কিলোমিটার এলাকায় মিসাইল লঞ্চ হলে আমরা জানতে পারবো।
৩) হামাসের রকেটগুলো সেকেলে আমলের। এবং আল কাসাম রকেটগুলোতে কোন গাইডেন্স সিস্টেম নেই ও এটি একটি সাধারণ ধাতব পাইপ ফ্রেম দিয়ে তৈরি। এসব রকেট, অত্যাধুনিক তামির মিসাইলের প্রযুক্তির তুলনায় খুবই অনুন্নত, এবং রকেটগুলো ব্যয় কয়েকশো ডলার। এগুলি অত্যন্ত ত্রুটিযুক্ত, লঞ্চের পর কোথাও আঘাত করানো, হিসাবের বিচারের চেয়ে ভাগ্যের বিষয়।
৪) আধুনিক মিসাইলগুলোকে আয়রন ডোম কতটুকু প্রতিহত করতে পারবে তা প্রশ্নবিদ্ধ। কেননা হামাসের রকেটগুলো কোনো মিসাইল নয়। আধুনিক ক্রুজ মিসাইলগুলোতে অত্যাধুনিক গাইডেন্স থাকে।
এগুলো স্যাম সিস্টেমকে ফাঁকি দিতে বিভিন্ন ম্যানুভার করতে পারে। এছাড়া এগুলোতে স্টিলেথ প্রযুক্তি ব্যবহার হয়ে থাকে এবং খুবই গতিশীল। অন্যদিকে হামাসের রকেটগুলো, গাইডেন্স কী তা চেনেই না। তাছাড়া এগুলো গতি খুবই কম। মানে লো সাবসনিক। যা আয়রন ডোমে ব্যবহৃত তামির মিসাইলের গতির কাছে শিশু।
৫) গাজা সীমান্তে ইসরাইল প্রয়োজনের তুলনায় বেশি আয়রন ডোম ব্যাটারি মোতায়েন করেছে। যেমন যেখানে রকেট আসার সম্ভবনা ৫০টি, সেখানে ২ ব্যাটারি আইরন ডোম মোতায়ন করেছে। মানে ৫০টির বিপরীতে ১২০টি ইন্টারসেপ্টর মিসাইল রেডি রেখেছে।
৬) একটি ওয়েপনের কার্যকারিতা প্রমাণ করতে ওপেন ব্যাটল গ্রাউন্ডে আসতে হবে। যেমন প্যাট্রিয়েট প্যাক ৩ -এর কথা ধরুন। আপনি যদি আয়রন ডোমকে সেরা ডিফেন্স সিস্টেম বলে থাকেন তাহলে আপনাকে প্যাট্রিয়েট প্যাক ৩ -কে তার বাপ বলতে হবে।
কেননা সম্প্রতি সৌদি আরব এই সিস্টেম দ্বারা হুতিদের প্রায় ৮৫% মিসাইল ইন্টারসেপ্ট করেছে। হুতিদের মিসাইলগুলো ছিলো উচ্চ গতির ও গাইডেন্সযুক্ত ট্যাকটিকেল ব্যালেস্টিক মিসাইল। এবং প্যাট্রিয়েট প্যাক ৩ রাডার উক্ত মিসাইলগুলোর লঞ্চ সাইট সম্পর্কে না জেনেও সফলভাবে মিসাইলগুলোকে ইন্টারসেপ্ট করে ধ্বংস করেছে।
অন্যদিকে আইরন ডোম আগে থেকেই হামাসের রকেট লঞ্চ সাইট সম্পর্কে জানে বা ধারণা করতে পারে। স্থানভেদে এটা কয়েক কিলোমিটার নড়াচড়া হতে পারে।
৭) বেশ কিছুদিন আগে সিরিয়ার একটি এয়ার ডিফেন্স মিসাইল ভুলে ইসরাইলে প্রবেশ করলে আয়রন ডোম সেটিকে ইন্টারসেপ্ট করতে ব্যার্থ হয়। এটি কিন্তু কোনো ক্রুজ বা ট্যাকটিকেল ব্যালেস্টিক মিসাইল নয়।
সিরিয়ার এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের এস-১২৫, বাক। এসব সেকলে আমলের সোভিয়েত স্যাম সিস্টেম দিয়ে টমাহক, হারপুন এবং অনেক ইসরাইলি AGM মিসাইল ধব্বংস করেছে।
যেগুলো কি-না হামাসের রকেট থেকে হাজার গুন উন্নত। এসবের ভিত্তিতে আপনি এস-১২৫ ও বাক মিসাইল সিস্টেমকেও সেরা বলবেন?।
৮) হামাসের রকেটগুলোর গতিপথ আগে থেকেই বোঝা যায়। মানে এটি সরলরেখা বরাবর চলে। তাই আয়রন ডোম আগে থেকেই এটির ব্যাপারে অ্যাকশন নিতে পারে।
তথ্যসূত্র :
১. প্রথম আলো
২. উইকিপিডিয়া
৩. ইঞ্জিনিয়ার্স ডাইরি