কিডনি নিজস্ব কোনো রোগে আক্রান্ত হতে পারে অথবা অন্য কোনো রোগের কারণে কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। যে কারণেই আক্রান্ত হোক না কেন এতে যদি কিডনির কার্যকারিতা তিন মাস বা ততোধিক সময় পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হয় তবে দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ বা ক্রনিক কিডনি ডিজিজ হতে পারে। কিডনি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার জন্য এ রোগটি অনেকাংশে দায়ী। কিডনি রোগ ছাড়াও যদি কিডনির কার্যকারিতা লোপ পায় তাহলেও দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ হতে পারে। যেমন-ক্রনিক নেফ্রাইটিস কিডনির ফিল্টারকে আক্রমণ করে ক্রমান্বয়ে কিডনির কার্যকারিতা কমিয়ে ফেলতে পারে। তেমনি ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ কিডনি রোগ না হওয়া সত্ত্বেও কিডনির ফিল্টার বা ছাঁকনি ধ্বংস করতে পারে। আবার কারো যদি জন্মগতভাবে কিডনির কার্যকারিতা কম থাকে অথবা কিডনির আকার ছোট বা বেশি বড় থাকে তাহলেও দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ হতে পারে।
কি এই কিডনির ছাঁকনি?
প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির প্রতিটি কিডনিতে প্রায় ১০-১২ লাখ ছাঁকনি রয়েছে এবং প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ১৭০ লিটার রক্ত পরিশোধন করে। এই পরিশোধিত রক্তের মধ্যে এক থেকে তিন লিটার শরীরের বর্জ্য পদার্থ প্রস্রাবের মাধ্যমে বের করে দেওয়া হয়। সুতরাং কোনো কারণবশত যদি এ ধরনের ফিল্টার বাধাপ্রাপ্ত হয় তখন কিডনি রোগ হতে পারে।
কিডনির কার্যকারিতা যাচাই করার জন্য রক্তে ক্রিয়েটিনিন পরিমাপ করা হয়। একজন সুস্থ পুরুষ লোকের শরীরে ক্রিয়েটিনিন ১.৪ মিলিগ্রাম এবং মহিলা ১.৩ মিলিগ্রাম বা তার চেয়ে কম থাকাকে স্বাভাবিক ধরা হয়।
কিডনি রোগের জটিলতা
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ ধরনের রোগীদের কোনো উপসর্গ হয় না। যখন উপসর্গ দেখা দেয় তখন কিডনির কার্যকারিতা ৭৫ শতাংশের মতো লোপ পায়। এ কারণে চিকিৎসা করে পরিপূর্ণ সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে আনা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না। কিন্তু প্রাথমিক পর্যায়ে যদি কিডনি রোগ নিরূপণ করা যেত তাহলে আংশিক বা পরিপূর্ণ নিরাময় করা সম্ভব হতো।
দরকার নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা
যেকোনো প্রাপ্তবয়স্ক লোকের উপসর্গ থাকুক বা না থাকুক তার রক্তচাপ নিয়মিত পরিমাপ করা, প্রস্রাবে অ্যালবুমিন নির্গত হচ্ছে কি না তা দেখা ও ডায়াবেটিস আছে কি না তা নিয়মিত পরীক্ষা করা প্রয়োজন। যদি কারো ডায়াবেটিস ধরা পড়ে অথবা ডায়াবেটিসে ভুগে থাকেন, তাঁকে অন্তত বছরে একবার প্রস্রাবে অ্যালবুমিন ও মাইক্রো অ্যালবুমিন যাচ্ছে কি না এবং রক্তে ক্রিয়েটিনিন স্বাভাবিক কি না তা পরীক্ষা করা প্রয়োজন। উচ্চ রক্তচাপের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম প্রযোজ্য।
কিডনি রোগের উপসর্গগুলো সম্বন্ধে সবার ধারণা থাকা প্রয়োজন। যদিও দীর্ঘস্থায়ী কিডনি অকেজো রোগে বমি বমি ভাব, ক্ষুধামন্দা, রক্ত স্বল্পতা, শরীরে পানি জমা, শ্বাসকষ্ট ও প্রস্রাবের পরিমাণের তারতম্য, চর্মরোগ ছাড়াই শরীর চুলকানো এবং ক্রমান্বয়ে দৈনন্দিন কার্যকারিতা লোপ পাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে। দীর্ঘস্থায়ী কিডনি অকেজো রোগে শরীরে হৃদরোগসহ আরো অনেক জটিলতা দেখা দেয়।
হারিয়ে যাচ্ছে বহু প্রাণ
বিভিন্ন হাসপাতালের পরিসংখ্যান থেকে ধারণা করা হয়, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৪০ হাজার রোগী কিডনি সম্পূর্ণভাবে অকেজো হয়ে মারা যায়। কারণ হিসেবে নেফ্রাইট্রিস, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপই বেশি দায়ী। নেফ্রাইটিসের কারণ হিসেবে ব্যাকটেরিয়াজনিত ইনফেকশন, ভাইরাল হেপাটাইটিস, যক্ষ্মা, ম্যালেরিয়া, কালাজ্বর ও ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াকে দায়ী করা হয়। খাবারে রাসায়নিক পদার্থ ও ভেজালের কারণেও নেফ্রাইটিস হতে পারে।
বাংলাদেশে বহু লোক কিডনি রোগে আক্রান্ত। কয়েক বছর আগে পরিচালিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে শতকরা ১৮ ভাগের মতো মানুষ কোনো না কোনো ধরনের কিডনি সমস্যায় আক্রান্ত।
কিডনি অকেজো রোগীর চিকিৎসা
কিডনি সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে গেলে রোগীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন হয় নিয়মিত ডায়ালাইসিস অথবা কিডনি সংযোজন। বর্তমান বিশ্বে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করে একজন রোগী পাঁচ থেকে ১৫ বছর ও সফল কিডনি সংযোজনের মাধ্যমে ১০-১৫ বছর স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে। নিয়মিত ডায়ালাইসিস বলতে সপ্তাহে তিনবার ৪ ঘণ্টা করে হেমোডায়ালাইসিস মেশিনের মাধ্যমে চিকিৎসা করা বোঝায়।
প্রতিরোধের উপায়
এসিই-ইনহেবিটরস ও এআরবি জাতীয় উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ কিডনি রোগ প্রতিরোধে খুবই কার্যকর। ঠিক তেমনি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা, মাইক্রো-অ্যালবুমিন ধরা পড়লে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসা করা প্রয়োজন। এ ছাড়া নিয়মিত ব্যায়াম, ফাস্টফুড না খাওয়া, চর্বি জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলা গেলে কিডনি রোগ প্রতিরোধ সম্ভব। এ ছাড়া ক্ষেত্রবিশেষে চর্বি নিয়ন্ত্রণকারী ওষুধ খেলে, ধূমপান না করলে কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা যায় এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত হৃদরোগ থেকেও রেহাই পাওয়া যায়।
জেনে রাখা ভালো
* দুটি কিডনি প্রতিদিন প্রায় ১৭০ লিটার রক্ত পরিশোধিত করে শরীর সুস্থ রাখে। যেখানে প্রায় ২০-২৫ লাখ ছাঁকনি রয়েছে, যা অনবরত রক্তকে পরিশোধিত করে যাচ্ছে।
* কিডনি রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে, রক্তস্বল্পতা দূর করতে সাহায্য করে ও অস্থি শক্তিশালী করে।
* একটি কিডনি সুস্থ থাকলে শরীর সুস্থ রাখতে পারে।
* কিডনির প্রধান রোগ নেফ্রাইটিস বা নেফ্রোটিক সিন্ড্রম, যা কিডনির ছাঁকনি বা ফিল্টার মেমব্রেনকে ক্ষতবিক্ষত করে। ফলে অত্যাবশ্যকীয় প্রোটিন বেরিয়ে যায়।
* জীবিত অবস্থায় একটি কিডনি কেবল মা-বাবা, ভাই-বোন, ছেলেমেয়েকে দান করতে পারেন। এদের ভেতর রক্তের গ্রুপ বা টিস্যু টাইপ না মিললে তখন আপন চাচা, মামা, ফুফু, খালা বা স্বামী-স্ত্রী একে অন্যকে কিডনি দান করতে পারেন।
* মৃত ব্যক্তি (ব্রেনডেথ-ভ্যান্টিলেটরে থাকা অবস্থায়), আত্মীয়-অনাত্মীয় সবাইকে কিডনি দান করতে পারে।
* ৩০-৪০ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগী কিডনি রোগে ভুগে থাকে।
* উচ্চ রক্তচাপের কারণে ২০-৪০ শতাংশ রোগীর কিডনি অকেজো হতে পারে।
* কিডনি রোগ ছোঁয়াছে নয়, তবে বংশানুক্রমিক হতে পারে।
* বয়স যদি ৪০ বছরের ওপর হয়, ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ থাকে অথবা বংশে যদি কিডনি রোগ থাকে, তবে অবশ্যই রক্ত ও প্রস্রাব পরীক্ষা করুন।
* যত্রতত্র অ্যান্টিবায়োটিক ও ব্যথানাশক ওষুধের ব্যবহারে কিডনি রোগ হতে পারে।
* অতিরিক্ত ডায়রিয়া, বমি ও রক্তক্ষরণে আকস্মিক কিডনি বিকল হতে পারে।
* মেয়েদের গর্ভকালীন উচ্চ রক্তচাপ-পরবর্তী পর্যায়ে কিডনি রোগের কারণ হতে পারে।
পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
ভিটামিন ‘সি’
বাজার থেকে ভিটামিন ‘সি’ ট্যাবলেট কিনে চুষে খাবার অভ্যাস অনেকের আছে। বিশেষ করে বাচ্চাদের অনেকেই দেন। কিন্তু এটি অতিরিক্ত সেবন করলে বিপদ ঘটতে পারে। সাধারণত বাজারে ২৫০ মি.গ্রা. ট্যাবলেট হিসেবে পাওয়া যায়। একজন শিশুর দিনে একটির বেশি ট্যাবলেট নিরাপদ নয়। বড়রা দুটি সেবন করতে পারেন। বেশি মাত্রায় ভিটামিন ‘সি’ খেলে কিডনিতে পাথর হতে পারে। আগে থেকেই সিকল সেল অ্যানিমিয়ায় আক্রান্ত থাকলে ভিটামিন ‘সি’ গ্রহণে সতর্ক থাকা উচিত। ভিটামিন ‘সি’ সাপ্লিমেন্টে সাধারণত চিনি থাকে। এতে রক্তে চিনির মাত্রা বাড়ে। তাই ডায়াবেটিস থাকলে ভিটামিন ‘সি’ ট্যাবলেট না সেবন করাই উচিত। বয়স্ক মহিলাদের ক্ষেত্রে দিনে ৩০০ মি.গ্রা.-এর বেশি ভিটামিন ‘সি’ সাপ্লিমেন্ট হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বাড়ায়। সাধারণত গর্ভকালীন এই ভিটামিন নিরাপদ, তবে বেশি মাত্রায় গ্রহণ করলে গর্ভস্থ শিশুর ক্ষতি হতে পারে।
ডা. এ জেড এম আহসান