২০১০ সালের জানুয়ারিতে একটি অ্যাপেল ইভেন্টে স্টিভ জবস আইপ্যাড উম্মোচন করেন।
৯০ মিনিট ধরে তিনি ব্যাখ্যা করেন কেন এই ডিভাইসটি ছবি দেখা, ফেসবুকে ব্রাউজ করা, গেম খেলা এবং হাজার হাজার অ্যাপ নিয়ে কাজ করার জন্য সেরা উপায়।
এর কিছুদিন পরেই, আইপ্যাড ছোট বাচ্চাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠল।
কিন্তু এখানে মজার বিষয়টি হলো …
স্টিভ জবস তার ছেলেমেয়েদের এই ডিভাইসটি ব্যবহার করতে দিতে রাজি হয়নি।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, “আমরা বাড়িতে আমাদের ছেলেমেয়েদের কতটা প্রযুক্তি ব্যবহার করবে সেটা সীমাবদ্ধ রাখি।”
এবং জবস-ই একমাত্র টেক মুঘল ছিলেন না যে তার সন্তানদের তার নিজের তৈরি করা প্রযুক্তি ব্যবহার করতে সাবধান ছিলেন।
মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটসও তার ছেলেমেয়েদের বেশিরভাগ সময় প্রযুক্তিবিহীন পরিবেশে বড় করেছেন।
গুগলের সিইও সুন্দর পিচাই এবং স্ন্যাপচ্যাটের সিইও ইভান স্পিগেল তাদের বাচ্চাদের ওপর ‘সাপ্তাহিক ছুটিতে কোনো স্ক্রিন টাইম নেই’ – এমন নিয়ম আরোপ করেছেন। তাদের বাচ্চাদের স্কুলের কাজের জন্য কম্পিউটার প্রয়োজন হলেই কেবল তারা তাদের অবস্থান নরম করেন।
টিকটকের সিইও শৌ চিউ তার ৮ ও ৬ বছরের বাচ্চাকে টিকটক ব্যবহার করতে দেন না।
ফেসবুকের প্রতিষ্ঠাতা এবং ইন্সটাগ্রামের মালিক মার্ক জুকারবার্গও তার ছেলেমেয়েদের স্ক্রিন টাইম মনিটর করেন।
নতুন প্রযুক্তি তৈরি করা একই মানুষরা কেন তাদের সন্তানদের এটি থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করে তা আমি জানতে চেয়েছিলাম।
তা জানতে গিয়ে আমি জেনে গেছি, অতিরিক্ত স্ক্রিন টাইমে মানসিক স্বাস্থ্যের মারাত্মক ফলাফল সম্পর্কে।
কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই, কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে বিষণ্নতা এবং দীর্ঘস্থায়ী উদ্বেগের হার সর্বকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। আর বাংলাদেশে তো এ নিয়ে বিস্তারিত তেমন কোনো গবেষণাই পাওয়া যায় না।
যা-ই হোক, স্ক্রিন টাইম বাচ্চাদেরকে ৪ উপায়ে প্রভাবিত করে।
১. আচরণ
স্ক্রিন টাইমের উত্তেজনাপূর্ণ প্রকৃতি ডোপামিন রিলিজ করে।
এটি একটি ভালো-অনুভূতির নিউরোট্রান্সমিটার, যা আমাদের বাচ্চাদেরকে স্ক্রিনে সময় দিতে আনন্দ দেয়। ফলে তারা আরও বেশি সময় কাটাতে চায়।
সময়ের সাথে সাথে, মস্তিষ্ক এই উচ্চ মাত্রার ডোপামিনের সাথে খাপ খায়…
এবং যখন শিশু ডিজিটাল কার্যকলাপে নিযুক্ত থাকে না, তখন তাদের মস্তিষ্কে পর্যাপ্ত ডোপামিন থাকে না এবং শিশুটি ডোমামিন প্রত্যাহারের লক্ষণগুলি অনুভব করে।
এর ফলে বিরক্তি, ক্ষোভ ও আক্রমণাত্মক মনোভাব প্রকাশ পায়।
২. স্কুলের কাজ এবং অ্যাকাডেমিক কর্মক্ষমতা
গবেষণায় নিশ্চিত হওয়া গেছে, যে শিশু যত বেশি সময় ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে, তার বাড়ির কাজ শেষ করার সম্ভাবনা তত কম।
কিন্তু আপনার সন্তানের স্ক্রিন টাইমের আরও সূক্ষ্ম নেতিবাচক পরিণতি রয়েছে।
২০২৩ সালে, মন্ট্রিল ইউনিভার্সিটির তিনজন গবেষক দেখেছেন- যে বাচ্চারা স্ক্রিনে বেশি সময় কাটায় তাদের মনোযোগ কম ছিল, যা ADHD বৃদ্ধিতে অবদান রাখে।
আপনি নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন যে, আজকের বেশিরভাগ সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম আপনাকে (এবং আপনার বাচ্চাদের) অল্প মনোযোগ দেওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ দেয়।
TikTok ভিডিও এবং Instagram স্টোরি সাধারণত মাত্র কয়েক সেকেন্ডের হয় – ঘন্টাব্যাপী দীর্ঘ নয়। ফেসবুক রিল ও ইউটিউব শর্টও একই রকম।
একজন কিশোর যে ইনস্টাগ্রামে দিনে এক ঘণ্টা স্ক্রোল করে সে হয়তো ১০০ টিরও বেশি বিভিন্ন পোস্ট, রিল এবং গল্পের মধ্য দিয়ে যেতে পারে।
প্রতিটি দিন, তাদের মস্তিষ্ককে অতি-স্বল্প সময়ের জন্য মনোযোগ দেওয়ার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
এর মানে হল যে, তাদের ক্লাসে মনোনিবেশ করতে এবং ফোকাস করার চেষ্টা করতে কষ্ট হয়। যা অ্যাকাডেমিক পারফরম্যান্সের সামগ্রিক পতনের দিকে নিয়ে যায়।
৩. শারীরিক স্বাস্থ্য
২০১০-এর দশকের গোড়ার দিকে বাচ্চারা যে পরিমাণ সময় ঘুমিয়ে কাটাত তা হ্রাস পেয়েছে। আজকাল, ৩০ শতাংশ বাচ্চা, প্রি-স্কুলার এবং স্কুল-বয়সী শিশু অনিদ্রা ও অপর্যাপ্ত ঘুমের সমস্যায় ভুগছে।
বিশ্বব্যাপী অনেক গবেষণায় দেখা গেছে যে, এটির ঠিক কারণ হলো শিশুদের ঘুমানোর আগে ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করা বা তাদের সংস্পর্শে আসা।
ব্যায়াম বা অন্যান্য শারীরিক ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহণও হ্রাস পেয়েছে। এটি দুর্ভাগ্যজনক! কারণ ঘুমের মতো ব্যায়ামও মানসিক ও শারীরিক উভয় স্বাস্থ্যের উন্নতি করে।
কিন্তু সম্ভবত ফোন-ভিত্তিক শৈশবকালের সবচেয়ে বিধ্বংসী বিষয় হলো- শিশুরা অন্য লোকেদের সাথে মুখোমুখি আলাপচারিতার সময় কাটাতে পারে না। ফলে দেরি করে কথা বলা, নিজের ভাব প্রকাশ করতে না পারা ইত্যাদি সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় উচ্ছৃঙ্খল আচরণ, জেদ ইত্যাদির মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করছে তারা।
৪. সম্পর্ক
যেখানে ২০১০ সালের আগে, বাচ্চারা তাদের বন্ধুদের সাথে প্রতিদিন গড়ে ২ ঘন্টা ব্যয় করত (স্কুল টাইমের বাইরে)… এই সংখ্যা ২০১৯ সালের মধ্যে ১ ঘণ্টা ৭ মিনিটে নেমে এসেছে।
এটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ শিশুদের সামাজিক দক্ষতা, সহানুভূতি, সহনশীলতা ও আত্মবিশ্বাস বিকাশের জন্য সামাজিক মিথস্ক্রিয়া প্রয়োজন। এই দক্ষতা ও ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্য তাদেরকে পরবর্তী জীবনে স্বনির্ভর হতে সাহায্য করে।
এবং এই প্রবণতাটি অন্য একটি কারণেও উদ্বেগজনক…
ডিজিটাল ডিভাইসগুলো পরিবারকে খণ্ডিত করছে।
যেহেতু আপনার সন্তানেরা ডিজিটাল বিশ্বে বেশি সময় কাটাচ্ছে, তাই পরিবার হিসেবে একসঙ্গে মানসম্পন্ন সময় কাটানো কঠিন। রাতে খাবার টেবিলে অথবা সপ্তাহান্তে ঘুরতে বের হওয়া ছাড়া তাদের সাথে সময় কাটানো হয় না।
এর মানে হলো আপনার সন্তান আপনার পরিবর্তে তার স্ক্রিনের সাথে সংযোগ করতে বেশি সময় ব্যয় করে… এবং হয়তো টের পাচ্ছেন যে, আপনি ধীরে ধীরে তাদেরকে হারিয়ে ফেলছেন।
এখন কেউ কেউ মনে করতে পারেন, বাচ্চাদের ওপর স্ক্রিনের নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে জানার পর, তারা তাদের ডিজিটাল ডিভাইসগুলিতে কম সময় ব্যয় করতে শুরু করবে।
যদিও বাস্তবতা সম্পূর্ণ উল্টো…
বর্তমানে, বাচ্চারা ২০১১ সালের তুলনায় স্ক্রিনে ১০ গুণ বেশি সময় ব্যয় করে।
মনে হচ্ছে আমরা, পিতামাতা হিসাবে, ডিজিটাল দৈত্যের সাথে লড়াই করছি। যা দিন দিন তার শক্তিতে বাড়ছে এবং আমাদের বাচ্চাদের ওপর আরও শক্তভাবে আঁকড়ে ধরেছে।
আমরা জেতার জন্য আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করছি কিন্তু আমরা যাই করি না কেন – কোন না কোনভাবে – আমরা ব্যর্থ হচ্ছি।
এবং এর কারণ হলো আমরা প্রায়শই এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করি যেগুলি কেবল অকার্যকরই নয় বরং বিপরীতমুখীও।
আগামী দিনে, আমি আপনাকে বলব- কোন ব্যবস্থাগুলি কাজ করে না এবং এর পরিবর্তে আপনি কী করতে পারেন।
জানতে চাইলে লেখাটি শেয়ার করে নিজের ওয়ালে রেখে দিন কিংবা কমেন্ট করে আগ্রহের কথা জানান।