ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইন্সট্রাগ্রাম কিছুই যখন ছিলোনা, সেই আমলে আমি একবার ব্লাইন্ড ডেটে গিয়েছিলাম।
সে বহুকাল আগের কথা। ভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারে পড়তাম তখন। ১০ টাকা মিনিট মোবাইলে কথা বলতাম, হলের ডাইনিং এ ৮ টাকায় প্রতিবেলা ভাত খাইতাম।
তখন বাংলাদেশে নতুন নতুন কিছু চ্যাট সাইট আসছে। বাসায় হাত পেতে ৩০ টাকা যোগার করে সাইবার ক্যাফেতে গিয়েই সাইটে উকি মারতাম। ছেলের আইডিতে মেয়ে, নাকি মেয়ের আইডিতে ছেলে, বোঝার উপায় নেই।
উকি মারতে মারতে একজনের সাথে মাঝেমাঝেই সুখ দুঃখের কথা শেয়ার করা শুরু হয়ে গেলো। একসময় মাঝেমাঝে থেকে সেটা নিয়মিত হয়ে পড়লো। একসময় তাকে ভাবের সাথে জানালাম, আমার একটা মোবাইল আছে। কর্ডলেস টেলিফোনের মতো এন্টেনা সহ। সে জানালো, আমার ভাব নেয়ার কিছুই নেই কারণ তারও একটা মোবাইল আছে। সেটা আবার এক ডিগ্রি আধুনিক, ফোল্ড করা যায়।
উৎসাহী হয়ে নাম্বার অদলবদল করে ফেললাম। এতোদিন পর বিড়ালের ভাগ্যে শিকা ছিড়লেও ছিড়তে পারে।
শুরু হয়ে গেলো কল দেয়া। সারাদিন উশখুশ করে রাত ১২ টা বাজার জন্য অপেক্ষা করতাম। রাত ১২ টা বাজলেই কিছু কম টাকায় কথা বলা যেতো। স্পেশাল অফার।
সে প্রায়ই আমকে জানাতো, সুন্দরী হবার চরম যন্ত্রণা ভোগ করছে। বাসার সামনে ছেলেরা লাইন ধরে দাড়িয়ে থাকে ভার্সিটি যাবার সময়। ছেলেদের প্রপোজে সে অস্থির। ওর এসবের কিছুই ভালো লাগেনা। ওর শুধু আমার সাথেই কথা বলতে ভালো লাগে।
হাওয়ায় ভেসে ভেসে আবেগের চোটে আমার বালিশের নিচে কখন যে ১০০ টাকার কার্ডের পাহাড় জমে গেছে, টেরও পাইনি। এরই মাঝে হঠাৎ সে একদিন আমাকে জানালো, এখন সময় হয়েছে দুজনের দেখা করার। সে আর পারছেনা আমাকে না দেখে থাকতে।
ফার্মগেট এর একটা কলেজ ভর্তি কোচিং সেন্টারে ক্লাস নেই তখন। সে সময় ভালো কলেজগুলো ভর্তি পরীক্ষা নিতো, এটা অনেকেরই মনে থাকার কথা। আগের দিন বেতন হবার কারনে পকেট গরম ছিল। জোশের চোটে আসাদ গেটের এক চাইনিজ রেস্টুরেন্টে আসতে বললাম। ১০০ টাকায় হাইফাই সেট মেনু পাওয়া যেতো। ২০০ টাকাতে লাইলী মজনুর প্রেম কাহিনী কমপ্লিট।
দেখা হবার দিন ঘনিয়ে আসতে লাগলো, আমিও ভাবের চোটে সাত আসমানে ভাসতে থাকলাম। ঢাকার সবচাইতে সুন্দরী মেয়ে আর কাউকে পাত্তা না দিয়ে আমার সাথে ব্লাইনড ডেটে আসতাসে, আর কি চাই এই জীবনে?
অবশেষে সেই স্বপ্নের দিন আসলো। আমিও খুশি খুশি মনে দৌড়ে গেলাম। দুচোখ ভরা রঙিন স্বপ্ন। কদিন আগেই কলেজ জীবনের প্রেমিকা ছ্যাকা দিয়েছে। আজ আমার আবার একটা গতি হবেই হবে। টেবিলের ওই পাশে আমার অপেক্ষায় মাধুরী ঐশ্বরিয়া, এই পাশে আমি, সাথে বহমান প্রেমের নীল দরিয়া।
চমক অবশ্য অপেক্ষা করছিল, কাহিনীতে পুরাই টুইস্ট। টেবিলের চার চেয়ারে চারজন সুমো কুস্তীগির অপেক্ষা করছিলো আমার জন্য। সুপার জামবো জেট সাইজের। এদের ভেতর ডায়নোসর টাইপ একজন আমার দিকে হাত নাড়ল, হাই বাবু, এতো দেরি করলা কিজন্য?
আমার মনে হলো, অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাবো। সে বলেছিলো, সুপার স্লিম ফিগার। কোনোই মিল পেলাম না। ঢোক গিলে প্রমাদ গুনলাম, ৫ টা সেট মেনু ৫০০ টাকা। ৩০০ টাকা বাড়তি বাশ যাবে।
পাশেই বসলাম শুকনা মুখে। সবাই এমন ভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছিলো, ঠিক যেভাবে শিকারের সময় বাঘ মামা হরিণ ছানার দিকে তাকায়।
আমার ব্লাইনড ডেট কন্যা আমাকে জানালো, তার তিন বেস্ট ফ্রেন্ড তাদের অনেক দরকারি কাজ ফেলে শুধু আমাকেই দেখতে আসছে। আমার রাজকীয় কপালই বটে।
আমি কাষ্ঠ হাসি দিলাম এই সৌভাগ্যের জন্য।
খাবারের মেনু চলে আসলো। সেট মেনুর তোয়াক্কা না করেই অর্ডার দেয়া শুরু হয়ে গেলো সবার। আমি আড়চোখে মেনুর দিকে তাকালাম। টের পেলাম, হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। খাবারের দাম ক্যালকুলেশন করে দেখলাম, আমার ভার্সিটির হলের এক মাসের খাবার বাজেট এই চার সুমো আজ উড়িয়ে দিবে। ফাঁকতালে আমি ছিটাফোটা কিছু হয়তো ভাগে পাবো।
পকেটের দিকে তাকালাম। ৫০০ টাকার ৬ খানা নোট উকি দিচ্ছে, কোচিং থেকে পাওয়া এই মাসের বেতন। আর কিছুক্ষণ পর সেখানে সর্বোচ্চ দশ বারো টাকা থাকবে। দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, সদ্য সাবেক প্রেমিকার পিছনে এই টাকা খরচ করলে আমারে মাথায় নিয়া নাচতো।
খাবার চলে আসলো টেবিলে। শরণার্থী ক্যাম্পের খাবার বিতরণের সময় ও সম্ভবত এরকম কাড়াকাড়ি হয়না। সবাই সব ভুলে খাবারের ওপর ঝাপিয়ে পড়লো। মাঝে মাঝে অবশ্য খাওয়া থামিয়ে জানাচ্ছিল, খুবই বিচ্ছিরি হয়েছে রান্না। এই ফালতু খাবার খাওয়ার জন্য সময় নষ্ট করে এখানে আসাটাই ভুল হইসে।
ওদের খাবার খাওয়ার ধরণ দেখে সেরকম অবশ্য মনে হচ্ছিলনা। মনে হচ্ছিল এটাই জীবনের আখেরি খাওয়া। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে পকেটের ৬ খানা ৫০০ টাকার নোটের দিকে তাকাচ্ছিআর মাসের বাকি দিনগুলো পার করার উপায় খুজছি।
আমার ডায়নোসরের মোবাইলে একটু পরপরই কল আসছিলো। সে রিসিভ না করে বারবারই কেটে দিচ্ছিল। এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে মোবাইল রিসিভ করে চাপা গলায় বলল, ইম্পরট্যান্ট একটা ক্লাসে আছি, তুমি কখনোই কিছু বুঝতে চাওনা। খালি অবুঝের মতো কর। একটু পরে ক্লাস শেষে কল দিচ্ছি।
আমার দিকে তাকিয়ে কাষ্ঠ হাসি দিয়ে বললো, আমার মা, আমাকে নিয়ে খালি টেনশন করে।
আমার জেমস বন্ড আর মাসুদ রানার কান ততক্ষণে মোবাইল থেকে হাল্কা ভাবে ভেসে আসা ব্যাটা ছাওয়ালের গলার আওয়াজ শুনে ফেলেছে। তারচেয়েও বড় কথা, ইম্পরট্যান্ট একটা ক্লাসে আছি, তুমি কখনোই কিছু বুঝতে চাওনা, খালি অবুঝের মতো করো, ক্লাস শেষে কল দিচ্ছি, ইত্যাদি ইত্যাদি আমাকেও প্রায়ই শুনতে হয়। তখনো ঠিক এরকমই চাপা গলা থাকে আমার স্লিম ফিগারের ডায়নোসরের।
বুঝতে আর কিছুই বাকি থাকলোনা। নিজের অজান্তেই ঠোটের কোনে হাসি ফুটে উঠলো। বুকের ভেতরটা হালকা হয়ে গেলো একদম। মাথায় কাঁঠাল ভাঙ্গা গ্যাং এর পাল্লায় পড়েছি এটা। আমার মতো আরো একাধিক বলদ এদের কালেকশনে আছে।
নিশ্চিন্ত মনে আরাম করে কবজি ডুবিয়ে খাওয়া দাওয়া করলাম। এরপর ভাব নিয়ে বললাম, আসলেই ফালতু রান্না। আগামী সপ্তাহে সময় বের করো সবাই, শেরাটনে খাইতে যাবো। বুফে লাঞ্চ, হেব্বি টেস্ট।
চারজন একে অপরের দিকে অর্থপূর্ণ হাসি দিলো। মক্কেল তাদের জালে ধরা পড়ে গেছে।
খাওয়া শেষে আমি ওয়াশরুম গেলাম হাত ধুতে। ভেতর থেকে উঁকি মেরে দেখলাম, উত্তেজিত হয়ে চারজন শলাপরামর্শ করছে। এরকম বলদ রোজ রোজ পাওয়া যায় না আফটার অল।
মোবাইল সুইচ অফ করে আস্তে করে বের হয়ে পড়লাম। ডায়নোসরের দল না দেখলেই জানে বেঁচে যাই। বের হতে না পারলে পকেটের একটা নোটও বাচাতে পারবোনা আজ।
গেট দিয়ে বের হতেই ওয়েটার এর সাথে দেখা। হাসিমুখে বললাম, ম্যাডামের জন্য মোবাইল কার্ড আনতে যাচ্ছি। ওয়েটার হাসিমুখে মাথা নাড়ল।
কপাল ভালো, রাস্তায় ভিড়ের ভেতর সাভারের বাস দাঁড়ানো ছিল। আস্তে করে বাসে গিয়ে দাড়িয়ে পড়লাম। সোজা আমার ইউনিভার্সিটি, এরপর হল, সবশেষে টানা লম্বা একটা ঘুম। শান্তির ঘুম, মুক্তির ঘুম।
সন্ধ্যায় আমার মোবাইল অন করা মাত্রই গালাগালি সহ দুই তিনটা এসএমএস রিসিভ করলাম। এসএমএস গুলোর সারমর্ম, আমার মতো চিটার বাটপারকে রাস্তার মোড়ে টাঙ্গিয়ে এক চোট পিটিয়ে এরপরে গুলি করে মারা উচিত।
এসএমএস ডিলিট করে হলের নিচের ঢালের টং দোকানে বসে হাক দিলাম, ঝাল পেয়াজ বেশি দিয়ে ডাবল ডিম এর মামলেট আর দুইটা পরোটা তেল ছাড়া। তাড়াতাড়ি কর, দুপুরে যা যা খাইসি, ঘুমের সাথে সবই হজম হয়ে গেছে।
টুং টুং করে মোবাইলের মেসেজ টোন বেজেই চলেছে। অভিশাপ দিয়ে আমার চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে একটানা মেসেজ পাঠিয়েই যাচ্ছে আমার ব্লাইনড ডেট।
আমার বয়েই গেছে সেই মেসেজ দেখতে। ফালতু জিনিসের জন্য টাইম নাই। তারচেয়ে বরং বন্ধুদের সাথে ঘুরে আসি। বহুদিন হলো দলবেধে কাঠাল চুরি করিনা। টাকা খরচ করে কেনা কাঠালের চাইতে চুরি করা কাঠালের টেস্ট সবসময়ই বেশি হয়।