শিশুদের বিছানায় প্রস্রাব বা বেডওয়েটিং কেন হয়? কী করবেন?

285
বিছানায় প্রস্রাব

ঘুমের মধ্যে বিছানায় বাচ্চার প্রস্রাব করা তথা বেডওয়েটিং নিরাময় যোগ্য একটি রোগ। তিন বছর বয়সের পর কোনো শিশুরই বিছানায় প্রস্রাব করার কথা নয়। তবে ছেলেশিশুর ক্ষেত্রে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত বিষয়টি মেনে নেওয়া যেতে পারে। মেয়েশিশুদের অবশ্য তিন বছর বয়সেই বিছানায় প্রস্রাব বন্ধ হওয়ার কথা। নির্ধারিত বয়স পেরিয়ে যাওয়ার পরও শিশু বিছানায় প্রস্রাব করতে থাকলে শিশুবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।

শিশুদের বিছানায় প্রস্রাব কেন হয়

শিশুর প্রস্রাব–পায়খানা করার অভ্যাস গড়ে ওঠে শিশুকাল থেকে দেওয়া প্রশিক্ষণের ওপর। অনেক মা ৯-১০ মাস বয়স থেকে মুখে শিস দেওয়ার মতো আওয়াজ করে শিশুকে সময়মতো প্রস্রাব করান। নির্দিষ্ট সময় পরপর পটিতে বা কমোডে বসিয়ে প্রস্রাব করানোর অভ্যাসও করেন অনেকে। শিশুর ৯-১৫ মাস বয়সের মধ্যে এই প্রশিক্ষণ শুরু করা উচিত। পরবর্তী সময়ে এই প্রশিক্ষণ বেশ সহায়ক হয়। তবে অনেক মা-বাবাই ব্যাপারটিকে অবহেলা করেন। শিশু যখন যেখানে খুশি প্রস্রাব করছে দেখেও উদাসীন থাকায় প্রশিক্ষণ ঠিকমতো হয় না। এ ধরনের শিশুরা পরবর্তী সময়ে অনেক দিন ধরে বিছানায় প্রস্রাব করে।

শিশুর মানসিক অশান্তি, অনিরাপত্তাবোধ, নতুন জায়গা, মা-বাবার অনুপস্থিতি, বিছানা পরিবর্তন, হতাশা প্রভৃতি কারণে বিছানা ভেজানোর মতো ঘটনা ঘটতে পারে। কারণ চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে অনেক সময় সুফল পাওয়া যায়।

কিডনি ও প্রস্রাবের পুরো ব্যবস্থার কোথাও ত্রুটি থাকলেও রাতে বিছানায় প্রস্রাব করতে পারে শিশু। বিশেষত মূত্রনালির সংক্রমণ, বহুমূত্র রোগের কারণে যেমন ডায়াবেটিস ইনসিপিডাস ও মেলিটাস, ক্রনিক রেনাল ফেইলিওর প্রভৃতি কারণে শিশু বিছানা ভেজাতে পারে। এ ছাড়া ঘুমের মধ্যে যেসব শিশুর মলদ্বার চুলকায়, তারাও বিছানায় প্রস্রাব করতে পারে। অনেক সময় মলদ্বারে সুতাকৃমি জড়ো হওয়ায় এমনটা হয়ে থাকে। কারণ যা-ই হোক না কেন, চিকিৎসকের পরামর্শে তা চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে।

অনেক ক্ষেত্রে জন্মগত বা বংশগত প্রস্রাবের থলির স্প্রিন্টারের অপরিপক্বতা বা ঢিলার কারণে হয়। যদি মা-বাবা উভয়েই শৈশবে রাত্রিকালীন বিছানায় প্রস্রাবের রোগে ভুগে থাকেন, তাহলে তাঁদের শিশুর ৭৫ শতাংশের এই রোগের ঝুঁকি থাকে। আর যদি পারিবারিক ইতিহাস না থাকে, তবে এই রোগে ভোগার ঝুঁকি ১৫ শতাংশ। এ ছাড়া মানসিক টেনশন, যেমন—স্কুলের পড়াশোনার চাপে বিছানা ভেজানোর সমস্যা বেশি দেখা যায়। ১৫ শতাংশ ক্ষেত্রে প্রস্রাবে সংক্রমণ ও প্রদাহ দায়ী।

এছাড়াও নিচের বিষয়গুলোকে দায়ী করেন অনেক গবেষক। যেমন—

ছোট মূত্রথলি : মূত্রথলি ছোট হলে রাতে প্রস্রাব ধরে রাখার যথেষ্ট সক্ষমতা থাকে না। মূত্রথলি নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ুগুলোর পরিণত হওয়ার গতি ধীর হলেও এই সমস্যা হতে পারে।

হরমোন ভারসাম্যহীনতা : ভারসাম্যহীনতার কারণে দেহে পর্যাপ্ত অ্যান্টি-ডিউরেটিক হরমোন (ADH) উৎপাদন করে না। তখন বিছানায় প্রস্রাব করার মতো সমস্যা হয়।

মূত্রনালির সংক্রমণ : এই সংক্রমণ মূত্রত্যাগ নিয়ন্ত্রণ করা বাধাগ্রস্ত করে তুলতে পারে। তখন বিছানা ভেজা, ঘন ঘন প্রস্রাব, লাল বা গোলাপি প্রস্রাব এবং প্রস্রাবের সময় ব্যথা থাকতে পারে।

নিদ্রাহীনতা : কখনো কখনো নিদ্রাহীনতা বা ঘুমের ব্যাঘাতের কারণেও বিছানা ভেজায়।

ডায়াবেটিস : যে শিশুটি সাধারণত রাতে বিছানায় প্রস্রাব করে না তাদের ক্ষেত্রে হঠাৎ সেটা ঘটলে ডায়াবেটিসের প্রথম লক্ষণ হতে পারে। অন্য লক্ষণগুলোর মধ্যে প্রচুর পরিমাণে প্রস্রাব হওয়া, তৃষ্ণা বৃদ্ধি, ক্লান্তি এবং ওজন হ্রাস অথচ ক্ষুধা থাকতে পারে।

দীর্ঘস্থায়ী কোষ্ঠকাঠিন্য : যেহেতু একই পেশি মূত্র এবং মল নির্মূল নিয়ন্ত্রণে ব্যবহূত হয়, তাই কোষ্ঠকাঠিন্য দীর্ঘমেয়াদি হলে এই পেশিগুলো অকার্যকর হয়ে উঠতে পারে এবং রাতে বিছানা ভেজানোর কারণ হয়ে উঠতে পারে।

মূত্রনালি বা স্নায়ুতন্ত্রের কাঠামোগত সমস্যা : শিশুর স্নায়বিক সিস্টেম বা মূত্রতন্ত্রের একটি ত্রুটির সঙ্গেও এটি সম্পর্কিত।

চাপ ও উদ্বেগ : চাপ ও উদ্বেগ জাতীয় বিষয়, যেমন—বড় ভাই বা বোন হওয়া, নতুন স্কুল শুরু করা বা বাড়ির বাইরে রাতে ঘুমানো—বিছানা ভেজানোর কারণ বা ট্রিগার হতে পারে।

এডিএইচডি বা অতি চঞ্চলতা : যে শিশুদের মনোযোগ ঘাটতি, হাইপার অ্যাক্টিভিটি ডিসঅর্ডার (এডিএইচডি) বা অতি চঞ্চলতা আছে, তাদের মধ্যে বিছানা ভেজানোর সমস্যা বেশি দেখা যায়।

বিছানায় প্রস্রাব : শিশুকে তিরস্কার করবেন না
শিশু বিছানায় প্রস্রাব করলে তা নিয়ে তাকে কোনো রকম বকাঝকা বা তিরস্কার করা যাবে না। এতে শিশু উদ্বিগ্ন ও বিব্রত হবে, সমস্যা বাড়বে।

শিশুদের বিছানায় প্রস্রাব বন্ধে যা করবেন

  • সন্ধ্যার পর জলীয় খাবার কম খাওয়ানো বা খেতে না চাইলে না দেওয়া।
  • রাতে ঘুমানোর আগে এবং প্রয়োজনে ভোররাতে আরেকবার উঠিয়ে শিশুকে প্রস্রাব করানো।
  • সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো শিশু বিছানায় প্রস্রাব করলে তা নিয়ে তাকে কোনো রকম বকাঝকা বা তিরস্কার করা যাবে না। এতে শিশু উদ্বিগ্ন ও বিব্রত হবে, সমস্যা বাড়বে।
  • চাইলে ভিন্ন রকম উদ্যোগ নিতে পারেন। শিশুকে একটি ডায়রি দিন। সপ্তাহের যে দিন সে বিছানায় প্রস্রাব করবে না, সে দিনটির তারিখে একটা তারকা চিহ্ন দিয়ে নির্দিষ্ট করতে বলুন তাকে। এরপর শিশুকে বলতে হবে, সপ্তাহে কয়েকটি তারকা চিহ্ন পেলে সে তার ইচ্ছানুযায়ী একটা পুরস্কার পাবে। এভাবে সে-ই সংগ্রাম করতে চাইবে ও নিজের সমস্যার সমাধানে মনোযোগী হবে। এই পদ্ধতিতে প্রায় ৭০-৮০ ভাগ ক্ষেত্রে উপকার পাওয়া যায়।
  • খুব অল্প ক্ষেত্রেই এ সমস্যা সমাধানে ওষুধের আশ্রয় নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে শিশুবিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা নেওয়া বাঞ্ছনীয়।

বাচ্চাদের বিছানায় প্রস্রাব বন্ধের ঔষধ

কখনো কখনো শেষ অবলম্বন হিসেবে বিছানা ভেজানো বন্ধ করতে অল্প সময়ের জন্য ওষুধ প্রয়োজন হয়। বিভিন্ন ধরনের ওষুধ আছে :

অ্যান্টিকোলিনেরজিক ওষুধ : এ ধরনের ওষুধ যেমন—অক্সিবটেনিন (ডাইট্রোপানএক্সএল) মূত্রাশয়ের সংকোচনের পরিমাণ হ্রাস করতে এবং মূত্রাশয়ের ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করতে পারে। বিশেষত যদি দিনের বেলাও ভিজে যায়। এই ওষুধটি অন্যান্য ওষুধের সঙ্গে ব্যবহার করতে হয় এবং অন্যান্য চিকিৎসা ব্যর্থ হলে সাধারণত দেওয়া হয়।

ইমিপেরামিন ও ডেসমোপেরেসিন ওষুধ দুটি তাৎক্ষণিকভাবে ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে প্রকোপ কমিয়ে দিতে পারে। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আবার সমস্যা ফিরে আসে। অল্প সময়ের জন্য কোনো ক্যাম্প বা বন্ধুদের সঙ্গে কোনো ভ্রমণ বা ছুটি কাটাতে এই ওষুধ দুটি ব্যবহার করা যেতে পারে।

রাতে প্রস্রাব উৎপাদন ধীরকরণ : মুখে খাবার ওষুধ Desmopressin (DDAVP) রাতে প্রস্রাব উৎপাদন হ্রাস করে। তবে এটি শুধু পাঁচ বছরের বেশি বয়সীদের জন্য। মিনিরিন মেল্ট ট্যাবলেটে ভাসোপ্রেসিন হরমোন থাকে, যা বারবার প্রস্রাব করার প্রবণতা বা প্রস্রাবের পুনরাবৃত্তির হার এবং পরিমাণ হ্রাস করে। নিয়মিত ব্যবহার করতে হয়। তবে ওষুধের পাশাপাশি অত্যধিক পানি পান করলে সমস্যার সমাধান হয় না।

যদি সে ১৬ সপ্তাহের চিকিৎসায় ১৪ দিন শুকনো থাকে, তবে মনে করা যেতে পারে সে প্রাথমিক শুকনো রাখার প্রক্রিয়ায় সাড়া দিচ্ছে। আর যদি দুই বছর পর্যন্ত সে অব্যাহতভাবে শুকনো প্রক্রিয়ায় থাকে, তাহলে সারা জীবনের জন্য সে সুস্থ হয়েছে ধরে নেওয়া যায়।

শিশুদের বিছানায় প্রস্রাব করার হোমিও ওষুধ

সাইকোসোমেটিকের কারণে (ভয়, চিন্তা, অপমান, ক্রোধ) অথবা শারীরিক সমস্যা অর্থাৎ মূত্রনালীতে স্ফিঙ্কটার মাংসপেশীর দুর্বলতার জন্য এই সমস্যা হতে পারে। সঠিক পদ্ধতিতে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় খুব অল্প সময়ের মধ্যেই বিছানায় প্রস্রাব করার সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

স্নায়বিক উত্তেজনা, ক্রিমি দোষ প্রভৃতির কারণে মূত্রাশয়ের সংরক্ষণ শক্তির হ্রাস পেলে কিছু বেশি বয়সেও শিশু ঘুমন্ত অবস্থায় অসাড়ে বিছানায় প্রস্রাব করে।

  • ক্রিমির জন্য হলে সিনা ৩X, ২০০।
  • অ্যাসিড ফস : স্নায়ুতন্ত্রের কারণে মানসিক ও শারীরিক অক্ষমতা (রাতে বিছানায় মূত্রত্যাগ) নিয়ন্ত্রণ করতে উপযোগী।
  • ক্রিয়োজোট : রাতের প্রথম প্রহরে বিছানায় প্রস্রাব করা নিয়ন্ত্রণ করে। বাচ্চা নিদ্রায় স্বপ্ন দেখে যে সে বাথরুমে প্রস্রাব করছে। বিছানায় প্রস্রাব করে সে অপরাধ বোধে ভোগে। প্রস্রাবের ইচ্ছা হলে শিশু নিজেকে রুখতে পারে না।
  • স্ট্যাফিসেগ্রিয়া : মূত্রাশয়ের ক্রিয়া প্রণালীতে খারাপ বোধ হওয়া, খিটখিটেপণা ও ঘাবরানির লক্ষণ দেখা যায়। পরিণাম স্বরুপ না চাইলেও প্রস্রাব করার ইচ্ছা হয়। বার বার প্রস্রাব হওয়ার জন্য সে প্রস্রাবের বেগ রুখতে পারে না। এই সমস্যার সমাধানে স্ট্যাফিসাগ্রিয়া খুব ভালো কাজ করে।
  • পেট্রোসেলিনাম স্যাটিভাম : এটি মূত্রত্যাগের ইচ্ছা নিয়ন্ত্রণ করে মাংসপেশীর খিঁচুনি কম করে। এই প্রকারে মূত্রথলিতে মূত্র রোধ করার ক্ষমতা শোধরায়।
  • ট্যাবেকাম : এটি স্ফিঙ্কটার এর দুর্বলতা দূর করে বিছানা ভিজানোর লক্ষণ গুলো নিয়ন্ত্রণ করে।
  • ফেরাম ফস : এটি স্ফিঙ্কটার এর দুর্বলতা থেকে নকচ্যুরাল অনুরোসিস এর জন্য শ্রেষ্ঠ। এই রোগ হলে বাচ্চার রং হলুদ বর্ণের হয়ে যায়। তার রক্ত স্বল্পতা দেখা দেয় ও বার বার প্রস্রাব করার ইচ্ছা প্রকাশ করে
  • গভীর ঘুমের সময় প্রস্রাব হলে – বেলেডোনা ৬।
  • দিনে বা রাতে প্রস্রাব ধারণে অক্ষমতা বা প্রস্রাব করার সময় স্বপ্ন দেখলে ইকুইজিটাম ৩, ৬।
  • দিনে বা রাতে প্রস্রাব ধারণে অক্ষম হলে – জেলসিমিয়াম ৩X
  • প্রস্রাবে ইউরিক এসিড থাকলে – লাইকো ৬
  • মূলেন অয়েল -এর একটি উৎকৃষ্ট ওষুধ। এটি ২ থেকে ৫ ফোঁটা দিনে ২ বার খেলে ভালো কাজ করে।

বাবা মায়েদের যা খেয়াল রাখতে হবে

  • প্রথমে শিশু ও তার মা–বাবার মধ্যে সমস্যাটি সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকতে হবে।
  • বিছানা ভেজানোর জন্য শিশুকে কিছুতেই শাস্তি বা বকাবকি করা যাবে না।
  • বিছানায় প্রস্রাবের পর তা শুকিয়ে গোছগাছ করে রাখলে শিশুর প্রশংসা করুন, আদর করুন। এতে তার মধ্যে দায়িত্ববোধ তৈরি হবে এবং ধীরে ধীরে সে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সফল হবে।
  • ‘নিউরেটিক অ্যালার্ম’ ব্যবহার করা যেতে পারে। এই অ্যালার্মের সেন্সর শিশুর প্যান্টের ভেতর দেওয়া থাকবে। ফলে ভিজলেই সেটা বেজে উঠবে আর তার ঘুম ভেঙে যাবে এবং বাথরুমে চলে যাবে।
  • এই সমস্যায় কিছু ওষুধ থাকলেও তা কম কার্যকর। যদি আত্মীয় কিংবা অন্য কোথাও বেড়াতে গেলে কিছুদিনের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শে এ ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা যায়।
  • বিছানা ভেজানোর সমস্যাটি জটিল সমস্যা নয়। আপনা–আপনি সেরে যায়। প্রয়োজন যথাযথ টয়লেট ব্যবহারের অভ্যাস এবং শিশুকে মানসিক চাপমুক্ত রাখা। অতিরিক্ত পানি পান অথবা একেবারেই কম পানি পান—দুটিই ক্ষতিকারক।

সূত্র : প্রথম আলো, কালের কণ্ঠ ও অন্যান্য মাধ্যম