উৎকন্ঠিত হবার মানুষের অনেক যথার্থ কারন থাকে। যেমন আপনার পরিবারের কেউ হঠাৎ কিছু না বলে মোবাইল ফোন বন্ধ করে কোন কারন ছাড়াই যদি বাসায় না ফেরে তাহলে আপনি উৎকন্ঠিত হবেন। অথবা আগামি কাল আপনার একটি জটিল অপারেশন অথবা কোন ধরণের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক হুমকি, বিপদ বা অনাকাঙ্খিত ঘটনার আভাস পেলে আপনি সতর্কিত হবেন, সেটি মোকাবেলা করার জন্য উৎকন্ঠিত হবেন এটাই স্বাভাবিক। প্রকৃত কারণে উৎকন্ঠিত হওয়াটা কোন অস্বাভাবিকতা নয় বা এটি কোন রোগ ও নয়।
উৎকন্ঠা (Anxiety) বা এংজাইটি দুই রকম ভাবে হতে পারে, প্রথমত- উৎকন্ঠিত হবার মতো যথার্থ কোন কারন কোন আসন্ন বিপদ বা ক্ষতিগ্রস্থ হবার সম্ভাবনা) না থাকা সত্ত্বেও যদি কেউ মনগড়া কারনে অযথা ভীতিগ্রস্থ হয়ে পড়েন। যেমন স্কুল থেকে আপনার সন্তানটি হারিয়ে যাবে বা কিডনাপ হবে ভেবে স্কুলের গেটের কাছে বসে বসে ঘামেন বা স্কুলের ছাঁদ থেকে পড়ে যাবে ভেবে আপনার সন্তানকে স্কুলেই পাঠানো বন্ধ করে দেন। দ্বিতীয়ত- ভয় পাওয়ার কারন রয়েছে কিন’ কারন অপেক্ষা আপনার উৎকন্ঠার পরিমান অস্বাভাবিক বেশি। যেমন- আপনার পাশের ফ্লাটে অল্প বয়সি একজনের হার্ট এটাক হয়েছে শুনে ভাবতে থাকেন আমারও তো বুকে ব্যথা হয়, আমারও হার্ট এটাক হচ্ছে। অথবা কোন বাড়ীতে চুরি হয়েছে শুনে চোরের ভায়ে চারটে কলাপসিবল গেটে আটটি তালা ঝুলিয়েও রাতে ঘুম আসছে না। দিনের পর দিন এভাবে চলতে চলতে আপনি অসুস্থ্য হয়ে পড়ছেন।
মনোবিজ্ঞানের পরিভাষায় উৎকন্ঠা বা এংজাইটি প্রধানত তিন প্রকার-
১. জেনারেলাইজড এংজাইটি ডিসর্ডার – যেক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তি প্রায় সবসময় সবকিছু নিয়ে উৎকন্ঠিত হন।
২. ফোবিক এংজাইটি ডিসর্ডার – কোন বিশেষ বস্তু, প্রানী, পরিবেশ, পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে উৎকন্ঠায় আক্রান্ত হওয়া। যেমন অনেক লোকের ভীড়ে গেলে উৎকন্ঠিত হওয়া (Agoraphobia) , তাই ভীড়ের জায়গা এড়িয়ে চলেন তারা। এ ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তি ঐ বস্তু বা পরিস্থিতির সম্মুখীন না হলে উৎকন্ঠিত হন না।
৩. প্যানিক ডিসর্ডার – কোন বস্তু বা পরিস্থিতির সম্মুখীন না হয়েও মাঝে মাঝে নিজের কল্পনা প্রসুত কারনে উৎকন্ঠিত হওয়া, যেমন রাতে শুয়ে আছে, হঠাৎ আজ রাতে যদি আমার হার্ট এটাক হয় এটা ভেবেই নির্ঘুম রাত কাটিয়ে দিলেন। এক্ষেত্রে উৎকন্ঠিত হবার মত নূন্যতম কোন বাস্তু বা ঘটনাই উপস্থিত নেই।
উৎকন্ঠার লক্ষণ নানা রকম হতে পারে –
১.ভীতি গ্রস্থ হওয়া
২. খিটখিটে মেজাজ
৩.সামান্য শব্দে উত্তেজিত হওয়া
৪. অস্থিরতা
৫. মনোযোগের অভাব
৬.ভুল পথে চিন্তা করা
৭.মুখ-জিহবা শুকিয়ে যাওয়া ও পানি পিপাসা পাওয়া
৮.ঢোক গিলতে অসুবিধা হওয়া
৯. পেটে অস্বস্তি বোধ করা
১০.পেট ফাঁপা ভাব
১১.বারবার বাথরুমে যাওয়া
১২. বুকে চাপ অনুভব করা
১৩. নিশ্বাস নিতে অসুবিধা হওয়া
১৪. বুক ধরফর করা
১৫. মেয়েদের পিরিয়ডের সমস্যা হওয়া
১৬. হাত পা এর কাপুঁনি হওয়া – বিশেষত হাতের আঙ্গুল কাঁপা
১৭. মাথা ব্যথা,গা ব্যথা,হাত পা জ্বালা করা
১৮. ইনসমনিয়া (ঘুম কম হওয়া),হঠাৎ ঘুমের মধ্যে ভয় পেয়ে জেগে উঠা
১৯. দুশ্চিন্তা করা
২০.দাঁত দিয়ে নখ কামড়ানো
২১. বসে বসে পা নাড়ানো
২২. ক্ষিধে কমে যাওয়া
২৩.বিষন্নতা
২৪.অবসেশন – বিশেষ কিছু নিয়ে ক্রমাগত ও বারবার চিন্তা করা (রাতে শোবার পর কয়েকবার উঠে দেখা দরজা বন্ধ করা হয়েছে কি না)
২৫.উৎকন্ঠায় আক্রান্ত হওয়ার কারন – বিশেষ বস্তু, প্রাণী, ভীড়, সামাজিকতা ইত্যাদি এড়িয়ে চলা
২৬. ঘাম হওয়া,বমি বমি ভাব হওয়া
২৭.হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসা
২৮.মৃত্যুভয় পাওয়া ইত্যাদি
সবগুলো লক্ষণ যে একই ব্যক্তির মধ্যে একসাথে পাওয়া যাবে তা কিন্তু নয়, বরং উৎকন্ঠার প্রকারভেদে কিছু লক্ষণ ভিন্ন ভিন্ন সময় দেখা যায়।
মানসিক অসুস্থতার মধ্যে উৎকন্ঠা বা Anxiety নিরাময় ও নিয়ন্ত্রণযোগ্য। তবে কেবলমাত্র ওষুধ প্রয়োগ করে এ রোগের লক্ষণগুলো কমিয়ে রাখা যায় কিন্তু পুরোপুরি নিরাময় করবার জন্য বেশ কিছু প্রক্রিয়া অনুসরন করা যেতে পারে, যেমন –
১সাইকোথেরাপি বা মনোচিকিৎসা – মনোচিকিৎসকের সাহায্য নিয়ে।
২আচরণ পরবর্তন করার প্রক্রিয়া (Behaviour therapy)।
৩.শিথিলায়ন প্রক্রিয়া (Relaxation technique)।
৪.মেডিটেশন।
৫.আত্মসম্মোহন।
৬.যোগব্যায়াম – কমপক্ষে বিশ মিনিট করে প্রতিদিন।
৭.প্রয়োজন মতো ঘুমানো।
৮.খাদ্যাভ্যাস ও দৈনন্দিন অভ্যাসের পরিবর্তন – সহজপাচ্য খবার ও প্রচুর পানি পান করা।
৯.ক্যাফেইন সমৃদ্ধ পানীয় পরিহার করা ও অতিরিক্ত মদ্যপান কমানো।
১০.বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে এন্টি-এংজাইটি ওষুধ সেবন।
১১. চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কারনে -অকারনে ঘুমের ওষুধ খাওয়ার অভ্যাস ত্যাগ করা।
মনে রাখতে হবে একজন উৎকন্ঠিত রোগীর জন্য – উপসর্গ, রোগীর বয়স ইত্যাদি ভেদে উপরের প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে বাছাই করে চিকিৎসাপদ্ধতি প্রদান করা হয়।
এংজাইটি থেকে সৃষ্টি হতে পারে বিষন্নতার মতো কঠিন মানসিক ব্যাধি, এছাড়া এংজাইটি আমাদের যাপিত জীবনের গুণগত মান কমিয়ে দেয় বহুলাংশে, তাই উৎকন্ঠা নিয়ে উৎকন্ঠিত হবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তাই দেরি না করে উৎকন্ঠা কমানোর জন্য মেনে চলুন কিছু নিয়ম কানুন, মেডিটেশন বা যোগব্যায়াম চর্চা করতে পারেন আর প্রয়োজনে সহায়তা নিন চিকিৎসকের।