পরশু ফিফা কংগ্রেসে ব্ল্যাটার, যেন বলছেন, ‘আমার হাত শক্ত করুন।’ আলপাইনের কোলে ছোট্ট একটা শহর। সেই শহরেই জন্ম তাঁর।
সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মাননি। ‘কাঠের’ চামচও জোটেনি। ছেলেবেলা থেকে নেমে পড়তে হয়েছিল জীবিকার খোঁজে। বাবা চাকরি করতেন এক রাসায়নিক কারখানায়। বাবার সামান্য আয় স্বাচ্ছন্দ্যে চলার জন্য যথেষ্ট ছিল না। পরিবারের জন্য বরাদ্দকৃত খেতে সবজি চাষ হতো। একটু বাড়তি আয়ের জন্য ঠেলা গাড়িতে সেই সবজি নিয়ে বাজারে বিক্রি করতেন।
তবে জীবিকার তাগিদে ২৫ বছর বয়স পর্যন্ত বিয়ের আসরে গান পর্যন্ত গেয়েছেন। সেটাই ছিল তাঁর তখনকার পেশা। কিন্তু ছাত্র হিসেবে ছিলেন তুখোড়। দীর্ঘদিন চাকরি করেছেন সুইস সামরিক বাহিনীতে। একটা রেজিমেন্টের অধিনায়কও ছিলেন। কর্নেল পদবি থেকে অবসরের পর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যবসায় শিক্ষার ওপর ডিগ্রি নিয়েছেন। এখন তো চারটি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারেন।
বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী মানুষটির নাম সেপ ব্ল্যাটার। শুরু করেছিলেন শূন্য থেকে। তিনিই এখন এ ধরাতলের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলাটির অভিভাবক সংস্থার অভিভাবক। সেই ১৯৯৮ সালে ব্ল্যাটার-রাজ্যের শুরু। চলছে এখনো। কবে থামবে কে জানে!
৮০-এর দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে পঞ্চম মেয়াদে নির্বাচিত হলেন আরও একবার। নিন্দুকেরা তাঁকে বলেন ক্ষমতালোভী! তিনি জবাব দেন রসিকতার সুরে। ২০১৩ সালে একবার জন্মশহর ঘুরে এসে নিজের ক্ষমতার মেয়াদ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “মা আমাকে বলেছেন, ‘আমার এখানে (কবর) চলে আয়।’ জবাবে বলেছি, ‘আমি তো ভালো করছি। ওখানে আসার সময় এখনো হয়নি।”
তরুণ বয়সে ফুটবলটাও দারুণ খেলতেন। পাড়ার ফুটবলে তো নিজেকে ‘কিং’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন! সুইজারল্যান্ডের অন্যতম দল লসন এফসি থেকে ট্রায়ালের প্রস্তাবও পেয়েছিলেন। তবে বাবার জন্য ফুটবলার হতে পারেননি। বাবা নাকি ব্ল্যাটারকে বলেছিলেন, ‘ফুটবল খেলে কাজ নেই। ওতে পয়সা নেই।’ সময়ের পরিক্রমায় সেই ব্ল্যাটার এখন বিশ্ব ফুটবলের অধিপতি। কোটি কোটি টাকার মালিক।
জানা যায়, বছরে তাঁর আয় ১৭ লাখ ইউরো। যদিও তাঁর বেতনের অঙ্কটা অজানাই।
ব্ল্যাটার পেশাদার জীবনটা বড় বর্ণময়। সবজি বিক্রেতা, বিয়ের আসরে গায়ক, সুইস ঘড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের ডিপার্টমেন্টাল পরিচালক, ক্রীড়ালেখক, সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা, ফিফার জেনারেল সেক্রেটারি, ফিফা সভাপতি কত যে পরিচয় ৭৯ বছর বয়সী এ মানুষটির!
বর্তমান প্রেমিকা লিন্ডাকেও বেশ গর্বিত মনে হচ্ছে ব্ল্যাটারের সাফল্যে। এএফপিফিফায় ব্ল্যাটারের উত্থানও চমকে যাওয়ার মতো। ব্ল্যাটারের ফিফাতে উত্থানের পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান হোয়াও হ্যাভেলাঞ্জের। ১৯৭৫ সালে সভাপতি হিসেবে হ্যাভেলাঞ্জ যখন দায়িত্ব নেন, তখন ফিফায় কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যাই ছিল ১১ জন। ১২ নম্বর চাকুরে হিসেবে যোগ দেন ব্ল্যাটার। ২৩ বছর ফিফা প্রধানের দায়িত্ব পালন করা হ্যাভেলাঞ্জ ব্ল্যাটারের মধ্যে নিজের ছায়া নাকি দেখতেন। এ কারণেই আকস্মিক উত্থান ব্ল্যাটারের। ১৯৮১ সালে হ্যাভেলাঞ্জ তাঁকে ফিফার মহাসচিব পদে উন্নীত করে ডান হাত বানান। ১৯৯৮ সালে হ্যাভেলাঞ্জের উত্তরসূরি হিসেবেই ফিফার ‘মসনদে’ বসেন, অবশ্য নির্বাচিত হয়েই।
বাকি ইতিহাস তো জানাই। যখন তিনি যোগ দিয়েছিলেন, ফিফার সদস্য ছিল ১৪৪। সেটি এখন ২০৯। ধারণা করা হয়, ’৭৫-এর পর সদস্যা হওয়া অধিকাংশ দেশই ব্ল্যাটারের ভোট ব্যাংক। সেসব দেশে জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে দেশগুলোয় রয়েছে ফিফার নানা ধরনের উন্নয়ন কর্মসূচিও।
রোমান্টিক হিসেবেও ব্ল্যাটারের বেশ সুখ্যাতি। জীবনে এসেছে চার নারী। বিয়ে করেছেন তিনজনকে। দ্বিতীয় স্ত্রী বারবারা কাসের তো ছিলেন তাঁর চেয়ে ৩০ বছরের ছোট। বারবারা ছিলেন সাবেক ফিফা জেনারেল সেক্রেটারি হেলমুট কাসেরের মেয়ে! রেগেমেগে নাকি মেয়ের বিয়েতেই যাননি হেলমুট। শোনা যায়, বিয়ের দিন নাকি কেঁদেও ছিলেন হেলমুট। বর্তমান প্রেমিকা লিন্ডাও তাঁর চেয়ে ২৮ বছরের ছোট। ফিফার উত্তাল সাগর যিনি বুক চিতিয়ে পার হচ্ছেন এই বয়সে, প্রেমের সাগরের ঢেউ তো তাঁর কাছে তুচ্ছ! মিরর, জিকিউ সাময়িকী, স্পোর্টিং লাইফ অবলম্বনে।