মৃত্যু যাদেরকে সেলিব্রিটি বানিয়েছে মুশতাক আহমেদ তাদের একজন । যারা আজকে প্রতিবাদ করে তাঁকে সেলিব্রিটি বানিয়েছে কয়েকদিন আগে একই প্রতিবাদ জানালে হয়তোবা এই ফ্যাসিবাদি কুমিরের চোয়াল থেকেই উদ্ধার করা যেত । তাহলে বৃদ্ধ বাবা-মাকে তাঁদের অন্ধের যষ্টিটি হারাতে হতো না । আসলে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিলাসিতার ‘চুজ অ্যান্ড পিক’ -এ তখন মুশতাক আহমেদ পড়েননি । অনেকটা কাদম্বিনীর মতো ‘মরিয়া’ প্রমাণ করতে পেরেছেন কিংবা নিজের মনোকষ্টটি দেশবাসী ও বন্ধুবান্ধকে দেখাতে পেরেছেন । কাদম্বিনীর মতোই তাঁর মরণের স্বার্থকতা ।
বয়সের হিসাবে বলা যায় আমরা প্রায় কাছাকাছি বয়সের। যতদূর জানতে পেরেছি ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে মুশতাক আহমেদ ছিলেন ২৭তম ব্যাচের ক্যাডেট । তাঁর দুই ব্যাচ সিনিয়র ভাইয়েরা (২৫তম ব্যাচ) আমার মেরিন একাডেমির বন্ধু /ব্যাচমেইট । তাদেরই একজন তাঁকে নিয়ে দুটি কথা লিখতে অনুরোধ জানিয়েছেন।
তিনি ছিলেন একটু বাম ও প্রগতিশীল ঘরানার লেখক ও মানুষ । অনুমান করতে কষ্ট হয় না যে মুখের তুলনায় বড় ও লম্বা মোচ ওয়ালা কিছুটা বোহেমিয়ান স্বভাবের এই মানুষটি ছিলেন খুবই প্লিজেন্ট ব্যক্তিত্ব সম্প্ন্ন। এই ঘরানার মানুষ বন্ধুমহলেও জনপ্রিয় হয়ে থাকেন। তাঁর ক্যাডেট কলেজের জুনিয়র, সিনিয়র বা ব্যাচমেইট অনেকেই গুরুত্বপূর্ণ পজিশনে আছেন ! মালুম করতে কষ্ট হয় না যে মুশতাকের স্ত্রী ও বাবা-মা এদের অনেকের শরনাপন্ন হলেও এরা কেউ সেভাবে এগিয়ে আসেননি! এরা সবাই নিজ নিজ জায়গায় ইয়া নাফসি ইয়া নাফসি করছেন কিংবা ক্যালকুলেটর হাতে নিয়ে বাড়ি গাড়ি এবং অন্যান্য সুযোগ সুবিধার হিসাব নিকাশে ব্যস্ত রয়েছেন।
সীমাহীন লোভ-লালসা এদের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে – কাজে কাজেই ব্যাচমেইট ফিলিংস, ফেলো ফিলিংস, দেশের ফিলিংস, স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের ফিলিংস সব এদের জানালা দিয়ে পালিয়ে গেছে! ফ্যাসিবাদ আমাদের সমাজ থেকে সামাজিক ও মানবিক সম্পর্কের মূল্যবান অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে!
এদেশে শিক্ষিত মহলে বামপন্থী ফ্যাশনটির একটি আলাদা কদর রয়েছে। সেমতে ফ্যাসিবাদী কুমিরের পিঠে না চড়লেও মোটামুটি নিরাপদ দূরত্বে থেকে সেই কুমির কর্তৃক রাজাকার ও জঙ্গী ভক্ষণ উপভোগ করেছিলেন মুশতাক। ২০১৬ সালে এক স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন , “আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে। নিজামী সাবের লাগি কাদের মোল্লা ওয়েট করতাছে!“ অথচ নিজে বুঝতে পারেননি তাঁর জন্যে কী বা কে অপেক্ষা করছিল! তথাকথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে যে বিচারহীনতার বীজ রোপন করা হয়েছে সেই বিষয়টি ঘূর্ণাক্ষরেও আঁচ করতে পারেননি আজকে বিচারহীনতার শিকার এই মুশতাক।
মজলুম সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের নির্যাতন নিয়ে তিনিও অপরাপর বাম বুদ্ধিজীবীদের মতো টু শব্দ উচ্চারণ করেননি। দৈনিক আমার দেশ, দিগন্ত টিভি, ইসলামী টিভি বন্ধ করে দেয়া প্রগতিশীলতার স্বার্থে প্রয়োজন ছিল বলেই চুপ করেছিলেন। এত কিছুর পরেও এই মুশতাক নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি।
এই অপ্রিয় বিষয়টি টানতে বাধ্য হচ্ছি- ভবিষ্যতের মুশতাকদের সাবধান করার জন্যেই। এখনও জ্ঞানপাপীগণ মুশতাকের এই হত্যাকাণ্ডকে নানাভাবে জাস্টিফাই করে যাচ্ছেন, রাষ্ট্রীয় পাজিদের কুসুম-কুসুম সমালোচনা করে সর্দারনিকে রক্ষার প্রয়াস চালাচ্ছেন। এক বিচারহীনতার প্রশ্রয় ভবিষ্যতে আরো বড় বিচারহীনতার রাস্তা তৈরি করে দেয়। তার করুণ শিকার ভবিষ্যতে তারাও হতে পারেন ।
আজ যারা মুশতাকের মৃত্যু নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন তারা বিএনপি ও ছাত্রদলের মিছিলে পুলিশি নির্যাতন নিয়ে পুরোপুরি নীরব রয়েছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিবির নেতাকে মিথ্যা হত্যা মামলায় গ্রেফতার করা হয় এবং পুলিশ কাস্টডিতে মৃত্যুবরণ করে। পরবর্তি সময়ে প্রমাণিত হয় যে ঐ ছেলেটি সেই হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল না। এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের তথাকথিত বুদ্ধিবৃত্তিক মহল এখনও নীরব। কারণ যে সত্য বলবে সেই জামায়াত শিবির হয়ে পড়বে!
জানি না, মুশতাকের এই মৃত্যু আমাদের হুশটি এখনও ফেরাতে পারে কি-না। বর্তমান ফ্রাংকেনস্টাইনের হাত থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হলে ইস্পাত কঠিন ঐক্য বিনা অন্য কোনো বিকল্প নেই। এ মুহুর্তে একজন আরেক জনের দোষ না খুঁজে সম্মিলিত শক্তি নিয়ে রাস্তায় ঝাপিয়ে পড়তে হবে।
তা না হলে যে মুশতাকেরা এখন এই ফ্যাসিবাদি কুমিরের পিঠে নিরাপদে দাঁড়িয়ে আছেন তাদেরকেও এই কুমিরের পেটে যেতে সময় লাগবে না।