নগ্ন কিংবা অর্ধনগ্ন নারীদেহ যে পুরুষদের উত্তেজিত করে তোলে, এ সংক্রান্ত একাধিক গবেষণা প্রতিবেদন রয়েছে বিজ্ঞানের। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক এমন একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে বৈজ্ঞানিক জার্নাল ‘Evolution & Human Bahavior’-এ। এই স্টাডিতে বলা হয়— ‘পুরুষরা যখন নগ্ন নারীদেহ দেখে, তখন তাদের Hormonal Response তীব্র হয়ে ওঠে।’ অর্থাৎ এ সময় পুরুষদের Testoterone (সেক্স হরমোন) আপিল সবচেয়ে বেশি সক্রিয় হয়ে যায়।
এর মানে হলো—নগ্ন কিংবা অর্ধনগ্ন নারীদেহ দেখার পরও উত্তেজিত হবে না, নপুংসক ব্যতীত এমন পুরুষ পৃথিবীতে নেই। এদের মধ্য থেকে হয়তো কতক পুরুষ সংযমের নীতি অবলম্বন করে, চেষ্টা করে নিজের কামনাকে দমিয়ে রাখতে। কিন্তু সিংহভাগ পুরুষই প্রকৃতির এই অমোঘ বাস্তবতার নিকট পরাজিত হয়ে যায়, আত্মসমর্পণ করে বসে প্রবৃত্তির তাড়নার কাছে। তারা বিভিন্ন উপায়ে সেই কামনা চরিতার্থ করতে চেষ্টা করে।
ক্রিমিনোলজি তথা অপরাধবিজ্ঞানের ভাষ্যমতে, যেকোনো অপরাধের পূর্বশর্ত হলো ট্রায়াঙ্কেল স্ট্রাকচার।
ট্রায়াঙ্কেল স্ট্রাকচার কী? একটু ব্যাখ্যাসমেৎ বুঝিয়ে বলা যাক—
১. Opportunity: অপরাধীর অপরাধ করার সুযোগ পেতে হবে। ধরা যাক, চার-পাঁচ জন বখাটে রাতে ঘুরছে। আশেপাশে কেউ নেই। যেকোন অপরাধ করার সুযোগ আছে তাদের হাতে। অর্থাৎ opportunity আছে।
২. Tendency: অপরাধ করার প্রবণতা থাকতে হবে মনে। অর্থাৎ, বখাটেগুলোর মনে যে কোন ধরণের অপরাধ করার ইচ্ছা আছে। অর্থাৎ Tendency আছে।
৩. Motivated victim: যখন সুযোগ হাতে আছে, তখন ভিক্টিমকে নাগালে পাওয়া। অর্থাৎ, ঠিক এমন মুহূর্তে বখাটেগুলো কোনো নারীকে দেখল, যাকে ধর্ষণ করতে পারে। অর্থাৎ motivated victim পাওয়া গেল।
এবার আসুন দেখি—কীভাবে সমাজের কোনো রক্ষণশীল কোনায় পড়ে থাকা সম্ভাব্য অপরাধী হয়ে ওঠে ভয়ঙ্কর ধর্ষক। সে সাধারণত কোনো পর্ণস্টার, বিলবোর্ডে টানানো ছোটো পোশাকের মডেল, রাস্তায় পিঠের মানচিত্র দেখিয়ে হেঁটে চলা তরুণীকে দেখে জমাতে থাকে কামনার আগুন। ধীরে ধীরে তার মধ্যে tendency develope হতে থাকে। এক দিনে হয় না, হয় ধীরে ধীরে। আর সেই সম্ভাব্য অপরাধী যখন ফাঁকা স্থানে কোনো ভিক্টিমকে পায়, স্বভাবই ক্রাইমের তিনটা শর্তই পূরণ হয়; opportunity, tendency, motivated victim.
সহজ ভাষায় বলা যায়—কোনো সম্ভাব্য ধর্ষক হয়তো রাতে কম্বলের নিচে পরীমনির অর্ধনগ্ন শরীর দেখে দেখে কাম জাগায়, কিন্তু বাস্তবে তার লালসার শিকার হয় কোনো অসহায় নারী বা শিশু। কারণ, পরীমনির সঙ্গে এই ক্রাইমটি করার জন্য অপরাধবিজ্ঞানের যে তিনটি শর্ত পূরণ হওয়া দরকার, এক্ষেত্রে তা হয় না। অর্থাৎ, অপরাধ করার tendency থাকলেও opportunity বা motivated victim তার সামনে নেই।
আমাদের দেশের জাতীয় দৈনিকগুলোর বিনোদন পাতায় প্রায়ই ছাপা হয় নায়িকাদের অর্ধনগ্ন উত্তেজক ছবি। আবার সেই পত্রিকারই শেষের পাতায় হয়তো থাকে কোনো না কোনো শিশু ধর্ষণের সংবাদ। পরদিন সম্পাদকীয় পাতায় দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাওয়া হয় ধর্ষকের। কী এক আজব দেশে বাস করছি আমরা! এখানে যে সাপ, সে-ই ওঝা। নায়িকাদের অর্ধনগ্ন ছবির খেসারত যে একটি ছোট্ট শিশুকে দিতে হচ্ছে, এই মাথা মোটারা তা বুঝেও না বোঝার ভান করে থাকে।
আজ যারা পোশাকের স্বাধীনতার নামে আন্দোলন করছে, যারা এই প্রজন্মকে নৈতিকভাবে ধ্বসিয়ে দিয়ে শ্লীলতাবিবর্জিত একটি জাতি গঠনের পাঁয়তারা করছে, এই ধর্ষণের অভয়ারণ্য নিমার্ণের পিছনে তারাও কোনো অংশে কম দায়ী নয়। এই প্রগতিশীলরাই প্রশ্ন তোলে—‘পোশাক ধর্ষণের কারণ হলে শিশুরা ধর্ষিতা হয় কেন?’ অথচ এর জন্য যে তাদের এই পোশাকের স্বাধীনতাই পরোক্ষভাবে দায়ী, সেই বাস্তবতাকে তারা অস্বীকার করে বসে হরদম।
এবার আসি দ্বিতীয় আলাপে। এই প্রগতিশীলরা বলতে চেষ্টা করছে—ব্যক্তি কী পোশাক পরবে; তা সমাজ ঠিক করে দিবে না, তা নির্ধারণ করবে ব্যক্তি নিজে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য— পোশাকও যে আচরণ এবং কর্মকাণ্ডের মতোই সামাজিক কৃষ্টির একটি বড়ো অংশ, এই কূপমুন্ডুকরা তা জেনেও না জানার ভান করছে। বাঙালী মুসলমান সমাজ হিসেবে আমাদের রয়েছে একটি সুদীর্ঘ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। নৃতাত্বিকভাবেই আমাদের এই সমাজ তা আত্মস্ত করে নিয়েছে। সামাজিক প্রাণী হিসেবে সমাজ কর্তৃক নির্ধারিত এ সকল রীতি-নীতি মেনে চলতে প্রত্যেকেই বাধ্য।
পোশাক যে কোনো সংস্কৃতিরই একটি বড়ো পরিচয়পত্র। কে কোন সমাজ থেকে এসেছে, তা অনেকটা পোশাক দ্বারাও নির্ধারিত হয়। আপনি আপনার ঘরে কিংবা বাড়িতে কী পোশাক পরবেন, তা নিয়ে সমাজ মাথা ঘামাবে না। কিন্তু আপনি যখন সমাজে বের হবেন, মিশবেন সেই সমাজের মানুষের সাথে, তখন আপনার পোশাক হতে হবে সমাজ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত সীমারেখার মধ্যে।
সৌদি আরবে গিয়ে আপনি যেমন ফিলিপাইনের সংস্কৃতি অনুসরণ করে রাস্তায় বের হতে পারবেন না, বাহরাইনে গিয়ে যেমন প্রয়োগ করতে পারবেন না চাইনিজ সংস্কৃতি, ঠিক তেমনি বাংলাদেশেও পাশ্চাত্যের সংস্কৃতি অনুসরণ করে রাস্তায় চলাচল করা সম্মত নয় আপনার জন্য। এটাই হলো সামাজিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন। এতটুকু সামাজিক শিষ্টাচার মেনে চলতে না পারলে আপনি নিজেকে সামাজিক প্রাণী বলে দাবি করেন কোন আক্কেলে?
(এই প্রবন্ধে দেয়া মতামত লেখকের একান্তই ব্যক্তিগত। এর সাথে জিনিউজের সম্পাদকীয় নীতির মিল না-ও থাকতে পারে)