বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিনের ভাগ্যে কি ঘটবে? এমন প্রশ্ন শুধু তার পরিবারের সদস্যদের নয়, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, মানবাধিকার কর্মী, সুশীল সমাজের নেতৃবৃন্দেরও একই জিজ্ঞাসা। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীর মতো সালাহ উদ্দিনকে গুম করার আশঙ্কাও প্রকাশ করা হচ্ছে। গত মঙ্গলবার (১০ মার্চ) রাতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে উত্তরার এক বাসা থেকে দুই গৃহকর্মীসহ তাকে তুলে নেয়া হলেও এখনো তার সন্ধান মেলেনি।
তুলে নেওয়ার পর থেকে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে সালাহ উদ্দিনকে গ্রেফতার বা আটকের কথা অস্বীকার করা হচ্ছে। ফলে সালাহ উদ্দিন আহমেদকে ইলিয়াস আলীর মতো গুম করা হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো।
এর আগে ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল মধ্যরাতে বনানীর ২ নম্বর সড়কের সাউথপয়েন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে থেকে অপহৃত হন বিএনপির নেতা ইলিয়াস আলী। তার অপহরণ হওয়ার ওই ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেছেন একজন সাব-ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি ছিনতাইকারী ভেবে অপহরণকারীদেরই একজনকে পেছন দিক থেকে কলার চেপে ধরে ফেলেন। কিন্তু পরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয় পাওয়ার পর তিনি চেপে যান। এ ঘটনার পর উচ্চ আদালতে ইলিয়াস আলীর সন্ধান চেয়ে রিট আবেদনও করা হয়। কিন্তু এখনো তার কোনো সন্ধান পাওয়া যায়নি।
তার আগে ২০১০ সালের ২ জুন রাতে কারওয়ান বাজার এলাকা থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের রমনা শাহবাগ এলাকার তৎকালীন কমিশনার চৌধুরী আলমকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। ঘটনার পর তার মেয়ে মাহফুজা আক্তার বলেছিলেন, ওইদিন রাতেই তিনি টিভির স্ক্রলে খবর দেখেন যে তার বাবাকে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা বা ডিবি আটক করে নিয়ে গেছে। এরপর বিষয়টি তিনি তার মাকে জানান এবং পরদিন সকালে বাবার খোঁজ নিতে ডিবি কার্যালয়ে যান তারা। কিন্তু গোয়েন্দা কার্যালয় থেকে চৌধুরী আলমকে আটকের কথা অস্বীকার করা হয়। এরপর র্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারে দ্বারে তারা ঘুরেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার সন্ধান পওয়া যায়নি। এমনকি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও তার সন্ধান করতে পারেনি।
এরপর বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী আবু বক্কর সিদ্দিক অপহৃত হন। ২০১৪ সালের ১৬ এপিল দুপুরে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের জালকুড়ির ব্যস্ততম এলাকা থেকে মাইক্রোবাস যোগে ৭-৮ জন অস্ত্রধারী তাকে অপহরণ করে। তিনি গার্মেন্টস থেকে তার লাল রঙের প্রাইভেটকারে ঢাকার বাসায় ফিরছিলেন। এরপর তাকে উদ্ধারের জন্য পুলিশ, র্যাব ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা অভিযান শুরু করে। নারায়ণগঞ্জ, আশপাশ এলাকা ও হাইওয়েতে চেকপোস্ট বসানো হয়। ঘটনার পর দেশি বিদেশি গণমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠে। একপর্যায়ে রাজধানীর মিরপুর আনসার ক্যাম্প এলাকায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা তার পকেটে ৩’শ টাকা দিয়ে রাস্তায় ফেলে যায়।
অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন- দেশের সর্বত্র ক্রসফায়ার, গুম, খুনের ঘটনাসহ বাসা থেকে তুলে নিয়ে নির্যাতন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে। সরকার বিরোধী রাজনৈতিক জোটের নেতাকর্মীরা কেউ কোথাও নিরাপদ নয়। কখন কে কোথা থেকে গুম হয়ে যান এ আতঙ্ক থাকছে সব সময়ই। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য পরিচয়ে তুলে নেয়ার পর স্বীকার না করায় নগরবাসীর মধ্যে বিরাজ করছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী, সাবেক কমিশনার চৌধুরী আলমসহ অসংখ্য মানুষ গুম হয়েছেন ইতিপূর্বে।
গত মঙ্গলবার রাতে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাহ উদ্দিনকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে উত্তরার এক বাসা থেকে তুলে নেয়ার পর সারাদেশে মানুষের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা আরো বেড়েছে। তাকে কোথায় নিয়ে রাখা হয়েছে এবং তার ভাগ্যে কি ঘটেছে কেউ বলতে পারছেন না।
স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, আইজিপি এবং র্যাব-পুলিশের কর্মকর্তারাও সালাহ উদ্দিন কোথায় আছেন তা বলতে পারছেন না। তার অবস্থান জানতে চান দেশবাসী।
এ ঘটনার পর গত বৃহস্পতিবার বিকালে সুপ্রিম কোর্টে ল’ রিপোর্টার্স ফোরামের কক্ষে এক প্রেস কনফারেন্সে সালাহ উদ্দিন আহমেদের স্ত্রী হাসিনা আহমেদ বলেন, তার স্বামীকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তুলে নিয়ে গিয়ে এখন অস্বীকার করছেন। তিনি দাবি করেছেন- যারা তাকে তুলে নিয়ে গেছেন, তারা ওই বাসার দারোয়ানের কাছে নিজেদের ‘গোয়েন্দা’ বলে পরিচয় দিয়েছেন। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, তারা সালাহ উদ্দিকে তুলে নিয়ে যায়নি। কিন্তু এভাবে তুলে নিয়ে যাবে, কেউ কিছু বলবে না, এটা কীভাবে হয়। তাকে যে অবস্থায় তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সে অবস্থায় ‘অক্ষতভাবে’ ফিরিয়ে দেয়া বা কোর্টে হাজির করা হোক বলেও দাবি করেন তিনি।
অপর দিকে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন- মাহমুদুর রহমান মান্নার মতো গ্রেফতার দেখানো হবে, নাকি ইলিয়াস আলীর মতো পরিণতি সালাহ উদ্দিনের ঘটতে যাচ্ছে! এমন প্রশ্ন সর্বত্র। পরিবারের অভিযোগ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে। কিন্তু তারা বিষয়টি স্বীকার না করায় সকলের মধ্যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এদিকে র্যাবের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সালাহ উদ্দিন ইন্টারনেটের মাধ্যমে সাংবাদিকসহ বিভিন্নজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। ফলে র্যাব তার অবস্থান নিশ্চিত করতে পারেনি। সম্প্রতি র্যাব সদস্যরা গুলশানে সালাহ উদ্দিন আহমেদের বাসায় অভিযান চালিয়েছিল। সে দিন যদি তাকে পাওয়া যেত তাহলে তাকে আটক করা হতো। কিন্তু তিনি কোথায় আছেন জানে না বলে র্যাব কর্মকর্তারা দাবি করেছেন। তবে তার ব্যাপারে র্যাবের পক্ষ থেকে খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে এবং র্যাবের সবক’টা ইউনিটকে সালাহ উদ্দিনের ব্যাপারে বলা হয়েছে বলে র্যাবের এক কর্মকর্তা শীর্ষ নিউজকে জানিয়েছেন।
এদিকে ৭ দিন পার হলেও সালাহ উদ্দিনের খোঁজ না পেয়ে তার স্ত্রী হাসিনা আহমেদ, ছেলে-মেয়েসহ পরিবারের সদস্যরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন।
তিনি জানিয়েছেন- আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ জানেন না এটা বিশ্বাসযোগ্য কোনো কথা হতে পারে না। অন্যদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া সংবাদ সম্মেলনে সালাহ উদ্দিনের মুক্তি দাবি করেছেন। তিনি বলেন-তার মুক্তি না দিলে পরিণতি শুভ হবে না।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সালাহ উদ্দিনের সন্ধান দেয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, সালাহ উদ্দিন নিখোঁজের রহস্য উদঘাটনের দায়িত্ব সরকারের।
সু-শাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এর সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার শীর্ষ নিউজকে বলেন, নাগরিকদের বাসা থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নিয়ে গুম করা হচ্ছে। নিরাপদভাবে বেঁচে থাকা নাগরিক অধিকার। সেই অথিকার ক্ষুন্ন করা হচ্ছে। এগুলো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে- এসব ঘটনার তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়া। আর সরকার এসব ঘটনার দায়িত্ব এড়াতে পারে না।
তিনি বলেন, বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিনের পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- তাকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীই তুলে নিয়ে গেছে। আর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- সালাহ উদ্দিনকে তারা আটক বা গ্রেফতার করেনি। এ বিষয়ে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকসহ আমরা উদ্বিগ্ন।
উত্তরা জোনের পুলিশের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) ইকবাল হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি শীর্ষ নিউজকে গত শনিবার বেলা দেড়টার দিকে জানান, বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিন সম্পর্কে আমাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। তবে এ ব্যাপারে তদন্ত চলছে বলে জানান তিনি। হাইকোর্টেও একই তথ্য দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
বিএনপির একটি সূত্র জানায়, উত্তরা মডেল টাউনের ৩ নম্বর সেক্টরের ১৩ নম্বর রোডস্থ বাসা থেকে গত মঙ্গলবার রাত ১০টার দিকে সালাহ উদ্দিনকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে তুলে নেয়া হয়।
এ ঘটনার পর সালাহ উদ্দিনের পরিবারের পক্ষ থেকে বুধবার গুলশান থানায় জিডি করতে যান তার স্ত্রী। কিন্তু সেখানে জিডি না নিয়ে উত্তরা (পশ্চিম) থানায় পাঠানো হয়। কিন্তু উত্তরা (পশ্চিম) থানা পুলিশও তার জিডি নিতে অস্বীকৃতি জানান।
এ ঘটনার পর সালাহ উদ্দিন আহমেদের স্ত্রী অভিযোগ করে বলেছেন- যদি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাকে ধরে না নেয় তাহলে থানায় জিডি নিতে অসুবিধা কোথায়? নিখোঁজ ব্যক্তির জন্য থানায় সাধারণ ডায়েরি করার অধিকারটুকু নেই কেন? এ ব্যাপারে উত্তরা পশ্চিম থানার ওসি রফিকুল ইসলাম বলেন, তিনি কিছুই জানেন না।
এরপর শনিবার রাতে উত্তরা (পশ্চিম) থানার পুলিশ বাদী হয়ে একটি জিডি করে বলে সংশ্লিষ্ট এক সূত্র শীর্ষ নিউজকে জানিয়েছে।
থানার এক কর্মকর্তা জিডির বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে অন্য এক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। এরপর ওই কর্মকর্তার সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি শীর্ষ নিউজকে জিডি করার কথা স্বীকার করেন। এরপর তার কাছে জিডির নম্বরটি জানতে চাইলে তিনি বলেন, জিডির কপিটি ওসি স্যারের কাছে আছে। তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন, তিনি জিডির নম্বর দিতে পারবেন।
পরে রোববার সকাল সোয়া ১০টার দিকে উত্তরা (পশ্চিম) থানার ওসি রফিকুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযেগা করা হলে তিনি শীর্ষ নিউজকে আবারো জানান, বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিন আহমেদ নিখোঁজের ব্যাপারে জিডি করার কোন তথ্য তার কাছে নেই।
এ ব্যাপারে র্যাবের মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ শীর্ষ নিউজকে বলেন, বিএনপি নেতা সালাহ উদ্দিন আহমেদ এর ব্যাপারে আমাদের কাছে কোন তথ্য নেই।
গত বৃহস্পতিবার সালাহ উদ্দিনের স্ত্রী হাসিনা আহমেদ স্বামীকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজিরের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন।
গত (১৫ মার্চ) রোববারের মধ্যে আদালতে হাজির করতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না এ মর্মে সরকারের প্রতি রুল জারি করেন হাইকোর্ট।
এরপর গত রোববার সকালে অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে পুলিশ সদর দপ্তর, ঢাকা মহানগর পলিশ, র্যাব, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও বিশেষ শাখার (এসবি) সহ পাঁচটি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভাগ থেকে ৫টি পৃথক প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়। ওই প্রতিবেদনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়, সালাহ উদ্দিন আহেমদ এর কোন খোঁজ তাদের কাছে নেই। বিকেল আড়াইটার দিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম তা আদালতে দাখিল করেন। শীর্ষ নিউজ