ইসলামপন্থী রাজনীতির অন্ধকার দিকটির এক বড় প্রমাণ আমার বেলাতেই ঘটেছে। হয়তো চট্টগ্রামের কোনো মাদরাসায় দাখিল পড়ে, ইন্টার পাশ করে কোনো হাউজিং কোম্পানিতে ১০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি, এরকম ইসলামপন্থীদের থেকেও প্রায় সময় শুনি যে আমার সাংগঠনিক মান কি? মানে আমি জামায়াত বা শিবিরের কোনো পর্যায়ের নেতাকর্মী।
ঘটনা হলো আমি আসলে কিছুই না, তাদের আমি শুভাকাঙ্খী হলেও কোনো পদে নাই। ব্যস, এতটুকু তথ্য যথেষ্ট যে নিম্নস্তরের অল্পশিক্ষিত ইসলামপন্থীরা ধরে নেয় যে তাদের চেয়ে সব দিক দিয়েই আমি অযোগ্য অসম্মানিত। বিশেষ করে আমাকে গালিগালাজ করা অনেক লোকই শিবির বা জামায়াতের কোনো না কোনো পর্যায়ের দায়িত্বশীল। তাদের তুলনায় আমার যেহেতু সাংগঠনিক মান কম ছিল সেহেতু ইসলামপন্থী সর্বসাধারণ ধরে নেয় যে আমি আসলে তাদের নেতাদের তুলনায় অনেক প্রান্তিক।
এবার আসি আমার কথায়। আমি বাংলাদেশের অন্তত সাতটি মিডিয়ায় কর্মরত ছিলাম।৷ এরমধ্যে দৈনিক জনকণ্ঠ, নয়াদিগন্ত, বাংলাবাজার পত্রিকা, আমার দেশ ও যুগান্তর রয়েছে। আমি বিদেশে আসার আগে যুগান্তরের সিনিয়র রিপোর্টার ছিলাম। সাংবাদিকতা পেশায় ছিলাম ষোল বছর। এর মধ্যে একটি অনলাইন দৈনিকের সম্পাদকও ছিলাম। আর আমার লেখালেখির বয়সও দুই দশকেরও বেশি।
বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও রাজনীতির সঙ্গে নানা মাত্রায় সম্পৃক্ততার কারণে অনেক জাতীয় নেতা, নানা ছাত্রসংগঠনের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সেক্রেটারিদের পরামর্শক ছিলাম। শিবির বহু বছর আমার থেকে পরামর্শ গ্রহণ করেছে। এমনকি জামায়াতে ইসলামীও নানা সময়ে আমার থেকে লিখিত পরামর্শ চেয়ে নিয়েছে।
এতকিছুর পরেও জামায়াত শিবিরের ছোট ছোট মানুষেরা যে আমাকে তুচ্ছ করে এটাতো বাস্তবতা। এমন না যে এটা শুধু আমার বেলায় ঘটেছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সিনিয়র সাংবাদিক ও পেশাজীবীদেরকেও জামায়াত শিবিরের লোকেরা তাদের অধস্তন মনে করে। তারা ভাবে তাদের পার্টি, র্যাংকের বাইরের সবাই তাদের চেয়ে ছোট।
এখন আমার কথা হলো বাংলাদেশে যদি সর্বোচ্চ ১৫% লোক ইসলামপন্থা করেও শ্রেণীগত ভাবে তারা সরকারি বেসরকারি উচ্চপদস্থ চাকরি, বুদ্ধিজীবীতা, শিক্ষা, সংস্কৃতির কতটুকু প্রতিনিধিত্ব করে? মূলতঃ বড় মানুষ, বড় পদের লোকেদের ১%ও ইসলামপন্থী নয়। ইসলামপন্থা করে নিম্নমধ্যবিত্তরা। মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তদের মধ্যে ইসলামপন্থা একেবারেই নেই।
তাহলে একটা মুসলিম সমাজের সব শ্রেণী পেশার প্রতিনিধিত্ব ছাড়া স্রেফ একটি ক্ষুদ্র অংশ কিভাবে জনগণকে নেতৃত্ব দেবে? শুধু ইসলামের দোহাই দিলেই কি এরা সবার নেতা হয়ে যাবে?
আমার মনে আছে, হেফাজতে ইসলামের যখন কমিটি হলো, তাতে সব লোকই হলো কওমী মাদরাসার মৌলভী। জেনারেল শিক্ষিত শুধু আবদুল কাদের বাচ্চু ছিলেন। স্রেফ কোটারি একটা নেতৃত্ব দিয়ে নিজে নিজে সব মুসলমানের নেতা হয়ে গেল!
আজকে ধরেন চরমোনাই ভাইয়েরা বা গিয়াস উদ্দীন তাহেরীরা, এমনকি তারেক মনোয়ারও কি, আমার নেতা? আমি যত ধার্মিক লোকই হই না কেন, ইসলামপন্থীদের বাইরের লোকদের কি এতটা কুরুচি হয়ে যাবে?
আমার কথা হলো বাংলাদেশের ইসলামপন্থীরা জনগণের একটি ক্ষুদ্র অংশের প্রতিনিধিত্ব করে। এমন না যে জনগণ ভোট দেয় না বলে তারা সংখ্যায় কম। বরং ঘটনা হলো এরা একটা দল খুলে নেতা হওয়ার পর সবাইকে তাদের অধীনস্থ মনে করে। কিন্তু যারা মেধা যোগ্যতা পদপদবী ক্ষমতা সম্পদে ইসলামপন্থীদের চেয়ে বড়, তারা কোন দুঃখে নিজেকে এদের অধীনস্থ করবে?
আমার ঘটনা অনেক বড় উদাহরণ, কারণ আমি ইসলামপন্থীদেরকে বিপদে আপদে অনেক সার্ভিস দিয়েছি। কিন্তু তাদের অধীনস্থ হইনি বলে তাদের ছোট ছোট পোলাপানও মনে করে আমি অনেক তুচ্ছ। খেলাটা বেশ মজার- হয় তুমি আমাদের গোলাম হও, নাহলে তুমি জিরো!
আর ইসলামপন্থীদের এই মনোভাব যে ব্যক্তি মানুষকে হেয় করায় সীমিত থাকে এমন না। বরং এদের কাজে কর্মেও জনগণ বাদ পড়ে যায়। শুধু তাই নয়, এক ইসলামপন্থী গ্রুপ আরেক ইসলামপন্থীর বিপদেও দাঁড়ায় না।
খেয়াল করে দেখুন, গত ১৭ বছরে জামায়াতের আন্দোলন হলো দলীয় ইস্যুতে। তারা যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে মাঠে ছিল, তাও কিছু কেন্দ্রীয় নেতার জন্য। কিন্তু দলের জেতা নেতাদের বিষয়েও তারা আন্দোলনে নাই। আর কেন্দ্রীয় নেতাদের বিচার ইস্যু ছাড়া জুডিশিয়ারি নিয়েও তাদের আলাপ নাই।
মাঝখানে ২০২১ সালে শত শত হাফেজ ও আলেমকে সরকার গ্রেপ্তার করল। ওই সময় ইসলামী দলগুলো তাদের জন্য কিছুই করেনি। মানে নিজ দলের বাইরের আলেম ওলামারাও ইসলামপন্থী রাজনীতিতে ‘অপর’।
এ অবস্থায় আমি সবাইকে ভাবতে বলি এমন রাজনীতির কথা যা সর্বস্তরের মুসলমানদের প্রতিনিধিত্ব করে।