নিজ বাসভূমি থেকে বিতাড়িত প্যালেস্টাইনের জনগণের ন্যায্য দাবি অস্বীকার করা, অসলো শান্তি চুক্তিসহ বিভিন্ন সময়ে জাতিসংঘের প্রস্তাব বাস্তবায়িত না করা এবং প্যালেস্টাইন জনগণের দীর্ঘ মুক্তিসংগ্রামকে চিরকালের জন্য যাদুঘরে পাঠিয়ে যাবার যে সকল প্রক্রিয়া জারি ছিল এবং সেটলার-কলোনিয়াল রাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে সৌদি আরব সহ মুসলিম দেশগুলোর সম্পর্ক ‘স্বাভাবিক’ করবার যে নীতি মার্কন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের নেতৃত্বে বাস্তবায়িত হচ্ছিল – দেখা যাচ্ছে হামাসের এক হামলায় সবই ভেস্তে গিয়েছে। হামাসের হামলার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এখন স্পষ্ট।
বাধ্য হয়ে ইসরাইলের সমর্থক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপ এখন খুনি, জায়নবাদী এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ইসরায়েলের পক্ষে নির্লজ্জ ভাবে দাঁড়িয়েছে। প্যালেস্টাইনের জনগণের পক্ষে দাঁড়ানোকেই হামাসের পক্ষে দাঁড়ানো বলে দাবি করছে তারা। পাশ্চাত্যের মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে। তারা ভেবেছিল প্যালেস্টাইন ইস্যুকে তারা মিউজিয়মে পাঠিয়ে দেবে, সেটা আর হোল না। সরবে প্যালেস্টাইন ভূ-রাজনীতি ও বিশ্বব্যবাস্থার কেন্দ্রে স্থান করে নিল। প্রত্যাবর্তন করলো নিজের শক্তিতে।
তাহলে স্বীকার করতেই হবে হামাস এক হামলাতেই ইসরাইল ও ইসরাইল সমর্থক সকল পরাশক্তির বিরুদ্ধে তো বটেই একই সঙ্গে বিশ্বাসঘাতক আরব রাষ্ট্রগুলোর বিরুদ্ধে লড়াকু জনগণের প্রাথমিক বিজয় নিশ্চিত করতে পেরেছে। নিজের মুখ বাঁচাবার জন্য ইসরাইল এখন গাজায় গণহত্যায় মেতে উঠেছে। এই তার বীরত্বের নমুনা। গাজার গণহত্যা সেটলার-কলোনিয়াল জায়নবাদী রাষ্ট্রের কুৎসিত চেহারা উদাম করে দিয়েছে।
এটাও স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে প্যালেস্টাইনের জনগণের মুক্তিসংগ্রাম ইহুদি বনাম মুসলমানদের লড়াই নয়। প্যালেস্টাইন ইহুদি, খ্রিস্টান ও মুসলিম সহ সকল ফিলিস্তিনের সকলের দেশ, জনগণের দেশ; ফলে জায়নবাদী ও সেটলার-কলোনিয়াল ইসরায়েল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে শুধু মুসলমান নয়, সকলেই লড়ছেন। জায়নবাদ বিরোধী রক্ষণশীল ইহুদি রাব্বিরা দীর্ঘকাল ধরে বলে আসছেন, তাঁরা ইসরাইল রাষ্ট্রের সমর্থক নন । অতএব ধর্মপ্রাণ ইহুদিরাও ইসরাইল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে। আজ দেশে দেশে ইহুদিরা দাবি করছেন তাদের ধর্মের নামে ইসরাইল গণহত্যা চালাতে পারে না। তারা বারবার জোর দিয়ে বলছেন জায়নবাদ আর ইহুদি ধর্ম সমার্থক নয়। মনে রাখা দরকার প্যালেস্টাইনের জনগণের পক্ষে বিভিন্ন দেশে স্বনামধন্য সংগ্রামী বুদ্ধিজীবিদের মধ্যে এডওয়ার্ড সায়ীদ জন্মসূত্রে খ্রিস্টান। নোম চমস্কি, নরমান ফিঙ্কেলস্টাইন প্রমুখ জন্মসূত্রে ইহুদি। এ লড়াই মজলুম ফিলিস্তিনীদের পক্ষে সকলের লড়াই।
বিশ্বব্যাপী জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের লড়াই প্যালেস্টাইনের জনগণের সঙ্গে বহু মুসলিম দেশের বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস অনেক লম্বা। প্যালেস্টাইনের জনগণ শিয়া ইরান ও সুন্নি সৌদীদের মধ্য প্রাচ্যে আধিপত্য বিস্তারের প্রতিযোগিতা ও বিবাদের নিষ্ঠুর বলি। সম্প্রতিকালে জায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরায়েলের সঙ্গে ‘সম্পর্ক স্বাভাবিক’ করবার যে রাজনীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে আমরা মধ্য প্রাচ্যে দানা বেঁধে উঠতে দেখেছি, সেটা আদতে প্যালেস্টাইনের জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে চিরতরে কবর দেবার প্রক্রিয়া।
অতএব আমাদের ধর্ম, বর্ণ, জাতি নির্বিশেষে নিপীড়িত ও অধিকারহারা জনগণের পক্ষে দাঁড়াতে হবে । ইসরাইল একটি আধুনিক জাতিবাদী সেটলার-কলোনিয়াল স্টেইট – এই লড়াই ভুমি দখল কেন্দ্রিক ঔপনিবেশিকতা (বা সেটলার কলোনিয়ালিজম) এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের লড়াই। সাম্রাজ্যবাদ ও ইহুদিদের গ্যাস চেম্বারে পুড়িয়ে মারা ইউরোপের স্বার্থ রক্কলহা ছাড়া সেটলার-কলোনিয়াল রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখার কোন নৈতিক কিম্বা রাজনৈতিক মর্ম নাই।
৭ অক্টোবরের ঘটনা ভূরাজনৈতিক হিশাবনিকাশ আমূল বদলে দিয়েছে। ইসরায়েল সামরিক দিক থেকে ভীষণ শক্তিশালী এবং তার সামরিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্ভেদ্য – এই বহুল প্রচারিত মিথ চুরমার হয়ে গিয়েছে। সেটলার কলোনিয়াল স্টেইট স্থানীয় অধিবাসীদের অকাতরে হত্যা ও নির্মুল এবং স্থানীয় জনগণের ভূখণ্ড দখল করবার নীতি বাস্তবায়ন ছাড়া টিকে থাকতে পারে না সেই সত্য আবার প্রমাণিত হয়েছে। আমেরিকায় রেড ইন্ডিয়ানদের এবং অস্ট্রেলিয়ার আদি অধিবাসীদের ইউরোপের শ্বতাঙ্গ সেটলাররা প্রায় নির্মূল করে এখন যেভাবে মিউজিয়মের মতো সংরক্ষিত এলাকায় সাজিয়ে রেখেছে প্যালেস্টাইনের জনগণকে সেটা করা যায় নি, যাবে না। ইয়াসির আরাফাত এই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, হামাস সেটাই আবার প্রমাণ করলো। সেই সত্যই আরেকবার প্রমাণিত হোল। ।
যুদ্ধ মাত্রই কুৎসিত, হামাসের হামলাকে নৈতিক জায়গা থেকে নিন্দা করা সহজ। কিন্তু সমস্যার গভীরে প্রবেশ করা, সমস্যার চরিত্র বোঝা, সেটা স্বীকার করা এবং বাস্তবোচিত সমাধান নির্ণয় কঠিন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পুরা ইউরোপ যথারীতি ইসরায়েলকে দৃঢ় ভাবে সমর্থন করছে। নতুন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা বাংলাদেশের রাজীতিকেও সরাসরি প্রভাবিত করবে এবং করছে। যেসব রাজনৈতিক দল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জায়নিস্ট ইসরায়েলের সহায়তায় বাংলাদেশে ক্ষমতায় আসতে চাইছে বাংলাদেশের জনগণ তাদের চিনতে শিখবে। গাজায় ইসরায়েলের ক্রমাগত বোমা হামলা এবং খাদ্য, পানি, ওষুধ ও জ্বালানি বন্ধ করার মতো গণহত্যা চোখের সামনে ঘটবার পরও কারা নীরব এবং কারা সক্রিয় বাংলাদেশের জনগণ সেটা দেখছে। তাদের অবশ্যই একসময় গাজার গণহত্যার চোখের সামনে ঘটতে দেখেও নিশ্চুপ থাকার জন্য জবাবদিহি করতে হবে।
জ্বি হবে। এটাই ইতিহাসের নিয়ম।