গণঅধিকারে ফরহাদ মজহারের ছোবল

গণঅধিকারে ফরহাদ মজহারের ছোবল

গণঅধিকার পরিষদে নানা মতপথের লোক আছে। এটি তাদের শক্তির যেমন উৎস, তেমনি দুর্বলতাও। এই দুর্বলতায় আঘাত করতে দিলে পরিষদ ছারখার হয়ে যাবে।
ফরহাদ মজহার তার নোংরা খেলাটা শুরু করেছেন পরিষদের সঙ্গে। তিনি পরিষদের খোদ আহ্বায়ককে বহিরাগত বলার মতো কুৎসিত পলিটিক্স করে অন্য তরুণ নেতাদের বিভ্রান্ত করছেন এবং তাদের বড় হওয়ার পথটাকে শুরুতেই জটিল করতে চেষ্টা করছেন।
ফরহাদ মজহারকে কাছ থেকে যারা না দেখেছে, না বুঝেছে তারা এটি বুঝতে পারবেন না। তার পাল্লায় পড়ে যায়যায়দিন, আমার দেশ ও হেফাজতে ইসলাম বিপদে পড়েছে।
উনার ছোটলোকিটা হলো কোনো একটা গ্রুপে গিয়ে একজনকে অপরজনের বিরুদ্ধে লাগিয়ে সংহতি নষ্ট করা। তারপর সব যখন শেষ হয় তখন তিনি কবি, দার্শনিক পরিচয়ে নিজেকে আলগোছে সরিয়ে নেন।

১.
গণঅধিকার পরিষদে ইংরেজি বলা ড. রেজা কিবরিয়ার পাশাপাশি আরবি উর্দু হিন্দি বলা লোক আছে। খোদ নুরুল হক নুরু ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। তারা এমন সময়ে রাজনীতি করতে আসছেন যখন দরকারে সব ভাষা ও মিডিয়া ব্যবহার করতে পারতে হবে। নাহলে দেশের সব ধরনের লোকের কাছে তাদের কথা পৌঁছবে না। রেজা কিবরিয়া বড় লোকের ছেলে বলে নয়, নুুরুর অনেক সহপাঠীর জন্যও ইংরেজিতে কথা বলাটা জরুরি।
বিশেষ করে বাংলাদেশে যারা অরাজনৈতিক জায়গা থেকে পলিসি ও স্ট্রাটেজি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে, তাদের কাছে স্পষ্ট বার্তা দিতে হলেও ইংরেজি বলা দরকার। আর রাজনীতির লোকেরা যখন ইংরেজি বলে তখন ক্ষমতাবলয়টা উল্টেপাল্টে যায়।

সহজ একটা হিসাব দিই। বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামী একটি বড় দল৷ তাদের বিশাল আন্তর্জাতিক ও জাতীয় লবি আছে। কিন্তু দলটির নেতারা ইংরেজি পারে না বলে কোথাও গুরুত্ব পাচ্ছে না। অথচ ভারতের জামায়াতে ইসলামীর ঘটনা দেখেন। তাদের নেতারা ইংরেজি টুইট ও ফেসবুক পোস্ট করে এমন একটা পারসেপশন তৈরি করেছেন যে ভারতের মুসলমানদের অধিকার ও ভবিষ্যতের আদর্শ লিডারশিপ তারাই। আপনারা জানেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভারতে হিন্দুত্ববাদ বিরোধী বড় বড় মুসলিম প্রটেস্টগুলো সেখানকার জামায়াতের তরুণরা নেতৃত্ব দিয়েছে। বিশেষ করে দিল্লিতে এনআরসি বিরোধী আন্দোলন। অথচ ২০১৩ সালের পর বাংলাদেশের জামায়াতের কোনো আলাপই নাই। এই আলাপ না থাকা শুধু কর্মসূচি না থাকার কারণে না, ভাষার কারণেও।

জামায়াতের কথায় ফোসকা পড়লে এবার বিএনপির দিকে তাকান। এ দলটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ আলাপ করলেও খুব একটা মনযোগ আকর্ষণ করতে পারে না, এর কারণ হলো তাদের সেই ভাষা নাই। বিএনপির অনেক নেতাই ইংরেজি জানে। কিন্তু রেজা কিবরিয়া যেই টোনে যেভাবে কথা বলেছেন তা জানে কি না সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে।

রেজা কিবরিয়ার ইংরেজি বক্তৃতা বাংলাদেশের ইমার্জিং ইয়ং প্রফেশনালদের মধ্যে প্রচণ্ড সারা ফেলেছে। এমনকি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটু সচেতন ও জানাশোনা লোকও ইম্প্রেসড। এটা মির্জা ফখরুলের বক্তৃতায় মুগ্ধ হওয়ার মতো ঘটনা নয়, বরং বাংলাদেশের শিক্ষিত জানাশোনা মানুষের কনফিডেন্সের সঠিক প্রতিনিধিত্ব দেখে চমৎকৃত হওয়ার ব্যাপার।

এই চমৎকৃত হওয়াটা আবার আচমকা নয়। আপনার রেজা কিবরিয়ার বক্তৃতার শুরুতেই দেখবেন যে লোকজনই দাবি করেছেন তিনি যেন ইংরেজিতে স্যাংশনের কথা বুঝিয়ে বলেন। তিনি তা চমৎকারভাবে বলতে পারায় পাশে বসে জাফরুল্লাহ চৌধুরী, আসিফ নজরুলসহ সবাই যে খুশি হয়েছেন তা খেয়াল করলে বোঝা যায়। আমি নুরুর চেহারাটাও খেয়াল করেছি, তাদের আহ্বায়ক স্মার্টলি বুদ্ধিদীপ্তভাবে কথা বলে তাদের দলকে গুরুত্বপূর্ণ করছেন নুরুর চোখমুখ এটিই বলছিল। একে বলা যায় আত্মপ্রত্যয়ের দ্যুতি ফুটে ওটা।
তাহলে ফরহাদ মজহার কেন এত তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলেন?

২.
বিএনপি আমলে প্রবীণ সম্পাদক শফিক রেহমান তার সাপ্তাহিক যায়যায়দিনকে দৈনিক করলেন।
এর ফিচার, এডিটোরিয়াল, লিটারেচারসহ সব কিছুই তিনি নিজের রুচিমতো সাজালেন।
কিন্তু দেখা গেল যায়যায়দিন থেকে শফিক রেহমানের মতো আওয়াজ বের হয় না।
এর কারণ পত্রিকাটির নির্বাহী সম্পাদক হলেন ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা নুরুল ইসলাম ভূঁইয়া ছোটন। পুরো বার্তা ও রিপোর্টিং বিভাগ মূলতঃ তারই অনুগত ছিল।
এখন ঘটনা হলো, এই ছোটনের সঙ্গে খাতির হলো ফরহাদ মজহারের, কারণ দুজনেই নোয়াখালির লোক এবং সাবেক বামপন্থী ও এনজিও লবির লোক।

ফরহাদ মজহাররা ছোটনকে নিয়মিত উস্কাতেন যেন তারা শফিক রেহমানকে যায়যায়দিন থেকে বের করে দেয়। আর ২৬ অক্টোবর ২০০৬ সালে এটি ঘটানোর চেষ্টা করা হয়। তখন শফিক রেহমান ছোটন গ্রুপকে চাকরিচ্যুত এবং লন্ডনের বাড়ি বিক্রি করে পত্রিকা চালানোর উদ্যোগ নিতে হয়, এজন্য তিনি বিলাত যাওয়ার চেষ্টা করলে ওয়ান ইলেভেন ঘটানো আর্মির সহায়তায় তাকে বিমান থেকে নামিয়ে আনা হয়।
এসব নিয়ে আরও বিস্তারিত কথা আছে। আজ আমরা শুধু এ লেখায় দেখব যে, জরুরি অবস্থা জারির আগেই বিএনপিপন্থী সবচেয়ে বড় মিডিয়াটিতে ফরহাদ মজহার কিভাবে বিষ ছড়ালেন।
এরপরের ঘটনা হলো দৈনিক আমার দেশ। এ পত্রিকাটির ৪০ ভাগ শেয়ার মাহমুদুর রহমানের এবং ৩০ ভাগ ছিল জামায়াতে ইসলামীর লোকদের।

মাহমুদুর রহমান ২০১০ সালে অ্যারেস্ট হওয়ার পর ফরহাদ মজহার স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হলেন। ওই সময় সিনিয়র সাংবাদিকবৃন্দ ও মাহমুদুর রহমানের স্ত্রীকে ফরহাদ মজহার উস্কানি দিলেন যেন জামায়াতকে বের করে দেওয়া হয়।
এটি করতে গিয়ে জামায়াতপন্থী জিএম আহমদ হোসেন মানিক, যিনি মূলতঃ আমার দেশ কেনায় মাহমুদুর রহমান ও জামায়াতের যোগাযোগ ঘটিয়েছিলেন, এই লোককে অত্যন্ত জঘন্যভাবে ফরহাদ মজহার আমার দেশ ছাড়া করান।
অথচ ফরহাদ মজহারের পুরো জামায়াত কানেকশনটাই ছিল জনাব মানিকের।

এরপর আমার দেশের জিএম করা হলো জিল্লুর রহিম নামে সেখানকার ম্যানেজার অ্যাকাউন্টসকে, এই লোকের বাড়ি আবার নোয়াখালী, মাহমুদুর ২০১৩ সালে ফের গ্রেপ্তার হলে এই লোক আমার দেশ ছাড়ে এবং পত্রিকাটির বেশ কয়েক কোটি টাকার হিসাব পাওয়া যায়নি।

মানিক ভাইকে আমার দেশ ছাড়া করা ও জামায়াতকে প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করার ফল মাহমুদুর রহমান পেয়েছেন, তিনি শেষ পর্যন্ত একা হয়ে গেছেন। যদিও জামায়াতের নানা লোকের সঙ্গে তিনি দেশ বিদেশে খাতির রেখে চলেন। কিন্তু শহীদ আলী আহসান মুজাহিদের নির্দেশে আহমদ হোসেন মানিকের মাধ্যমে যে যোগাযোগটা হতো তা আর কখনোই তিনি পাননি।
মাঝখানে মাহমুদুর রহমান লুজার হলেন। ফরহাদ মজহারের পাল্লায় পড়লে এমনটাই হয়।

হেফাজতে ইসলামের রাজপথে আসার ঘটনা মূলতঃ জামায়াত ও দৈনিক আমার দেশের পরিকল্পনার ফসল। এক্ষেত্রে জনবল ও টাকা দেয় জামায়াত। ফরহাদ মজহার জামায়াত ও মাহমুদুর রহমান সূত্রেই হেফাজতে জড়িত হন। কিন্তু শুরু থেকেই তিনি হেগেলিয়ান বদমাইশিটা করেন৷ আর তাহলো হেফাজতকে জামায়াত প্রশ্নে চুপ থাকতে বলা। ফলে হেফাজত দেশের প্রধান ইসলামী দলের নেতাদের অন্যায় ফাঁসির বিরোধিতা করেনি। এমনকি তারা মাওলানা সাঈদীকে নিয়েও কথা বলেনি।

হেফাজত যেখানে মাঠে আসছিল ইসলামপ্রিয় সকল দলমতের জনগণের হয়ে, সেখানে তাদের জামায়াত বিরোধী হতে উস্কানি দিল ফরহাদ মজহার, এর ফলাফল কী হয়েছে তা গত আট বছরই দেখা গেছে। হেফাজত মূলতঃ নিজেদের জামায়াত বিরোধী দেখাতে গিয়ে কওমী মাদরাসার সংগঠম হলো, গণসংগঠন হতে পারল না।

৩.
গণঅধিকার পরিষদ নিয়ে কথা বলতে গিয়ে এত লম্বা কাহিনী টানার কারণ কী?
৫ মে হেফাজতে ইসলামের শাপলা চত্বরে আগমন কিংবা রাতে অবস্থানের কথাই ছিল না।
তারপরেও তারা ঢাকায় আসল, সারারাত থেকে ভোরে সচিবালয় দখল করা হবে এমন একটা গুঞ্জন উঠলো। সকালে ফরহাদ মজহারের নেতৃত্বে পেশাজীবীরা সচিবালয়ের পাশে প্রেসক্লাবের সামনে সমাবেশ করবে।
এরকম একটা সমীকরণ থেকে দিগন্ত টেলিভিশনে হেফাজতের একদল নেতাকে তোষক পেতে শুইয়ে রাখলেন মজিবুর রহমান মঞ্জু। সরকার পড়ে যাবে, নতুন সরকারে তিনি মন্ত্রী হবেন।
পরে দেখা গেল নোয়াখালীর মঞ্জু একই এলাকার ফরহাদ মজহার ও যায়যায়দিনের সেই ছোটন মিলে জামায়াত ভাঙার কাজ শুরু হলো। এতে মাহমুদুর রহমানও নাকি থাকবেন। পরে অবশ্য জাফরুল্লাহ চৌধুরী সায় দেননি বলে ছোটন-মঞ্জুটা আর ফরহাদ-মাহমুদদ্বয়কে জনআকাঙ্খা এবিপার্টিতে নিলেন না।

৪.
ফরহাদ মজহারের শিষ্য হলো নোয়াখালীর খন্দকার রাকীব। সে মাদরাসার মৌলভী। ইসলামী ছাত্র মজলিশ করতো। পরে সুবিধা বুঝে কোচিংয়ে পড়াতে শিবিরের সাথী হলো যদিও লোকজনকে বলতো সে সদস্য।
এই রাকিবরা ছাত্র অধিকার পরিষদের সাথে মিশত। এদের মাধ্যমে ফরহাদ মজহারের সঙ্গে পরিষদের কিছু লোকের পরিচয় হয়। তারা সব ধরনের লোকের কাছেই যায়, তাই ফরহাদের কাছেও গেছে।
কিন্তু ফরহাদ মজহার কী চীজ তারাতো জানে না। প্রথমে রাকিবদের দিয়ে শহীদ আবরার ফাহাদ আট স্তম্ভে ফরহাদ ঢুকলেন, সেটি হলো তার গণপ্রতিরক্ষা নামক আর্মি বিরোধী আইডিয়া, এটি দেখার পরপরই আমি এনিয়ে লিখেছি, পরিষদের ওপর ফরহাদ সওয়ার হচ্ছেন কি না তা নিয়ে হুঁশিয়ারও করেছি।
এখন দেখা যাচ্ছে, পরিষদের লোকজন টিএসসিতে কাওয়ালী আসর করার পর ফরহাদ মজহার সরাসরি তার খেলাটা শুরু করেছেন।

ফরহাদ মজহার হলেন এমন লোক যিনি ফকির লালনের মুসলমান পরিচয়ের বিরোধী। তিনি লালনকে হিন্দু স্বামী নিত্যানন্দের শিষ্য দাবি করে নিজেকেও তাই জ্ঞান করেন এবং সমকাল পত্রিকায় তিনি নিজেকে হিন্দু আখ্যায়িত করেছেন।
সেই ফরহাদ মজহার ইসলামী সুফী কালামের সঙ্গীত কাওয়ালীর সঙ্গে কিভাবে নিজেদের চালিয়ে দিচ্ছেন? তিনি আউট অ্যান্ড আউট ইসলাম বিরোধী একজন সেক্যুলার৷ তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ইসলাম বিরোধিতা। এক্ষেত্রে তিনি ভণ্ডামি করতে বলেন তিনি কুরআন মানেন, কিন্তু হাদীস মানেন না। কিন্তু এটি মিথ্যাচার। তিনি কুরআনের হুকুম অনুযায়ী নামাজ পড়েন না। এমনকি তার পাঁচশ কোটি টাকার বেশি সম্পদে বছরে সাড়ে ১২ কোটি টাকা যাকাত হয়, তাও দেন না। কাজেই লোকজনের চোখে ধূলা দিতে এই সরস্বতী দেবী পূজারির কুরআন মানার এ মিথ্যাচার।

মূলতঃ ফরহাদ মজহার কাওয়ালীর সঙ্গে নিজেকে হঠাৎ জুড়ে দিছেন তার পতিত দশাকে উদ্ধার করতে। এক্ষেত্রে তার ধান্দা হলো পরিষদের কিছু লোককে বুদ্ধিবৃত্তি ও কালচারের নামে যদি বিভ্রান্ত করা যায় তাহলে সরাসরি পাবলিকলি হাজিরও হতে পারবেন।
এক্ষেত্রে ফরহাদ মজহার বুঝেশুনেই ড. রেজা কিবরিয়াকে আক্রমণ করেছেন। তাকে পরিষদে একঘরে করা গেলে নুরুরাও রাজনৈতিকভাবে দাঁড়াতে পারবে না। এতে করে পরিষদের কিছু লোককে ভাগানোটা হবে সহজ। এই হলো ফরহাদ মজহারের ফন্দি।

পরিষদের উচিত নয় কখনো এ ধরনের শয়তানি বরদাশত করা। রেজা কিবরিয়াকে কখনোই বিব্রত ও অস্বস্তিতে ফেলা তাদের উচিত হবে না। বরং তিনি মুরুব্বি ও বড়ভাই, এই মান্যতা দিয়ে তাকে সামনে রেখে তরুণ নেতাদের বড় হতে হবে। ফরহাদ মজহারদের উস্কানিতে পড়ে ছোটলোকি করে একজন যোগ্য দক্ষ মানী নেতাকে যেন কষ্ট না দেওয়া হয়।
তরুণদের মনে রাখতে হবে ফরহাদ মজহারদের নোংরামির জেনারেশন তারা নয়। গণফোরামে থাকা বাজে লোকরা যেভাবে রেজা কিবরিয়াকে তাড়িয়েছে, তেমনটা করলে পরিষদ ছোটই হবে।

(জিনিউজের মতামত বিভাগে প্রকাশিত সকল লেখার দায় একান্তই লেখকের ব্যক্তিগত, জিনিউজের সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়। -সম্পাদক)

Scroll to Top