বিশ্বস্ত একটা গোয়েন্দা সূত্র থেকে একটা খবর জানতে পারলাম। নভেম্বর থেকে জানুয়ারি – বাংলাদেশে অনেকগুলো বড় ধরনের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
প্রশ্ন ১ – নভেম্বর থেকে জানুয়ারি কেন? সময়টা পরিচিত লাগছে কারো? নভেম্বরের ৫ তারিখ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। আর ফলাফল অনুযায়ী নতুন প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব গ্রহণ করবে ২০২৫ এর ২০ জানুয়ারি। যদি সরকার পরিবর্তন হয়, এই সময়টা একটা বেশ লম্বা ট্রানজিশন পিরিয়ড। সাধারনত এই সময়টায় বিদায়ী সরকার অনেকটা ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ মুডে থাকে। এই সময়ে তারা বড় ধরনের কোন পলিসি মেকিং সিদ্ধান্ত নেয় না। আন্তর্জাতিকভাবেও বড়সড় কোন ঝামেলায় তারা জড়ায় না। আর সুযোগটাই আমাদের পরম বন্ধুরাষ্ট্র নেওয়ার চেষ্টা করবে বলে আমার সূত্র আমাকে জানিয়েছে।
প্রশ্ন ২, কি ধরনের ‘গোলমাল’ হতে পারে? অনেক কিছুই হতে পারে। প্রথমত, আমাদের বন্ধুর প্লেবুকের সবচেয়ে কমন খেলা – হিন্দুদের উপর আক্রমন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগেই অক্টোবর মাসে আসছে দুর্গাপূজা; এদেশের হিন্দুদের সবচেয়ে বড় উৎসব। আগে থেকে হুশিয়ার না থাকলে কোন সন্দেহ ছাড়া এবারের দুর্গাপূজায় মন্দির/ প্রতীমা ভাংচুর, হিন্দু বাড়ি/ আশ্রমে আক্রমন, ইত্যাদির একাধিক ঘটনা ঘটতে পারে। দ্বিতীয়ত, পশ্চিমাদের আরেকটা প্রিয় খাবার জিনিস – তথাকথিত ‘জ-ং-গী’ হামলা। তৃতীয়ত, আমাদের অর্থনৈতিক লাইফলাইন – গার্মেন্টসে হামলা/ অগ্নিকান্ডের ঘটনা। চতুর্থত, পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তি। পঞ্চমত, টেকনাফে রোহিঙ্গাদের নিয়ে নতুন করে কোন ঘটনা।
প্রশ্ন ৩, এগুলো কেন ঘটবে? কারাই বা এগুলো ঘটাবে? বন্ধুর সবচেয়ে বড় সেবাদাসীটা লাথি খেয়ে এখন তার বাড়িতেই আশ্রিতার মত আছে; অন্নধ্বংস করে যাচ্ছে। তার এত বছরের ইনভেস্টমেন্ট এভাবে চোখের নিমেষে বানের পানিতে ভেসে যাবে, আর আমাদের বন্ধু কিছু না করে বসে থাকবে? বিশেষ করে যেহেতু বন্ধু জানে, আমাদের বর্তমান সরকারের আন্তর্জাতিক সমর্থনের একটা বড় ফ্যাক্টর হচ্ছেন স্বয়ং ডঃ ইউনুস; বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্টে তার গ্রহনযোগ্যতার কারনে। তার কারনেই এখন পর্যন্ত বন্ধু বেশি কিছু করতে পারছে না। কিন্তু নভেম্বর থেকে জানুয়ারির সেই দোদুল্যমান সময়ে যেখানে আমেরিকানদের নিজেদেরই একটা পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে, সেখানে বন্ধু এরকম মোক্ষম সুযোগ কেন ছাড়বে?
এগুলো ঘটানোর জন্য আমাদের বন্ধু কয়েক ধরনের এসেট ব্যবহার করবে। প্রথমত, কিছু স্থানীয় ভাড়াটে দুষ্কৃতিকারী। পয়সা দিয়ে এদের মাধ্যমে যেকোন কিছুই করানো যাবে। দ্বিতীয়ত, তাদের রক্ষিতাটার যে কর্মী-সমর্থকগুলো এখনও আমাদের মাঝে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে তারা। তৃতীয় এবং সবচেয়ে বিপদজনক এসেট হচ্ছে সেনাবাহিনী, পুলিশ আর প্রশাসনে তার দাসীর যে সেবাদাসগুলো এখনও বহাল তবিয়তে রয়ে গেছে সেগুলো। এরা কিন্তু নিজেরা কিছু করবে না, বরং তাদের এই নিষ্ক্রিয়তাটাই এদের সবচেয়ে বড় কাজ হবে। পুলিশ এখন পর্যন্ত তাদের পূর্বের ৫০% ফাংকশনিং ও ফেরত পায় নাই। এদের মধ্যে আবার অনেকেই গোপালি/ এক্স ছাত্রলীগ জাতীয় ব্যাকগ্রাউন্ডের। সেনাবাহিনীর ভেতরের খবর যেহেতু আমি হরহামেশাই পাচ্ছি, আমি জানি অধিকাংশ ডিভিশনের জিওসিরা এখনও হাসিনার নিয়োগ করা। গ্রাউন্ড লেভেলের অধিকাংশ অফিসারদের অভিযোগ – তাদের জিওসিরা তাদেরকে নিষ্ক্রিয় করে রাখছে। সেনাবাহিনী জেলা পর্যায়ে ডেপ্লয়েড, কিন্তু গ্রাউন্ডে তারা কাজ করতে পারছে না তাদের জিওসি আর ব্রিগেড কমান্ডারদের অনীহা, অসহযোগিতা আর অনাগ্রহের কারনে। অনেক ক্ষেত্রেই এই জিওসিরা গ্রাউন্ড লেভেলের অফিসারদের উদ্যমকে বাধাগ্রস্থ করছেন ইচ্ছাকৃতভাবেই। সিলেট, বরিশাল, রামু, সাভার, বগুড়া, রংপুর – এই সমস্ত ডিভিশন থেকেই আমি প্রায় একই রকম খবর পেয়েছি।
হাসিনার পতনের পরে কোন ডিভিশন থেকেই বলতে গেলে তার রেখে যাওয়া জিওসিদের সরানো হয় নি। একমাত্র যশোরের জিওসি’র হাসিনাকে কদমবুসি করার ভিডিও ভাইরাল হয়ে যাওয়ায় আর গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগ দ্বারা সেনাবাহিনীর উপর হামলার ঘটনা সামলাতে ব্যর্থ হওয়ায় সম্ভবত তাকে সরানো হয়েছে, তাও আবার ডিজি ডিজিডিপির মত একটা ভাইটাল জায়াগায় তাকে পাঠিয়ে। অথচ, ইউনিফর্মকে এভাবে অসম্মান করার জন্যই এই ভদ্রলোককে নিদেনপক্ষে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া প্রয়োজন ছিল; তার অন্যান্য কুকীর্তির কথা না হয় নাই বললাম! সাহসী এবং বোল্ড কোন এ্যাকশন না নিতে পারার জন্য সরকার এবং সেনাবাহিনী এখন পর্যন্ত যেরকম ভুগে যাচ্ছে, ভবিষ্যতে আরও বেশি ভুগবে বলে আমার আশংকা। নজরদারির মধ্যে থেকেও লেঃ জেনারেল মুজিবের পলায়ন সেটাই নির্দেশ করে।
এখন তাহলে কী করণীয়? বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটার আগেই একটা ম্যাসিভ ক্লেন্সিং দরকার। সেনাবাহিনী থেকে হাসিনার রেখে যাওয়া জিওসিদের যত দ্রুত সম্ভব অপসারন। আমাদের সেনাবাহিনীতে যোগ্য অফিসারের অভাব নেই। একসাথে আট দশজন জেনারেলকে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেও তাদের জায়গা নেওয়ার মত তার কয়েকগুন সংখ্যক অফিসার খুব সহজেই পাওয়া যাবে। দরকার শুধু একটা বোল্ড সিদ্ধান্ত। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের পর আমাদের নতুন সেনাবাহিনী তরুণ অফিসাররাই চালিয়েছিলেন। অবশ্যই তাদের অনভিজ্ঞতার জন্য অনেক সমস্যা হয়েছে, কিন্তু সেনাবাহিনী তাও চলেছে। একটা খু-নির রেখে যাওয়া তথাকথিত বন্ধুরাষ্ট্রের কাছে মাথা বর্গা দেওয়া এই জেনারেলদের সরিয়ে দিলেও আমাদের সেনাবাহিনী খুব ভালো মতই চলবে। একই ঘটনা প্রয়োজন পুলিশ ও প্রশাসনেও।
যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ এলাকা আর কেপিআইগুলোতে বাড়তি নিরাপত্তা প্রয়োজন। শিল্পাঞ্চলগুলোতে বর্ণিত সময়ে বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। দুর্গাপূজার সময় সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। আশেপাশের মন্দির/ পূজা মন্ডপের বাড়তি নিরাপত্তার প্রয়োজন হবে। এটা শুধু পুলিশ আর সেনাবাহিনী দিয়ে হবে না; দরকার হলে স্থানীয় জনগনের সমন্বয়ে কম্যুনিটি পুলিসিং এর আয়োজন করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সেনাবাহিনীর বিশেষ নজরদারির প্রয়োজন হবে। একই জিনিস প্রযোজ্য রামু আর টেকনাফে রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকাগুলোতেও। সেখানকার জিওসি আর কমান্ডারদের নিষ্ক্রিয়তা একটা বিশাল অশনি সংকেত; সেই এলাকার একাধিক অফিসারের কাছ থেকেই আমি এটাই জেনেছি। বছরের পর বছর হাসিনার এসএসএফ আর ডিজিএফআই/ এনএসআই জাতীয় সংস্থায় কাজ করে আসা মানুষজন যখন রামুর মত স্পর্শকাতর স্থানে ডিভিশন/ ব্রিগেডের কমান্ড পেয়ে যান, বিপর্যয় ডেকে আনার জন্য তা যথেষ্ট! কার্যকরী পদক্ষেপের অভাব দেশ ও সেনাবাহিনীকে ভোগাবে।
এই আলোচনার কিছু অংশ আমি গোয়েন্দা সূত্র থেকে পাওয়া তথ্য থেকে বলেছি; কিছুটা বলেছি সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ডিভিশনের অফিসারদের সাথে কথা বলে। আর কিছুটা অবশ্যই আমার আগের অভিজ্ঞতালব্ধ বিশ্লেষন ও অনুমান। আমি মনে প্রাণে চাইব, আমার এই বিশ্লেষন আর অনুমানগুলো যেন ভুল প্রমানিত হয়। কিন্তু যেকোন বিপর্যয়ে রিয়্যাক্টিভ মেজার থেকে যে প্রো-এ্যাক্টিভ মেজার অনেক বেশি ফলপ্রসূ সেটা আমার ধারনা দায়িত্বশীল যারা আছেন, তারা আমার চেয়ে অনেক ভালো জানেন। আমি আশা করব, সবার শুভবুদ্ধির উদয় হবে। হাজারো শহীদের রক্তে কেনা এই নতুন স্বাধীনতা কোনভাবেই আমরা হাতছাড়া করতে পারি না!
লেখক : সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা