নিষ্ঠুর শিক্ষকমুক্ত শিক্ষাঙ্গন চাই

নিষ্ঠুরতামুক্ত শিক্ষাঙ্গন চাই

রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, ‘তোমরা ভালোবাসা ও স্নেহের মাধ্যমে শিক্ষাদান ও সুষ্ঠু লালনপালন নিশ্চিত করো। কখনো নিষ্ঠুরতার আশ্রয় নেবে না। কেননা একজন হৃদ্যতাপূর্ণ অভিজ্ঞ শিক্ষক একজন নিষ্ঠুর শিক্ষকের চেয়ে উত্তম।’ শারীরিক শাস্তি ব্যতিতই মানুষ করার উপায় জানে বলেই অভিজ্ঞ শিক্ষকেরা শারীরিক প্রহার করে না। ইসলামে শিশুদের শাসনের জন্য বেত্রাঘাত করা, ঘুষি দেওয়া, লাথি মারা ইত্যাদি’র অনুমতি নেই। অন্যথায় শাসন পরিণত হবে শোষণে, শিক্ষক পরিণত হবেন জালেমে এবং শিক্ষার্থীরা পরিণত হবে মজলুমে।

কদিন আগে শুনলাম- জন্মদিন পালনের অপরাধে ৬ শিক্ষার্থীকে অমানুষিকভাবে পিটানো হয়েছে। একজন যৌনাঙ্গে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ায় গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এমন শিক্ষকদের কাছে পাঠিয়ে কোনো অভিভাবকই সন্তানের নিরাপত্তার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত থাকতে পারে না। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নানাভাবে খুব বেশি পরিমাণে নির্যাতনের ঘটনায় গা শিউরে ওঠে। স্বপ্ন দেখি এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের, যেখানে কারো কোনো সন্তান কোনো রকম নির্যাতনের শিকার হবে না। সব ধরনের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন মুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত থাকবে। লালনপালনে শারীরিক ও মানসিক শাস্তি একটা উপসর্গ হিসেবে চলে এলেও মানসিক বিকাশে এর অনেক নেতিবাচক প্রভাব বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত।

নবী-রাসূলরা মানুষকে শেখাতে শাস্তি দেয়ার উপায় অবলম্বন করতেন না। সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বন্ধ ঘোষণা করলেও সাংস্কৃতিকভাবে এটা খুব বেশি সমাদৃত হয়নি। এখনো অনেক অভিভাবক ও শিক্ষক শাস্তিকে অপরিহার্য মনে করেন। পুরো সমাজের মনস্তাত্ত্বিক জায়গায় কাজ করা দরকার। কান ধরে হাঁটু গেড়ে দাঁড়াতে বলা বা ভীষণ মারার প্রতিবাদ হওয়া দরকার। আত্মার উন্নয়নের কাজ করতে গিয়ে ভয় দেখিয়ে শারীরিক-মানসিক ক্ষতি করে অধিকার সুরক্ষা হয় না। নির্যাতনের শিকার শিক্ষার্থীরা পরবর্তী সময়ে আক্রমণাত্মক হয়। রাষ্ট্রীয় বিধিব্যবস্থার বাইরে কখনো শাস্তি প্রয়োগ হয় না, যেটা হয় সেটা নির্যাতন।

শারীরিক ও মানসিক শাস্তি একটি কঠোর অপরাধ, কারণ এটি মস্তিষ্কের বৃদ্ধি ও বিকাশে খারাপ প্রভাব ফেলে। অবহেলা, নির্যাতন ও কটু ভাষার ব্যবহার বুদ্ধিবৃত্তি, আচরণ ও আবেগের জটিলতা সৃষ্টি করে। ভাষার ব্যবহারে নেতিবাচক শব্দ পরিত্যাগ করাও জরুরি। শাসন করতে হবে ইতিবাচক ভাষায়, মনোযোগকে ইতিবাচক কাজের দিকে সরিয়ে নিতে হবে। অন্যের সামনে অপমান, বকা ও শাসন করার ক্ষেত্রে সাবধান থাকতে হবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুকে বেত্রাঘাত, কান মলে দেওয়া একধরনের নির্যাতন। বিকৃত মানসিকতার শিক্ষকেরা যৌন নির্যাতনও করেন। এ ধরনের অত্যাচারিতরা পরবর্তী জীবনে এ রকম অত্যাচারী হয়ে ওঠেন।

শিক্ষার্থীদের কোনো রকম নিপীড়ন না করে আনন্দের মধ্য দিয়ে অনুকূল পরিবেশে শেখাতে হবে। অন্যায়কারীর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রকাশ্যে অভিযোগ বাক্স স্থাপন করতে হবে। শিক্ষাকে আনন্দময় করতে আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করায় উদ্বুদ্ধকরণে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। ছোটবেলায় দেখা শাস্তির নানা ধরন- আঙুলের মধ্যে পেনসিল ঢুকিয়ে মোচড় দেওয়া, হাঁটু গেড়ে দাঁড়ানো, কয়েকটি বেত একত্র করে পেটানো, কানে ধরে উঠবস করানো। সেই সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক জায়গায় পরিবর্তনটা আনেতে হবে। আগে গ্যাং বাহিনী, কিশোর ধর্ষণকারী ছিল না; মেয়েরা সমাজে নিরাপদ থাকত। এখনকার সমাজে সমবয়সীর কাছেও নির্যাতিত হচ্ছে। ফলে দৃষ্টিভঙ্গিগত পরিবর্তন খুব বেশি দরকার। শারীরিক ও মানসিক শাস্তি সামাজিক অপরাধ, এই বোধ জাগ্রত করা জরুরি।

সব বয়সী শিক্ষার্থীরাই মানুষ। তাদের ভয় দেখানো, আটকে রাখা এবং চাপ প্রয়োগ করা যাবে না; আবেগের মূল্য দিতে হবে। তাকে ভুল পথে নিয়ে যাওয়া এবং অবজ্ঞা করা থেকে বিরত থাকতে হবে। শিক্ষকদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। নির্যাতনের ঘটনার তদন্ত হতে হবে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। শিক্ষার্থীর মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ ঘটানো খেয়াল রাখাই শিক্ষকের কাজ। শিক্ষকের শৃঙ্খলাবদ্ধ করার নামে শাস্তি দেয়া সুপ্ত প্রতিভা বিকশিত করার ক্ষেত্রে সহায়ক নয়। শারীরিক, মানসিক ও লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া অপরাধ; নির্যাতনের শিকারদের জন্য পর্যাপ্ত আর্থিক সহায়তা বা ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো মৌখিক বা আকার-ইঙ্গিতে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা, ভীতি প্রদর্শন করা, আবেগের চাহিদার প্রতি নজর না দিয়ে অবজ্ঞা ও অবহেলা করা, আবেগের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা, কাঁদলে থামিয়ে দেওয়া, আবেগকে অবদমিত করে দেওয়াও মানসিক নির্যাতন। যা ধারণার জগতের পরিবর্তন ঘটায়, নৈতিক উন্নতিতে বাধা দেয় এবং আবেগের বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে, পারসোনালিটি ডিসঅর্ডার হয়, আচরণের পরিবর্তন ঘটে।

একজন ক্লাসমেট পায়ে ব্যথা পেয়েছে। কেটে রক্তও পড়ছে। আরেকজন ক্ষতস্থানে পানি দিতে তাকে শ্রেণিকক্ষের বাইরে নিয়ে গেছে। দু’জন শিক্ষার্থীর ক্লাসের বাইরে যাওয়া দেখেনি শিক্ষিকা, কারণ মোবাইলের স্ক্রিনে মনোযোগী থাকা। ক্লাসে ফেরার পর কান ধরে উঠবস করিয়েছে বান্ধবীর কষ্টে সমব্যাথী সহযোগী ক্ষুদে শিক্ষার্থীকে। যা তার মানবিক মর্যাদা লাভের অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করছে।

ক্লাসের সময়টাতে বেঞ্চের ওপর পুরোপুরি দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে বই নিয়ে না যাওয়ায়। ফলাফল শিক্ষার্থীর কান্না, লজ্জা ও সংশ্লিষ্ট শিক্ষকের ক্লাস করার ব্যাপারে অনাগ্রহ। শেখানোর কৌশল হিসেবে শাস্তি একটি অকার্যকর পদ্ধতি। কারণ উপলব্ধি না করে শুধু শাস্তি এড়ানোর জন্যই কোনো আচরণ করতে শিখলে পুনরায় একই আচরণ করে। শারীরিক-মানসিক কষ্ট দেয়া, শিক্ষার্থীর অধিকারের লঙ্ঘন। শারীরিক শাস্তির কোনো ইতিবাচক ফল নেই, এটি সম্পর্কের অবনতি ঘটায় এবং শিক্ষার্থীর জন্য দীর্ঘমেয়াদে অনেক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

বাথরুমে ছিটকিনি লাগিয়ে আটকে রাখায় শিক্ষার্থী সাংঘাতিক ভয় পেয়েছে। শাস্তি শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য, বিকাশ ও শিক্ষাকে প্রভাবিত করে এবং শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের বড় ক্ষতি করছে। বেশিরভাগ সময়ই শাস্তির ঘটনা ঘটে শিক্ষকদের ব্যক্তিগত বা পেশাগত জীবনের হতাশা থেকে। আসলে ইতিবাচকভাবে শিক্ষার্থীদের বড় করা ও শিক্ষাদান সম্পর্কে শিক্ষকদের দক্ষতা বাড়াতে হবে।

শৃঙ্খলার নামে শিক্ষার্থীদের আঘাত করাকে যারা যৌক্তিক মনে করেন তারা সামাজিক পরিবর্তনকে অস্বীকার করেন। নিয়ন্ত্রণের নামে পিটিয়ে আহত করে হাসপাতালে পাঠানোর কাজ পুলিশের হতে পারে, শিক্ষকের হতে পারে না। কারণ শিক্ষকের কাজ মনকে জাগানো, আত্মাকে আলোকিত করা- যা তার নফস বা প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করবে; জোর-জবরদস্তি করে নিয়ন্ত্রণে রাখা নয়। ভয়ের সংস্কৃতির বিকল্প সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব দূর করা গেলে শিক্ষকদের এমন নেতিবাচক আচরণ কমে যাবে।

অনেক সময় দেরিতে ক্লাসে আসায় বেত্রাঘাত করা হয়, কারণটা দেখা হয় না। অথচ এর পেছনে অভিভাবকেরও দায় থাকতে পারে। ফলাফল- লেখাপড়ার প্রতি ভয় জন্মানো, আনন্দ হারিয়ে যাওয়া, ভীতি সৃষ্টি হওয়া, বেত্রাঘাতকারী শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ কমে যায়। পড়া না পারায় বেত্রাঘাত করে গুরুতর আহত করা বা প্রশ্নের উত্তর লিখতে দেরি হওয়ায় মেরে হাসপাতালে ভর্তি করার ঘটনা ঘটছে। বেত্রাঘাতে চোখ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হবে, শিক্ষার্থীর পায়ে পচন ধরায় পায়ের একাংশের মাংস কেটে ফেলতে হবে- এমনটি পৈশাচিকতা।

শিক্ষকের বেত্রাঘাতে যখন হাসপাতালে শিক্ষার্থীর মৃত্যু ঘটে, অভিমানে আত্মহত্যা করে, ভয়ে পালিয়ে যায়- তখন শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যই ব্যহত হয়। শিক্ষক শিক্ষার্থীর শরীরের যে স্থানে প্রহার করেন, তা জাহান্নামের জন্য হারাম হয়ে যায়, কথাটি সত্য নয়। আগে দুষ্টুমির কারণে শিক্ষকরা বেত দিয়ে পিটিয়েছেন বলেই এখনও পিটাতে হবে এমন কোনো কথা নেই। বিদ্যালয়ে দেরিতে যাওয়ায় জুতাপেটা করে আহত করার ঘটনাও ঘটে। যারা ভাবেন যে শারীরিক শাস্তি সামান্য মাত্রার ব্যথা দেয়, যতটুকু শারীরিক বল প্রয়োগে সামান্য অস্বস্তি হয়- তাতে সমস্যা নেই। অথচ নিষ্ঠুর ও অবমাননাকর আচরণ শিক্ষার্থীর মর্যাদা ক্ষুণ্ন করে; বেড়ে ওঠা ও আচরণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এগুলো প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থাতে প্রভাব রাখে যেমন দুর্বল মানসিক স্বাস্থ্য, জ্ঞান বৃদ্ধিতে  বাধা, পড়াশোনার ফল খারাপ হওয়া, নৈতিক দুর্বলতা, সহিংস কিংবা অসামাজিক আচরণ।

ম্যাডামরা ক্লাসে স্মার্টফোনে ইন্টারনেটে ইউটিউভের ভিডিও দেখায় এবং সোস্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন কনটেন্ট নিয়ে গল্প করে। ক্লাসে দেয়াল ঘড়ি বা হাত ঘড়ি না থাকায় সময় দেখার প্রয়োজন ক্লাসে স্মার্টফোন নেয়ার পেছনের যুক্তি দেয়। স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারেন না, ক্লাসে এসে ঘুমিয়ে যান, ঘুম থেকে জেগে দেখেন দু’একজন শিক্ষার্থী সহপাঠীদের পড়াচ্ছেন- এমন শিক্ষক যদি বলেন, আল্লাহ এভাবেই সাহায্য করেন। এ থেকে শিক্ষার্থীরা কী ম্যাসেজ পাবে?

টয়লেটগুলো নোংরা। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বালাই নেই। আয়া-দারোয়ান একসাথে গল্প-গুজব করে সময় কাটায়। দারোয়ান মেয়েদের গায়ে টাচ করে, জড়ায়ে ধরে। গায়ে হাত দিয়ে বিরক্ত করে। ক্যান্টিনের লোক বাইরে যেতে দেয় না, নিজস্ব ক্যান্টিনে খেতে বাধ্য করে। প্রাইভেট পড়া- না পড়া, পারিবারিক আর্থসামাজিক অবস্থার কারণে সুযোগ-সুবিধার কম-বেশি করার বৈষম্য জ্ঞানচর্চার অন্তরায়।

শিক্ষকের স্ক্রিন আসক্তি ভয়াবহ!  স্ক্রিন আসক্ত একজন শিক্ষক স্ক্রিনে ডুবে থাকায় প্রকৃত ঘটনা না জেনে বা না দেখেই একজনকে পিটিয়ে এমনভাবে আহত করে ঠোঁট কেটে রক্ত পড়তে থাকে। যারা শিক্ষকদের দ্বারা মারধর ও অপমানের শিকার হচ্ছে, নির্যাতন সহ্য করতে বাধ্য হচ্ছে; তাদের নীরব কান্না খুব কম জনই শুনতে পারছে! শিক্ষার্থীদের বিষয়ে শিক্ষকদের দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন এনে একটি শিক্ষার্থী–সংবেদনশীল শিক্ষকসমাজ গড়তে হবে। শারীরিক শাস্তি বিলোপ করা গেলে তা স্বাভাবিক বিকাশ, শিক্ষা ও কল্যাণে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।

ধমক ও বকাঝকা থেকে শুরু করে সকল প্রকার সহিংসতা থেকে মুক্তির অধিকার শিক্ষার্থীদের রয়েছে। কিছু শিক্ষকতো খুদে শিক্ষার্থীদের পূর্ণাঙ্গ মানুষ হিসেবে মর্যাদাই দেন না, শক্তির ব্যবহার বেশি করে ফেলেন। নিরাপদ আঘাত, মদু আঘাত, স্নেহময় আঘাত- যাই বলি না কেন; শারীরিক আক্রমণে মানবিক মর্যাদার প্রতি অসম্মানই দেখানো হয়। কোনো সময় অপরাধের কারণে অপরাধীকে শাস্তি দিলেও তা ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে হয়।

এ কেমন শিক্ষক, যে একাধিক অভিভাবকের সাথে পরকিয়ায় জড়ায়। চরিত্রহীন, মিথ্যাবাদী ও প্রতারক কাউকেই শিক্ষকতায় থাকতে দেয়া উচিত নয়। যাকে সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকতে হয়, বকুনি খেতে হয়, মারধরের আতংকে থাকতে হয়- তার কাছে পড়াশোনাতো নিরানন্দেরই হবে! শিক্ষক সহপাঠীদের সামনে অপমান করলে সে নিজেকে অপরাধী ও হীন মনে করে। অপমানবোধ তার মধ্যে বিদ্যালয়, শিক্ষক, পড়ালেখা ও সহপাঠীদের প্রতি অনীহা ও ঘৃণা সৃষ্টিতে সহায়তা করে।

আমরা চাই না, শিক্ষকের দেয়া শাস্তি দীর্ঘমেয়াদি প্রতিবন্ধিতা বা মৃত্যু ঘটাক; রোগের পেছনে দায়ী হোক। আচরণগত ও উদ্বেগ সংক্রান্ত ডিজঅর্ডার, বিষণ্নতা, হতাশা, নিজের ক্ষতি করার চেষ্টা করা বেড়ে যাক। ঘৃণা ও নিন্দার সংস্কৃতিতে কখনো কখনো আত্মহত্যার চেষ্টা বাড়ে, আবেগ নিয়ন্ত্রণ ও দ্বন্দ্ব নিরসনে দক্ষতার ঘাটতি দেখা দেয়, বিদ্যালয় থেকে ঝরে পড়ে; আগ্রাসী আচরণ, অপরাধপ্রবণতা, অন্যান্য ধরনের সহিংসতা বাড়ে এবং পারিবারিক সম্পর্কও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

যে শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থী যৌন নিপীড়নের শিকার হন, সে শিক্ষক সমাজের কলংক। শাস্তি, রাগ ও ভয়ে শিশুর মস্তিষ্কে এক ধরনের হরমোন নির্গত হয়, যা তার মস্তিষ্কের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতাকে ক্ষণিকের জন্য বাধাগ্রস্ত করে। এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটলে শিশুর মস্তিষ্কের গঠন ও আকৃতিতে স্থায়ী পরিবর্তন বা ক্ষতির আশঙ্কা থাকে।

আনন্দপ্রিয় শিক্ষার্থীরা আনন্দময় পরিবেশ থেকেই বেশি শিখে। শাস্তি, অপমান ও ভীতিকর বা আনন্দহীন পরিবেশে স্বাভাবিক অবস্থা থেকে অনেক কম শিখে। কোনো কাজের জন্য শাস্তি দিলে শাস্তিদাতার প্রতি বিদ্বেষ, বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়। এই ছাপটা দীর্ঘ হয়। বয়সকালেও এটা তাকে প্রভাবিত করে। তাই শিশুর শারীরিক শাস্তি কোনোভাবেই কাম্য নয়। শিশু কোন অপরাধ করেছে, এটা যদি সে না বোঝে, তাহলে তার বোধের মাত্রায় নেমে অভিভাবক, শিক্ষককে সেটা বোঝাতে হবে।

শিক্ষকদের সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করে। তারা যখন শাস্তি দেয়, তখন অনেকটা স্বাভাবিক মনে করে এবং তা নিজের মধ্যে ধারণ করে রাখে। এরা বড় হয়ে শিশুদের ওপর নির্যাতন চালাতে পারে। শিক্ষক, অভিভাবক, প্রতিবেশী, স্বজনরা যদি শিশুদের শাস্তি দেওয়া বন্ধ না করেন, তাহলে সমাজে সহিংসতার এই চক্র ভাঙা অসম্ভব হবে।

অনেক শিক্ষকের বদ্ধমূল ধারণা, শাসন বুঝি শুধু মুখের কথায় বা অত্যধিক কড়াকড়ি ছাড়া হয় না। বেত, লাঠি কিংবা চাবুক বিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনার প্রক্রিয়া বর্বর। শারীরিক প্রহার শিশুদের মনে স্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, এর মাধ্যমে কখনো সঠিক শাসন নিশ্চিত হয় না। এটিকে সাময়িকভাবে ফলপ্রসু মনে হলেও স্থায়ী মানসিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

হরহামেশাই অধিক শারীরিক শাস্তি-প্রহার ভবিষ্যতে দুর্বল-কাপুরুষ ও নিস্তেজ ব্যক্তিতে পরিণত করে, নয়তো দুর্ধর্ষ ও একরোখা মানুষে পরিণত করে। তার মনে ধারনা জন্মে, যেকোনো কাজে বলপ্রয়োগই সফলতা এনে দেয়, কারো উপর রাগান্বিত হলেই তাকে পেটাতে হয়। সেও শাসনের ক্ষেত্রে একই পন্থা অবলম্বন করে। শিক্ষকের প্রতি তার মনে এক গভীর ক্ষোভের তৈরি হয়, একবার বিরূপ ধারণা জন্ম নিলে তা কখনোই মন থেকে মুছে যায় না। কখনো কখনো শিক্ষকের প্রতি বিদ্রোহাত্মক হয়ে ওঠে। এর ফলে ব্যক্তিত্ব মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, মানসিক রোগীতে পরিণত হয়, নিজেকে শোধরানোর পরিবর্তে পুনরায় সেই অপরাধ করার সুযোগ খুঁজতে থাকে।
মানুষকে মৌখিক শাসনের মাধ্যমে সংশোধন করা যায়, শুধুমাত্র পশুদেরকে শারীরিক শাস্তির মাধ্যমে সংশোধন করতে হয়। রাখাল ও শিক্ষকের মধ্যে পার্থক্য এখানেই। শুধুমাত্র শিক্ষকের লাঠিকে ভয় অপরাধবোধকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। শিক্ষকদের শিশুদের সঙ্গে আচরণে বিস্তর প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে অভিভাবক ও সমাজের জনসচেতনতার জন্যও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া চাই।

লেখক: গবেষক ও সাংবাদিক

Scroll to Top