প্রায় বছরখানেক পর হাতে কলম নিলাম। পরাধীন দেশে কোথায় বা লিখবো, আর সেটা পড়বেই বা কে? এক বছর আগে সাংবাদিক সংগঠন বিএফইউজের বার্ষিক প্রকাশনায় একটা নাতিদীর্ঘ লেখা দিয়েছিলাম। এবারও ওদের আগ্রহেই কালি-কলমের এই অর্থহীন ব্যবহার। লেখার শুরুতেই তারিখটা বলে রাখি। ৯ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮। ঢাকা শহরের নাজিম উদ্দিন রোড়ের অপরিচ্ছন্ন, অস্বাস্থ্যকর, পরিত্যক্ত, জেলখানায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার এক রাত কাটানো হয়ে গেছে। উনিশ শতকের নির্মিত সেই খণ্ডহরে তিনিই একমাত্র বন্দী। ক্ষমতাসীন, অবৈধ সরকারের বংশবদ আদালতে এক ভুয়া, জালিয়াতিমূলক মামলায় তাকে পাঁচ বছরের সাজা দেয়া হয়েছে। গতকাল থেকেই মনটা বড়ই বিক্ষিপ্ত। দিল্লির তাবেদারির অধীন ভূখণ্ডের আদালত, পুলিশ, কারাগার, সরকার, সেনাবাহিনী এবং সর্বোপরি ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া মানুষদের অসহায়ত্ব নিয়ে এত কথা জমে আছে যে, কোনো বিষয়ে গুছিয়ে লেখা আমার সাধ্যাতীত। পাঠক নিজগুনে এই অগোছালো লেখাকে ক্ষমা করবেন।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সরকারেরর অভিযোগ তিনি নাকি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের টাকা আত্মসাৎ করেছেন যা কিনা শেখ হাসিনার ভাষায় এতিমের টাকা মেরে খাওয়া। ভারতের সাবেক রাষ্ট্র্রপতি প্রনব মুখার্জীর অধীনস্ত বাংলাদেশের সামরিক কর্তা, খর্বকায় জেনারেল মইনের এক এগারোর প্রচ্ছন্ন সামরিক সরকার (Quasi-military regime) ভুয়া মামলাটি এক দশক আগে দায়ের করেছিল। এই দুর্ভাগা দেশের সাবেক সেনাপ্রধান যে প্রনব মুখার্জীর হুকুমে চলতেন সেই তথ্য প্রবীণ কংগ্রেসী নেতা তার রাজনৈতিক আত্মজীবনী মূলক বইয়ে (The Coaliton Years, c„ôv 114-115) কোনো রাখডাক না করেই প্রকাশ করেছেন।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টে আদতে ঘটেছেটা কী?
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের স্মৃতি রক্ষার্তে একটি সেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়বার জন্যে কুয়েত সরকার ১৯৯২ সালে এক মিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি অনুদান দেয়। সেই অনুদানের টাকায় জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট নামক বেসরকারী ( ) ট্রাস্টটি গঠন করা হয়। সরকারের অভিযোগ যে ট্রাস্টের কিছু অর্থ বিভিন্ন ব্যক্তির নামে এফডিআর করে সাময়িকভাবে সরানো হয়েছিল যদিও পরবর্তীতে সমুদয় অর্থ ট্রাস্টের একাউন্টেই ফেরত গেছে। পুরো লেনদেনে একটি টাকাও তছরুপ করা হয়নি। একেই শেখ হাসিনা ও তার আজ্ঞাবহরা এতিমের টাকা মেরে খাওয়া বলে মাতম করছেন।
আমরা যদি খানিকক্ষণের জন্যে মেনেও নেই যে কোন প্রাইভেট ট্রাস্টের টাকা সাময়িকভাবে স্থানান্তর করলেই সেটি ফৌজদারী অপরাধ রূপে গণ্য হবে তাহলেও দুদক আইন এখানে প্রযোজ্য হতে পারে না। এক্ষেত্রে জনগনের কোনো টাকা (Public Fund) লেন-দেন হয়নি। প্রাইভেট ট্রাস্ট পরিচালনায় ভুল-ক্রুটি হলে কিংবা নিয়মের কোন ব্যত্যয় ঘটলে তার বিচার দেশের অন্য প্রচলিত আইনে হলেই বরং জনগণ দুদকের উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়রানি থেকে মুক্ত থাকবেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে দুদক আইনে এই বিচার প্রক্রিয়াই প্রশ্নবিদ্ধ। এবার আসি অভিযোগে বেগম খালেদা জিয়ার সম্পৃক্ততা প্রসঙ্গে। তিনি ট্রাস্টের অর্থ লেন-দেনের কোনো নির্দেশ দেন নাই। যে সকল চেকের মাধ্যমে অর্থ উত্তোলিত হয়েছে সেখানেও তার কোনো স্বাক্ষর নাই। কোনো অপরাধ ঘটে থাকলে তার দায়ভার যারা টাকা লেন-দেন করেছে শুধু তাদের কাঁধেই বর্তাবে। এখানে খালেদা জিয়ার ভূমিকা কোথায়? আইনের ভাষায় অভিযুক্ত লেন-দেনে তিনি একজন আগন্তুক (Stranger) মাত্র।
কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অধ:স্তন কর্মচারী যদি নিজ দায়িত্বে তছরূপ করে তাহলে সেই প্রতিষ্ঠানের মালিককে অভিযুক্ত করার কোনো আইনগত সুযোগ থাকে না। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে খালোদ জিয়াকে এই মামলায় জড়ানো হয়েছে। দেশে ন্যূনতম আইনের শাসন কিংবা বিচার বিভাগের সামান্যতম স্বাধীনতা থাকলে উচ্চ আদালত অনেক আগেই খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলাটি স্থগিত করে দিত। এদেশে বিচার বিভাগের কফিনে শেষ পেরেক এস কে সিনহা নাটকের মাধ্যমে মারা হয়ে গেছে। আমার প্রশ্ন হলো, বিচার ব্যবস্থা যে অনেক আগেই ক্ষমতাসীন মহলের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে- সে বিষয়ে সারা দেশ ওয়াকিবহাল হলেও বেগম জিয়া কিংবা তার দলের নেতৃবৃন্দ অথবা মামলা পরিচালাকারী বিজ্ঞ আইনজীবীবৃন্দ কি অন্ধকারে ছিলেন? আমি রায় দেয়ার আগের দিন পর্যন্ত স্বকর্ণেই বিএনপিপন্থী অনেক আইনজীবীকেই বলতে শুনেছি যে বেগম খালেদা জিয়া নাকি খালাস পেতে চলেছেন! এই আশাবাদীরা সম্ভবত: ভিন্ন গ্রহের বাসিন্দা। বিরোধী দলীয় নেত্রীকে যে সাজা দেয়া হচ্ছে সেটা আকস্মিকভাবে রায়ের দিন ঘোষণার পর থেকেই বোঝা যাচ্ছিল। সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী থেকে পাতিনেতারা পর্যন্ত মিডিয়াতে বারংবার খালেদা জিয়াকে জেলে পাঠানোর আগাম ঘোষণা দিয়েছেন।
নাজিমউদ্দিন রোডের জেলখানাও এক সপ্তাহ ধরে ঘষা-মাজা করা হয়েছে। জেলের চারদিকে পুলিশ এবং র্যাবের স্বার্বক্ষণিক উপস্তিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। অর্থাৎ সরকারের নীতিনির্ধারক মহল রায় সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত ছিলেন এবং তারা প্রশাসনের সকল স্তরে যথাযথ প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশও দিয়ে রেখেছিলেন। উট পাখির মতো বালিতে মাথা গুঁজে ছিলেন কেবল বিএনপির বড়ই সরল নেতৃবৃন্দ।
মোক্ষম সময়ে শেখ হাসিনার বিশেষ ভারতীয় মুরব্বী শ্রী প্রনব মুখার্জীর বাংলাদেশ সফরও অত্যন্ত তাৎপর্যময়। বেগম জিয়ার প্রতি প্রনব বাবুর তীব্র ব্যক্তিগত বিদ্বেষ এবং শেখ হাসিনার প্রতি অসীম স্নেহের বিষয়টি সর্বজনবিদিত। প্রনব মুখার্জী কিভাবে জেনারেল মইন এবং শেখ হাসিনার মধ্যে দূতিয়ালি করে ২০০৮ সালের সাজানো নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় এনেছিলেন সেটি স্মৃতিকথায় বেশ দম্ভভরেই লিখেছেন। কৃতজ্ঞ শেখ হাসিনা সর্বশেষ ভারত সফরে সকল প্রটোকল এবং জাতির সম্ভ্রম জলাঞ্জলি দিয়ে দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনের হেঁসেলে ঢুকে প্রনবকে নিজে রান্না করে খাইয়েও এসেছেন। খালেদা জিয়ার সাজা প্রদানে অঘটনঘটন পটিয়সী প্রনব কী ভূমিকা রেখে গেছেন সেটা এখন প্রকাশিত না হলে ও দাম্ভিক ব্রাহ্মণসন্তান হয়তো আত্মজীবনীর পরবর্তীখণ্ডে সবিস্তারে বর্ণনা করবেন। তবে বাংলাদেশের জনগণকে প্রনব মুখার্জী কতটা নীচু নজরে দেখে থাকেন সেটা তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে প্রকাশ করে গেছেন। বাংলাদেশকে তার অবস্থান বুঝিয়ে দিতে ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনও কোনো কার্পণ্য করেনি। হাইকমিশনের ওয়েবসাইটের ছবিতেই দেখা গেছে ব্রিটিশ আমলের ব্রাহ্মণ জমিদারের ভঙ্গিমায় উপবিষ্ট প্রনব মুখার্জী এবং তার পিছনে সারি বেধে দণ্ডায়মান ব্রাহ্মণ্যবাদের অভিধান অনুযায়ী কজন ম্লেচ্ছ অথবা যবন নারী-পুরুষ। এরা প্রত্যেকেই বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের কেষ্ট-বিষ্টু। অথচ নীচু জাতের প্রজাসুলভ বিগলিত অভিব্যক্তি ফুটে উঠেছে সবকটির তৈলাক্ত মুখাবয়বে। ওই একটি ছবিই বাংলাদেশের স্বাধীণতার প্রকৃত স্বরূপ ধারণ করে রয়েছে।
সেই ২০১০ সালে আমার দেশ পত্রিকায় স্বাধীন বিচারের নামে তামাশা শিরোনামে মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছিলাম। গত আট বছরে পদ্মা, মেঘনা, যমুনা দিয়ে যত না পানি গড়িয়েছে নদীখাতে তার চেয়ে অনেক বেশি পলি জমেছে বন্ধু রাষ্ট্র(?) ভারতের বন্ধুত্বের নিদর্শনরূপী উজানের ডজন ডজন বাঁধের কল্যাণে। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের জনগণ একের পর এক তামাশার বিচার দেখেছে। খালেদা জিয়াকে অন্যায়ভাবে গৃহচ্যুত করেছে বাংলাদেশের আদালত। শহীদ জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণাকে অস্বীকার করে মহান মুক্তিযুুদ্ধের ইতিহাস নতুন করে লেখার দায়িত্ব নিয়েছেন মাননীয় বিচারপতিবৃন্দ। নবরূপে বাকশাল প্রতিষ্ঠার পথ সুগম করতে আদালত থেকেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রথা বাতিল করা হয়েছে। খালেদা জিয়াকে ভুয়া অভিযোগে সাজা দিয়ে জেলেও পাঠাল সেই আদালত। নগ্ন দলীয়করণের মাধ্যমে নিম্ন ও উচ্চ আদালতে শত শত বিচারক নিয়োগ পেয়েছেন। হাইকোর্টে জুনিয়রদের দাপটে সিনিয়ররা কম্পমান। ভাগ-বাটোয়ারায় গণ্ডগোল হওয়ায় কর্মরত প্রধান বিচারপতিকে শারীরিক ও মানসিকভাবে লাঞ্ছিত করে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। যে জ্যেষ্ঠ বিচারপতি প্রধানের আসনে অধিষ্ঠানের উদগ্র বাসনায় সরকারের গুণ্ডামিতে সহায়তা করেছেন শেষ পর্যন্ত তাকেও উচিৎ শিক্ষা দিয়ে জুনিয়রকে সিনিয়র বানানো হয়েছে। আমার কলমের কালি ফুরিয়ে যাবে, কিন্তু শেখ হাসিনার জমানায় আদালত নিয়ে তেলেসমাতির কাণ্ড লিখে শেষ করতে পারব না। এত কাণ্ডের পরও বিএনপিপন্থী বিজ্ঞ আইনজীবীরা উচ্চ আদালতে ন্যায়বিচাার পাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করে মিডিয়াতে বক্তব্য দিয়ে চলেছেন। দলের মহাসচিব বলছেন- খালেদা জিয়ার রায়ের ফলে আদালতের প্রতি জনগণের আস্থা কমবে। অর্থাৎ আদালতের প্রতি জনগণের আস্থা আগে ছিল কিংবা এখনও আছে! অধিক শোকে পাথর হওয়া ছাড়া আর উপায় কী?
এই তো সেদিন মহামান্য রাষ্টপতি ঐরং His Lordship প্রধান বিচারপতিকে নিয়োগ দিয়েছেন। তিনি একসময় আওয়ামী লীগ সরকারেরই ডেপুটি এটর্নি জেনারেল পদে কর্মরত ছিলেন। সকল আধুনিক রাষ্ট্রেই নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতিকে বার এবং বেঞ্চের সম্বর্ধনা প্রদান একটি সুশীল প্রথা। সংবাদপত্রে পড়লাম সেই সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে স্বয়ং অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন কোনো কোনো বিচারপতির কারণে বিচারাঙ্গন থেকে নাকি দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। আমার তো ভিমড়ি খাওয়ার অবস্থা । কী ভয়ানক আদালত অবমাননাকর বক্তব্য! এই কথা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই তো ঐরং His Lordship এবং My Lord দের গর্জে ওঠার কথা ছিল। কিন্তু, সবাই নীরবে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করেছেন। আরে বাবা, উপায় কী? অদ্ভুত উটের পিঠে সওয়ার বাংলাদেশে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম যে প্রধান বিচারপতির চেয়েও অধিক ক্ষমতাধর সেটা তো এস কে সিনহা বহিষ্কার ড্রামাতেই দেশবাসীর মালুম হয়েছে। কোনো বিচারপতি এটর্নি জেনারেলের কথার প্রতিবাদ করলে নিমেষের মধ্যে অস্ত্রধারী বিশেষ সংস্থার লোকজন প্রতিবাদকারীকে শায়েস্তা করতে যে ছুটে আসত না তার নিশ্চয়তা কোথায়?
পুরনো কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। আদালত অবমাননা মামলায় ২০১০ সালে আমাকে আইনের গণ্ডি পেরিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সাজা দিয়েছিল আপিল বিভাগ। আমি মন্তব্য প্রতিবেদনে লিখেছিলাম জেনারেল মইন এবং শেখ হাসিনা এই দুই সরকারের কারণে আদালত থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। অর্থাৎ অপরাধ আদালতের ছিল না, অবক্ষয়ের জন্যে আমি সরকারকে দায়ী করেছিলাম। বিচারপতি সিনহা চোখ পাকিয়ে আমাকে বলেছিলেন, আপনি নিজেকে কী মনে করেন? আমাদের Inherent Power দিয়ে আদালত অবমাননার কারণে আপনাকে যা ইচ্ছা সাজা দিতে পারি। প্রচলিত আইনের সীমার মধ্যে থাকতে আমরা বাধ্য নই। ভাবখানা এমন যে চাইলেই তারা আমাকে মৃত্যুদণ্ডও দিতে পারতেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে বিচারপতি এস কে সিনহা আজ পরবাসে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। কোনো Inherent Power তাকে শেখ হাসিনার রূদ্ররোষ থেকে রক্ষা করতে পারেনি। আসলে ক্ষমতা এখন আদালতে তো নেইই এমনকি বাংলাদেশেই যে নাই। সকল ক্ষমতার ভরকেন্দ্র যে দিল্লিতে চলে গেছে এই খবরটি দিল্লির এত কাছের মানুষ হয়েও এস কে সিনহার অজানা ছিল এটাই আশ্চর্য।
সর্ব বিবেচনায় বাংলাদেশ একটি নির্যাতনকারী পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। বিশ্বে আর কোন দেশে বলুন তো, পুলিশের কোনো বড় কর্তা উচ্চ আদালতের আইনজীবীদের প্রকাশ্যে মুখের জিয়োগ্রাফি পাল্টে দেয়ার হুমকি দিতে পারে?
শেখ হাসিনা বিগত নয় বছরে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের লাখে লাখে পুলিশ বানিয়েছেন। আমি দীর্ঘদিন রিমান্ডে ডিবিতে ছিলাম। সেখানে যে কজন পুলিশ কর্মকর্তার দেখা পেয়েছি তারা প্রত্যেকেই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাবেক নেতা। সকলেরই চাকরি হয়েছে ২০০৮ পরবর্তী সময়কালে। সপ্তাহ দুয়েক আগে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সভা গেল। সেখানে প্রদত্ত বক্তৃতায় খালেদা জিয়ার পুলিশ সংক্রান্ত মন্তব্য পড়ে আমি রীতিমত বিষম খেয়েছি। তিনি দাবি করেছেন পুলিশ নাকি বিএনপির পক্ষে! হয় খালেদা জিয়াকে ভুল তথ্য দেয়া হয়েছে। অথবা তিনি কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করতে এই অসার দাবি করেছেন। বোকার স্বর্গে বাস করে কোনো ফায়দা নাই। ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে প্রতিপক্ষের ক্ষমতা সম্পর্কে স্বচ্ছ ও বাস্তবসম্মত ধারণা থাকা এবং দেয়া নেতৃত্বের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। ভুল তথ্যের ভিত্তিতে আন্দোলনে নামলে ২০১৫ সালের ব্যর্থতারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে।
ক্ষমতাসীন মহল কেবল ফ্যাসিস্ট এবং অবৈধই নয়, তারা বিশ্বে দুর্নীতির সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। দুর্নীতির পরিমাপ এখন আর কেউ কোটিতে করে না । হিসেব করতে হয় হাজার কোটির গাণিতিক মানে। ব্যাংক থেকে চার হাজার কোটি টাকা লোপাট হলে বয়োবৃদ্ধ অর্থমন্ত্রী তুড়ি মেরে বলেন, এটা একটা টাকা হলো। ফার্মার্স ব্যাংকের হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে শেখ হাসিনা সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এবং বর্তমানে ভোটারবিহীন সংসদের সদস্য মখা আলমগীর বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। বেসিক ব্যাংককে দেউলিয়া বানানো বাচ্চু গংদের দুদক টিকিটিও ছুঁতে পারে না। বাচ্চু সাহেবরা যে রাজপরিবারের জ্ঞাতি-গুষ্ঠি। ২০০৯ সাল থেকে আওয়ামী লীগের লুটেরা বাহিনী রাতারাতি যে সকল ব্যাংকের মালিক হয়েছে তার অধিকাংশই আমানতকারীদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। আর তাদের নেতা শেখ হাসিনা দুই কোটি টাকা আত্মসাতের ভুয়া মামলায় খালেদা জিয়াকে জেলে পাঠিয়ে দম্ভভরে বলছেন, কোথায় আজ খালেদা জিয়া? আমার মতো প্রবীনদের নিশ্চয় স্মরণে আছে যে সিরাজ শিকদারকে পুলিশ হেফাজতে হত্যার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মরহুম শেখ মুজিবর রহমান একই ভঙ্গিতে বলেছিলেন, কোথায় আজ সিরাজ শিকদার? ইতিহাস ফিরে ফিরে আসে।
দুর্ভাগ্যের কথা হলো, এত অন্যায়, অবিচার, জুলুম সত্ত্বেও দেশে কোনো কার্যকর প্রতিবাদের আওয়াজ উঠছে না। শেখ হাসিনার গল্পের গাধা অর্থাৎ সুশীল সমাজ ঘোমটা টেনে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বিএনপি আমলে তাদের চোটপাট ছিল দেখার মতো। ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধের বোঝার ভারে জামায়াতে ইসলামী জমিনে মিশে গেছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক বলার সময় এসেছে। আলেম সমাজের সংগঠন হেফাজতে ইসলাম সরকারের লাঠি এবং মূলার (Carrot and Stick) কৌশলের কাছে পরাজিত হয়ে বিভক্ত, বিপর্যস্ত এবং অনেকাংশে আদর্শ বিচ্যুত। ২০১৫ সালের আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে বিএনপি সেই যে ঘরে ঢুকেছে, আর সাহস করে রাস্তায় নামতে পারছে না। দৃশ্যত: শহীদ জিয়ার হাতে গড়া দলটির নেতৃত্বের একাংশের মধ্যে ভারতভীতি অত্যন্ত প্রবল। তারা ধরেই নিয়েছেন যে দিল্লি ছাড়া গতি নাই। দিল্লির আনুকূল্যের আশায় সেই সব নেতারা দোরে দোরে ধর্ণা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। এরা বুঝতে অক্ষম যে এ-টিম আওয়ামী লীগ এবং বি-টিম জাতীয় পার্টি থাকতে সি- টিমের প্রয়োজন দিল্লির কাছে নেই। দেশের সকল স্বার্থ জলাঞ্জলী দিয়ে শেখ হাসিনা ভারত মাতার আঁচল ভরে দিয়েছেন বাংলাদেশের সম্পদে। তার চেয়ে অতিরিক্ত কিছু দেয়ার ক্ষমতা খালেদা জিয়ার কেন, বাংলাদেশের কাছেই আর নেই। দিল্লির বাংলাদেশ নীতিতে যে কোনো পরিবর্তন আসেনি সেটি খালেদা জিয়ার সাজার মধ্য দিয়ে পুনর্বার প্রমাণিত হয়েছে। আশা করি এবার অন্তত: তাদের মোহভঙ্গ হবে। জনগণের কাছে ফিরে যাওয়া ছাড়া বিএনপির দ্বিতীয় কোনো কৌশল কাজে আসবে না।
তাহলে আমরা কি পরাধীনতা মেনে নিয়ে নিজ মাতৃভূমিতে তৃতীয় অথবা চতুর্থ শ্রেণীর নাগরিকের জীবন যাপন করতে থাকব? অবশ্যই নয়। জনগণকে বোঝাতে হবে যে শৃঙ্খলমুক্তির উপায় একমাত্র তাদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মধ্যেই রয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে মহান ভাষা আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল। এই আন্দোলন কেবল ভাষার জন্যে ছিল মনে করলে আমরা ভুল করব। প্রকৃতপক্ষে আন্দোলন ছিল বিজাতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। কাজেই ভাষা আন্দোলনের এই মাসেই ব্রাহ্মণ্যবাদী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আমাদের নতুন করে সংগ্রামের শপথ নিতে হবে। প্রত্যেকটি বিরোধী রাজনৈতিক দলকে জনগণের কাছে ফিরে গিয়ে তাদের একতাবদ্ধ করার মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী শাসকশ্রেণীর পতন ঘটাতে হবে।
প্রয়োজনীয় জনমত গড়ে তুলতে মিডিয়ার গুরুত্ব অপরিসীম। দখলদার সরকারও সেটা ভালোই বোঝে। তাই সরকার এবং ভারতীয় দালালদের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকা মিডিয়াকে আরো নতজানু করতে তারা নিত্য-নতুন কালা-কানুন তৈরি করছে। চরম নিবর্তনমূলক ৫৭ ধারার পরিবর্তে নিয়ে এসেছে ভয়ংকর ডিজিটাল অ্যাক্ট। সেই আইনবলে পুলিশ অনুসন্ধানী সকল সাংবাদিককে গুপ্তচর আখ্যা দিয়ে কারাগারে ঢুকিয়ে দিতে পারবে। অর্থাৎ মূল ধারার গণমাধ্যমের কবর রচনা করেছে বাংলাদেশ সরকার। এই বৈরী পরিস্থিতিতে সামাজিক গণমাধ্যম ব্যবহার করেই স্বাধীনতা এবং বিপ্লবের বানী সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে হবে।
স্বাধীনতাকামী জনতার জন্যে সমগ্র বাংলাদেশ আজ এক বৃহৎ বন্দীশিবিরে পরিণত হয়েছে। আমিও সেই বন্দীশালার এক বন্দীমাত্র। এই বন্দীত্বের মধ্যেই জনগণকে জাগানোর লক্ষ্যে প্রাণপনে চিৎকার করে যাচ্ছি। আমার সেই ক্ষীণ কন্ঠের চিৎকার ব্যর্থ হলেও এই সান্তনাটুকু থাকবে যে আমি চেষ্টা করেছিলাম।
বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আপসহীনভাবে লড়াই করেছিলেন আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সমাজের অবিচার, রাষ্ট্রের জুলুম এবং জনগণের নীরবতায় আপাত: ক্ষুব্ধ কবি তার “আমার কৈফিয়ত” কবিতায় লিখেছিলেন,
রক্ত ঝরাতে পারি না ত একা,
তাই লিখে যাই এ রক্ত- লেখা।
বিদ্রোহী কবির এই দুটি লাইন বন্দী শিবিরের অবমাননাকর জীবনেও আমাকে লেখার অনুপ্রেরণা জোগায়।
লেখক : আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক