যুদ্ধের কবলে গাজা : সামনে একটি পথই খোলা

যুদ্ধের কবলে গাজা : সামনে একটি পথই খোলা

মুহাম্মদ ইউনূস ও হোসে রামোস-অরতা : আপনি ও আমি আমরা সকলেই মানুষ। আমাদের পরিবার আছে, সম্ভবত সন্তান এবং নাতি—নাতনীও আছে। বন্ধুবান্ধব আর প্রতিবেশীতো আছেই। আমরা ভিন্ন ভিন্ন জাতির, ভিন্ন ভিন্ন নৃগোষ্ঠীর। আমাদের বিশ্বাসও ভিন্ন। আমরা সকলেই চরম দারিদ্র্য ও যুদ্ধ দেখেছি, দেখেছি হত্যা ও মৃত্যু – প্রত্যক্ষভাবে অথবা সংবাদমাধ্যমে।

কিন্তু আমাদের অনুভূতি অভিন্ন। সহমর্মিতা আমাদের ব্যক্তিসত্ত্বার, আমাদের ডিএনএ—র অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানবসত্তার এই বৈশিষ্ট্যটি সম্পূর্ণ রুদ্ধ না—করে দিলে গাজায় বিগত সপ্তাহগুলোতে যা ঘটে গেল তা দেখে প্রবলভাবে ব্যথিত, ক্ষুব্ধ ও অসহায় বোধ না—করাটা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।

গাজার অধিবাসীদের উপর এই অসম যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া দেশটি হচ্ছে সেই দেশটি যা পৃথিবীর বুকে মানব—সৃষ্ট সবচেয়ে হৃদয়বিদারক দুযোর্গগুলির একটি – অর্থাৎ ইহুদি—নিধনযজ্ঞ এর পর প্রাচীন প্যালেস্টাইনের বুক কেটে সৃষ্টি করা হয়েছিল।

বোমার গন্ধ মিলিয়ে যাবার পর দু’পক্ষই যখন তাদের “বিজয় উদ্যাপনে” ব্যস্ত, এখন আমাদের সকলকেই এ প্রশ্ন করতে হচ্ছে – আমরা এখন কী করবো।

ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড, যার অধিকাংশই অনুর্বর, পৃথিবীর প্রাচীন তিনটি একেশ্বরবাদী ধর্মের পয়গম্বরদের জন্মস্থান।
কারো পক্ষে এমনটি ভাবাই স্বাভাবিক যে, এই তিনটি শক্তিশালী ধর্মের প্রজ্ঞার ফসল হিসেবে এই স্থানটি ঐক্যের স্বর্গভূমি হবার কথা। কিন্তু এটি পরিণত হয়েছে পৃথিবীর নরকে – অসংখ্য নিরাপরাধ মানুষের অশ্রু আর রক্তে সিক্ত ভূমিতে।

আর কোনো সংঘাত এত বেশি প্রাজ্ঞজনের চিন্তা, জ্ঞান ও ধ্যান খরচ করেনি। গত শতকে আর কোনো সংঘাত এত বেশি “শান্তি পরিকল্পনা” ও “রোড ম্যাপ” সৃষ্টি করেনি যাদের রচয়িতা ও পরিকল্পনাকারীরা কখনো কখনো অকালপক্কভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন, মিথ্যা আশাবাদ সৃষ্টি করেছেন যা ভঙ্গ হয়েছে হতাশা আর ক্ষোভে। ফিলিস্তিনিদের বিশ্বাস ভঙ্গ করেছে তাদের নিজেদেরই নেতারা, তাদের প্রতিবেশী অন্যান্য আরব দেশগুলোর শাসকরা, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

আমরা সম্প্রতি আরেক দফা ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করলাম যা চালিয়েছে ইসরায়েল; যা এমন একটি রাষ্ট্র যার কোনো বিবেকবোধ আছে বলে মনে হয়না, যে বিশ্বাস করে যে, এই এলাকায় তার ইশ্বর—প্রদত্ত অপ্রতিরোধ্য ক্ষমতা রয়েছে এবং এই এলাকায় পারমাণবিক সমরাস্ত্রে তারই একচ্ছত্র অধিকার আছে। হামাসের রকেটগুলি বিশ্বের চতুর্থ সামরিক শক্তি ইসরাইলের অপ্রতিদ্বন্দী বিমান ও পদাতিক বাহিনীর সামনে সহজেই ধূলিসাৎ হয়ে গেছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইসরায়েল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক সহায়তার প্রধান গ্রহীতায় পরিণত হয়েছে। ২০২০ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা ও মিসাইল প্রতিরক্ষা তহবিল হিসেবে ১৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (চলতি অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি—অসমন্বিত ডলারে) সরবরাহ করেছে। ২০২১ সালে ট্রাম্প প্রশাসন ইসরায়েলের জন্য অতিরিক্ত ৩.৩ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক সামরিক অর্থায়ন ও ৫০০ মিলিয়ন ডলার মিসাইল প্রতিরক্ষা সহায়তা চায়। ইসরায়েল মার্কিন বাজেটের দ্বিতীয় বৃহত্তম বৈদেশিক সহায়তা বরাদ্দ, আফগানিস্তানের পরেই যার স্থান, পেয়ে থাকে যার অন্তর্ভুক্ত অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র, উন্নততর মিসাইল প্রতিরোধী প্রযুক্তি এবং সর্বাধুনিক যুদ্ধ বিমান।

বাগাড়ম্বর ও মুষ্টি—আস্ফালন বাদ দিলে ইসরায়েলের অস্তিত্বের জন্য কার্যত কোনো বৈদেশিক হুমকি নেই। ইরানকে সম্ভাব্য শত্রু হিসেবে বিবেচনা করা যায়, কিন্তু ইসরায়েলের ২০০ পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রের মোকাবেলায় পরমাণু অস্ত্রহীন ইরান দুর্বল এক শক্তি। হামাস যে রকেটগুলো ছুঁড়েছে, যার প্রায় সবই ইসরায়েলের “আয়রন ডোম” ধ্বংস করেছে, ইসরায়েলের সমরশক্তির তুলনায় কোনো ট্যাংক—সজ্জিত সেনাবাহিনীর দিকে বালকের পাথর ছোড়ার নামান্তর। এরপরও ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রেখেছে যা তারা অর্ধ—শতাব্দী আগে আরব—ইসরায়েল যুদ্ধের পর থেকে চালিয়ে আসছে।

সাম্প্রতিক সংঘাতটি, যা শুরু হয়েছে সবচেয়ে পবিত্র মুসলিম স্থান আল—আকসা মসজিদে ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে। যার ফলে শত শত মানুষ আহত হয়, প্রকৃতপক্ষে একটি দীর্ঘ প্রচারণার সর্বশেষ চাল মাত্র। এই আগ্রাসনকে আরো বেশি অযৌক্তিক মনে হবে এ কারণে যে, গাজার জনসংখ্যার ৪৪ শতাংশেরই বয়স ১৪ বছরের নিচে, যে জনপরিংখ্যান নিধনযজ্ঞের শিকার কোনো জনগোষ্ঠীর মধ্যেই সচরাচর দেখা যায়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশীদার এবং এই সমস্যার সমাধানে তার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাইডেন প্রশাসনকে ট্রাম্প প্রশাসনের কিছু মারাত্মক ভুলের দায়ভার বহন করতে হচ্ছে যেগুলো নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে একটি পোড়ামাটি যুদ্ধের সবুজ সংকেত ও লাইসেন্স হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন। এই ভুল থেকে বেরিয়ে আসতে প্রয়োজন হবে সাহস, প্রজ্ঞা ও শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সমর্থনের।

এই সমস্যা সমাধানের পথটিকে শুরু হতে হবে সকল পক্ষকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য স্বীকৃত আন্তর্জাতিক মানদণ্ডগুলোকে মেনে নিয়ে। শক্তিশালী রাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট কোনো জোটেরই কোনো রাষ্ট্র বা পক্ষকে এই মানদণ্ডগুলো লংঘনের দায়বদ্ধতা থেকে সুরক্ষা দেয়াটা উচিত হবে না। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের আন্তর্জাতিক মানদণ্ডগুলো যা স্লবোদান মিলেসোভিচ বা ওমর আল—বশিরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়েছে তা বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য না হওয়াটা হবে অর্থহীন।

সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক কাউকে জোরপূর্বক বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ থেকে শুরু করে গাজায় ঘরের এককোণে লুকিয়ে কাঁপতে থাকা ১০ বছরের কোনো ইসরায়েলি বালিকার শয়নকক্ষে মিসাইল ছুড়ে মারার উন্মাদনার এই চলমান নাট্যশালার প্রতিটি সংঘাতই ১৯৬৭ সালের সীমান্তরেখার ভিত্তিতে একটি দ্বি—রাষ্ট্র সমাধানের যৌক্তিকতা ও আশু প্রয়োজনকে আবারো সমর্থন করছে। এছাড়া আর একমাত্র যে সমাধানটি রয়েছে তা হলো ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের নিয়ে একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র যেখানে ফিলিস্তিনিদের সংখ্যাগরিষ্টতার স্বীকৃতি থাকবে। এছাড়া আর কোনো বিকল্প সামনে খোলা নেই।

এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগে পরবর্তী পদক্ষেপগুলো হবে গাজায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর অবাধ প্রবেশ এবং অবকাঠামো ও মানুষের জীবনের যে নিরর্থক হানি ও ক্ষতি সাধিত হয়েছে তার পুনর্নির্মাণ ও ক্ষতিপূরণের জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নিশ্চিত করা। মানবতা এবং মানুষের প্রতি আমাদের সার্বজনীন সহমর্মিতা এটাই প্রত্যাশা করে।

(প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস, নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী ২০০৬, এবং হোসে রামোস—অরতা, নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী ১৯৯৬ ও প্রেসিডেন্ট, পূর্ব তিমুর ২০০৭—২০১২)

(নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ওয়াল স্ট্রিট ইন্টারন্যাশনাল ম্যাগাজিন—এ ৪ জুন ২০২১ তারিখে প্রকাশিত নিবন্ধের অনুবাদ)

Exit mobile version