সেক্যুলার সিস্টেমে ধর্ষণের বিচার হওয়া সহজ না

যে কারণে সেক্যুলার সিস্টেমে ধর্ষণের বিচার সহজ না

সেক্যুলার সিস্টেমে ধর্ষণের বিচার হওয়া সহজ না। কেননা ধর্ষণ জিনিসটা ইটসেলফ সেক্যুলার সিস্টেমে খুব সিরিয়াস কোনোকিছু না। অন্য পাঁচ দশটা ক্রিমিনাল অফেন্সের মতো এটাও একটা। এর পেছনে অনেক কারণ আছে। আমি তিনটা কারণ বলছি।

১. সতীত্ব
যে সমাজে নারীর সতীত্ব যত মূল্যবান, সে সমাজে ধর্ষণ তত সিরিয়াস বিষয়। যে সমাজে নারীদেহকে, নারীর সতীত্বকে পুরুষ সহজে পায় না, তাকে যথাযথ সম্মানের সাথে পেতে হয়, সেখানে নারীর সতীত্ব জোরপূর্বক নষ্ট করাও তত বেশি সিরিয়াস ক্রাইম।
কিন্তু সেক্যুলার সিস্টেম নারীর সতীত্বকে বানিয়েছে খেলনার বস্তু। এমনকি বড় বড় মুভি-সিরিজে ভার্জিনিটি দেওয়াকে “বের করে খেলার” সাথে তুলনা করা হয়। অর্থাৎ এখানে নারী যার সাথে ইচ্ছা শুতে পারবে, যার সাথে ইচ্ছা যৌনসম্পর্ক করতে পারবে। এটা তার স্বাধীনতা ও অধিকার।
এবার চিন্তা করুন, যে সমাজে নারীর সতীত্ব শুধু ইচ্ছা অনিচ্ছার ব্যাপার, অনেকটা কেউ ভাত খেতে চাচ্ছে না, জোর করে খাইয়ে দেওয়া হচ্ছে, এমন বিষয়, যেখানে নারীর যার সাথে ইচ্ছা তার সাথে শোয়, সেখানে নারীর অনিচ্ছায় এক দুইবার যৌন সঙ্গম করে ফেলাটাকে কি অতো সিরিয়াস হিসেবে দেখা হবে? এর জন্য মৃত্যুদন্ড দিয়ে ফেলা হবে?
এমনকি বিখ্যাত নারীবাদি লেখিকা জার্মেইন গ্রিয়ার (Germaine Greer) শরীরের কোনো পার্মানেন্ট ড্যামেইজ হয় নি, এমন জোরপূর্বক সেক্সকে রেইপ বলতে নারাজ। তিনি একে বলেছেন “ব্যাড সেক্স”।

২. সম্মতি (Consent)
সেক্যুলারিজমে ধর্ষণের সংজ্ঞা হলো, কনসেন্ট বা সম্মতি ছাড়া জোরপূর্বক যৌনসঙ্গম করা। অর্থাৎ যদি কনসেন্ট থাকে, তাহলে বিবাহিত নারী রাস্তার লোকের সাথে করলেও সমস্যা নেই। আবার কনসেন্ট না থাকলে স্বামী জোর করে করলেও ধর্ষণ। এটাই হলো মূল নৈতিক ভিত্তি।
ঝামেলার ব্যাপার হলো, কনসেন্ট জিনিসটা এখন অনেক হাস্যকর হয়ে গেছে। যেমন ধরুন, যৌন সঙ্গমের সময়ই মেয়ে চাইলে কনসেন্ট তুলে নিতে পারে। পুরুষ তৃপ্ত হোক বা না হোক, সেখানেই বন্ধ না করলে এটা ধর্ষণ হয়ে যেতে পারে। আবার মেয়ে স্বেচ্ছায় ধরুন কোনো জনপ্রিয় ছেলের সাথে যৌনসঙ্গম করলো। কয়েক মাস পর তার মনে হলো ছেলে জনপ্রিয় না হলে সে আসলে করতো না। সে ম্যানুপুলেটেড হয়েছে। ধর্ষণের মামলা সে ঠুকে দিতে পারবে ঐ ছেলের বিরুদ্ধে।
শুনে হাসি আসতে পারে। তবে বিবাহের প্রলোভনে ধর্ষণের মামলাগুলো অনেকটা এমনই। যদি কনসেন্ট এতো ঠুনকো একটা বিষয়ই হয়ে যায়, তাহলে শুধুমাত্র কনসেন্ট না থাকার কারণে কাউকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে দেওয়া কি আদৌ সম্ভব হবে? কোনো সমাজ কি সেটা মেনে নেবে?
তসলিমা নাসরিনকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছে, “আপনি কি ফ্রি সেক্স চান?” তসলিমা নাসরিন জবাব দেয়, “না। আমি ফ্রিডম অফ সেক্স চাই।” অর্থাৎ নারী কনসেন্টের ভিত্তিতে যার সাথে ইচ্ছা শুতে পারবে। এমনকি পর্ণগ্রাফি বানানো, পর্ণ দেখা- এগুলো সবই স্বাধীনতা ও অধিকারের অংশ হয়ে যাবে। কেননা এগুলো সম্মতির ভিত্তিতেই হচ্ছে। কেউ কারো ক্ষতি করছে না।

৩. গ্বাইরাত (Protective Jealousy)
সাধারণত সমাজে নারীর সম্মান রক্ষা করা, ধর্ষণের শাস্তি দেওয়া- এ কাজগুলো করে পুরুষরা। তাই নারীর সতীত্ব ও সম্ভ্রমের প্রতি পুরুষ একটা নির্দিষ্ট ধরণের সম্মান থাকতে হয়। কিন্তু ভেবে দেখুন, ধরুন আমার স্ত্রী সাজগোজ করে চুল ছেড়ে বাইরে যায়। আমার বন্ধুদের সাথে খুব হেসে হেসে কথা বলে। আমার বন্ধুরা ভাবির সাথে নানা মশকরা করে।
এমন অবস্থায় আমার কী হবে? আমি আমার স্ত্রীর দিকে পুরুষরা লোলুপ দৃষ্টিতে তাকাবে, একটু আধটু ক্রাশ খাবে, পেছনে বাঁকা মন্তব্য করবে- এগুলোতে আমি অভ্যস্ত হয়ে যাবো। স্বাভাবিকভাবে নেবো। কারণ আমি “উদার” স্বামী। সেক্ষেত্রে আমার পুরুষত্বের অবস্থা কী হবে? “আমার স্ত্রীর দিকে চোখ তুলে তাকালে সে চোখ তুলে ফেলবো”- এমন গ্বাইরাত কি আমার থাকবে?
কিংবা ভেবে দেখুন, আমাদের মা কিংবা বোন বা ফুফু বা খালা- তাদের কেউ যদি স্লিভলেস, টাইট, ক্লিভেজ দেখানো জামা পরে আমাদের সামনে আসে, নানা সেক্সুয়ালি প্রভোকেটিভ আচরণ করে, সেক্ষেত্রে তাদেরকে কি তাদের পর্যায়ে সম্মান করা, তাদের সম্মানের প্রতি সিরিয়াস হওয়া সম্ভব হবে?
সেক্যুলারিজম স্বাধীনতা ও অধিকারের নামে পর্দাহীনতা ও অবাধ যৌনাচারের প্রসার ঘটায়। এভাবে করে নারীকে শুধু যৌনপণ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলে। এভাবে পুরুষের গ্বাইরাত কেড়ে নেয়। ফলে নারী অসম্মানের মুখোমুখি হলেও পুরুষ আর তার পক্ষে দাঁড়ায় না।

এবার আসুন দেখি, ঠিক এ জায়গাগুলোর কারণেই ইসলাম কেন ধর্ষণের ব্যাপারে কঠোর হবে।
১. সতীত্ব
ইসলামে নারীর সতীত্ব খুব সিরিয়াস একটা বিষয়। নারী যেমন চাইলেই কারো সাথে শুয়ে যেতে পারবে না, আপনিও চাইলে পটিয়ে নারীকে বিছানায় আনতে পারবেন না। আপনি যদি কোনো নারীকে পেতে চান, তাহলে মোহরানা শোধ করে, তার পুরো জীবনের ভরণ-পোষণ ও সম্মানের দায়িত্ব নিয়ে পেতে হবে।
এর বাইরে যদি কিছু হয়, অর্থাৎ বিয়ের আগে যিনায় শাস্তি বেত্রাঘাত, বিয়ের পরে যিনায় শাস্তি পাথর মেরে হত্যা, ত্রাস সৃষ্টিকারী ধর্ষণের শাস্তি আরো অনেক সিভিয়ার বিষয়াশয় (যেমন পাব্লিক এক্সিকিউশন করে লাশ ঝুলায় রাখা, এক হাত আর এক পা কেটে ফেলা, বা নির্বাসন ইত্যাদি)
২. সম্মতি
ইসলামে সম্মতি খেলার বিষয় না। চাইলে সম্মতি দিলাম, মিনিটে মিনিটে চেইঞ্জ করলাম- এমন খেলো ইসলাম বানিয়ে দেয় না। সম্মতি দিতে পারবেন, তবে সেটার ভার বুঝে দেবেন। বিয়েটা হলো সম্মতি। বিয়েতে জেনেবুঝে সম্মতি দেবেন, তারপর একেবারে না পারলে ডিভোর্স। শেষ।
আবার ডিভোর্সও খুব ইজিলি দিয়ে দিলেন এমন না। নারী ডিভোর্স দিলে মোহরানা ব্যাক করে দেবে, স্বামী ডিভোর্স দিলে সে পুরো মোহরানা শোধ করে দেবে (এমাউন্ট যাই হোক)। ডিভোর্স হয়ে গেলে স্ত্রী কয়েক মাস বিয়ে করতে পারে না (ইদ্দত)। আবার স্বামী চাইলেই স্ত্রীকে ব্যাক নিতে পারবে না।
সম্মতি দিলে স্বামী যদি কিছুটা জোর করে, সেটা ক্রাইম হবে না। (তবে এটা প্রেফারেবল না। নির্যাতন করলে কিংবা জখম করলে ক্রাইম হবে) আবার নারীদের সাইকোলজি হলো তারা যার সাথে (বিয়ের মত) কমিটেড রিলেশনশিপে আছে, তার সাথে যে যৌন সঙ্গম বেশি উপভোগ করে। রিসার্চ আছে। কারণ নারীদের কাছে অবজেক্ট না, ফেইস গুরুত্বপূর্ণ।
যেখানে কনসেন্টের ভার অনেক বেশি, সাথে অনেক বেশি কনসিকুয়েন্স বহন করে, সেখানে বিয়ের বাইরে অন্য কোনো পুরুষ নারীর ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় এমনটা করা সমাজ অনেক সিরিয়াসভাবে দেখবে। ইচ্ছায় হলে রাগবে উভয়ের উপরেই, আবার অনিচ্ছায় হলে পুরুষের অবস্থা বারটা বাজিয়ে দেবে।
৩. গ্বাইরাত
উল্টো চিত্র ভেবে দেখুন। ধরুন, আমার স্ত্রী নিকাব পরা সম্মানিত মহিলা। তিনি মাহরামদের বাইরে কাউকে দেখা দেন না। গ্বাইরে মাহরাম কারো সাথে হাসিঠাট্টা করে না। আমার স্ত্রীর চেহারার দিকে লোলুপ দৃষ্টি দেওয়ার, তাকে নিয়ে অশ্লীল আড্ডা দেওয়ার সুযোগ কারো নেই।
এমন ক্ষেত্রে, আমার স্ত্রীর প্রতি আমার প্রোটেক্টিভনেস নিশ্চয় অনেক বেশি হবে। আমার পুরুষত্বের বারটা বাজিয়ে আমার স্ত্রীর পুরুষের সাথে কোনো আচরণ আমার হজম করতে হচ্ছে না। সেক্ষেত্রে আমার স্ত্রীর চোখের দিকেও কেউ লোলুপ দৃষ্টি দিলেও আমার তার চোখ তুলে ফেলতে ইচ্ছে হবে না?
ইসলামে গ্বাইরাতকে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সাদ বিন উবাদাহ যখন তার স্ত্রীকে অন্য পুরুষের সাথে দেখলে তলোয়ার দিয়ে আঘাত করবেন বলেছেন, তখন রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, “আমার গ্বাইরাত সাদের চেয়ে বেশি। আমার চেয়েও আল্লাহর গ্বাইরাত বেশি।”
নারী যদি সম্মান বজায় রাখে, যৌনপণ্য হিসেবে প্রদর্শিত না হয়, পর্ণ, আইটেম সং, অনলাইন বা অফলাইনে নারীর যথেচ্ছা প্রদর্শনী না হয়, তাহলে নারীকে মা, বোন, খালা, ফুফু, শিক্ষিকা, দাদী, নানী হিসেবে নারীর যে মর্যাদা তা তাকে দেবে পুরুষ সমাজ। কারণ শরীরের অতিপ্রদর্শন ও যৌনায়নে নারী সবকিছু ছাড়িয়ে একটা যৌনপণ্য হয়ে উঠবে না তার কাছে।

আরো অনেক এঙ্গেল থেকে এসব আলোচনা করা যায়। যেদিক থেকেই দেখুন না কেন, সেক্যুলারিজম নারীর মর্যাদা রক্ষায় ব্যর্থ। এদিকে ইসলামই পারে নারীর সম্মান রক্ষা করতে। এটা শুধু ইউটোপিক বয়ান না। প্রমাণ করতে আমাদের সামনে বারশ বছরের ইতিহাস আছে। আবার পশ্চিম দিকেও এখন উদাহরণ আছে। ইনশাআল্লাহ এ বাংলায়ও আমরা আল্লাহর আইন দিয়েই নারীর মর্যাদা রক্ষা করবো।

 

Leave a Comment Cancel Reply

Exit mobile version