মাহবুব মিঠু
বিভিন্ন পত্রিকা ঠারে ঠুরে বলা শুরু করেছে যে, বিএনপি থেকে নাকি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নেবার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। বিএনপির কোন কোন নেতাও একই সুরে কথা বলছেন। জেল থেকে পিন্টু নাকি মনোনয়ন পত্র জমা দেবার ইচ্ছাও প্রকাশ করেছে। বিএনপি কি তাহলে আন্দোলন করে ক্লান্ত হয়ে আত্নহত্যার স্বিদ্ধান্ত নিলো? সিটি মেয়র প্রত্যাশী কিছু পদলোভী নেতারা দলকে ভুল বুঝিযে এই কর্মটি করাতে পারলে আওয়ামিলীগের আর চিন্তা নেই! আন্দোলন এমনিতেই হিমাগারে যাবে। দল কি একবারও ভাবছে না যে, যারা নির্বাচন করার জন্য উদগ্রীব তারা আন্দোলনে রাজপথে নেই কেন? মাঠ পর্যায়ে যারা আন্দোলন করে স্বর্বস্বান্ত, তাদেরকে টাকা দিয়ে কয়জন নেতা সহায়তা করেছেন? এতোগুলো মানুষ যে আন্দোলনের কারণে খুন হলো তার দায়ভার নেবে কে? চোখ বন্ধ করে দলের একবার ভাবা দরকার আব্বাস, মিন্টুসহ যাদের নাম বিএনপির পদপ্রার্থী হিসেবে আসছে, তারা আন্দোলন ফেলে কি করছেন? আন্দোলনে না থেকে কোথায় আছেন তারা?
অনেকে বলছেন, বিএনপি থেকে সরাসরি কাউকে প্রার্থী না দিয়ে নাগরিক সমাজের কাউকে সমর্থন দেবে। তাতে লাভ কি? কিম্বা নিজেরা অংশ না নিয়ে নাগরিক সমাজের কাউকে সমর্থণ দেবার মধ্যে নির্বাচন প্রশ্নে দলের অবস্থানে নীতিগতভাবে পার্থক্য কোথায়? নাগরিক সমাজের নামে কাউকে সমর্থন দিলে যে কোন ফায়দা হয় না সেটা কি চট্টগ্রামের মেয়রের অবস্থা দেখে বুঝতে এখনো বাকী আাছে? উনি এখন না আওয়ামিলীগ, না বিএনপি। উনি যদিও বিএনপির প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়েছিলেন। তারপরেও তার এই অবস্থা। নাগরিক সমাজের কেউ জিতে আসলে দল হিসেবে বিএনপির কি ফায়দা হবে?
সরকারের পক্ষ থেকে আন্দোলন দমনে নানা রকমভাবে চেষ্টা হচ্ছে। সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সেই প্রচেষ্টারই অংশ। আন্দোলনের শুরুতে রাজপথের সাহসী নেতা ইলিয়াস আলীকে অপহরণ এবং গুম করে বিএনপির নেতাকর্মীদের মনে ভয় ধরিয়ে দিতে পেরেছিল। সেই সাথে চলছিল দেদারসে বিরোধীজোটের কর্মীদের ধরে ধরে ঠান্ডা মাথায় ক্রসফায়ারে হত্যা। এখনো সেটা অব্যাহত আছে। বিরোধীজোটের আন্দোলনকে দমাতে সরকার এবার সালাহউদ্দিনকে ধরে নিয়ে গেছে। এখনো সে ইলিয়াস আলীর মতো গায়েব আছেন। সেই সাথে সরকার ঢাকা এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন দিয়ে নির্বাচনমুখী আমেজ সৃষ্টি করে আন্দোলনকে ডাইভার্ট করার চেষ্টা চালাচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, এই নির্বাচনে যাওয়া বিএনপির জন্য একটা বড় পরাজয় হবে। বিএনপি নির্বাচনে গেলে যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে;
এক, সরকার আন্দোলনের বেকায়দা অবস্থা থেকে কিছুটা স্বস্তিদায়ক পরিবেশ ফিরে আসবে।
দুই, মাঝপথে দল নির্বাচনমুখী হলে আন্দোলন দুর্বল হবে এবং গতি কমে যাবে। সেই ফাকে নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যাবে।
তিন, এতোদিন চলা আন্দোলন নৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে।
চার, সরকার প্রচারণা চালাবে বিএনপি আন্দোলন চালাতে না পেরে নির্বাচনের মাধ্যমে একটা সম্মানজনক এক্সিট খুঁজছে। পরবর্তীতে বিভ্রান্ত কর্মীদের আবারো আন্দোলনে ফিরিয়ে আনা অনেকটা অসাধ্য হয়ে পড়বে।
পাঁচ, নির্বাচন উপলক্ষ্যে কর্মীরা লুকানো অবস্থান থেকে বের হয়ে আসলে তাদের গ্রেফতার হবার সম্ভাবনা অন্ততঃ ১০০ ভাগ। এখনো অনেক ডেডিকেটেড কর্মী লুকিয়ে থেকে আন্দোলন চালিয়ে যেতে অগ্রনী ভূমিকা পালন করছেন। নির্বাচন উপলক্ষ্যে কর্মীরা গণসংযোগ করতে বাইরে আসলে বেছে বেছে কয়েকজনকে হত্যা করে বাকীদের মনে ভয় ধরিয়ে দেবে, যাতে নির্বাচনের পরে কেউ আন্দোলনের কথা মাথায়ও না আনে।
ছয়, নির্বাচনে জিতলেও সরকারের বিজয়, হারলেও সরকারের বিজয়। তারা বলবে যে, তাদের অধীনে যে কোন নির্বাচনই সুষ্ঠু হোত। এভাবে বর্তমান আন্দোলন নৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে।
সাত, এই আন্দোলন এসএসসি পরীক্ষার সময়েও চলেছে। নির্বাচনের জন্য আন্দোলন থেকে সরে আসলে সরকার এই ইস্যু ব্যবহার করে জনমত গঠন করবে। তারা বলবে, লাখ লাখ পরীক্ষার্থীর পরীক্ষার সময়ে আন্দোলন চালিয়ে নিলেও ভোটের সময়তো ঠিকই আন্দোলন স্থগিত রাখলো। অতএব, বিএনপির কাছে দেশ এবং জনগণের চেয়ে দলের স্বার্থ বড়।
মনে রাখতে হবে, পুলিশ কমিশনারের প্রেসক্রিপশন মোতাবেক সরকার নির্বাচনের তারিখ ঠিক করেছে। পুলিশ হয়তো তার গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে বুঝতে পেরেছে, আন্দোলন আরেকটু দীর্ঘায়িত হলে তাদের কন্ট্রোলের বাইরে চলে যাবে। তাই পুলিশের পরামর্শে নিশ্চিত পরাজয় জেনেও সরকার নির্বাচনের তোড়জোড় করছে। বিএনপির মতো সরকারও জানে, এই মুহুর্তে যে কোন নির্বাচনে যাওয়ার মানেই হচ্ছে, সরকারের বিপুল পরাজয়। তারপরেও সরকারের এই ঝুঁকি নেবার নেপথ্য কারণ যদি বিএনপি বুঝতে না পারে, তাহলে আন্দোলন রেখে তাদের ঘরে বসে থাকাই ভাল। এতে অন্ততঃ কিছু কর্মী সরকারী বাহিনীর হাতে খুন হওয়া থেকে রেহাই পেলেও পেতে পারে।
অনেকেই ভাবছেন, তাইলে ঢাকার সিটি মেয়র দু’টো এমনিতে আওয়ামিলীগকে দিয়ে দিলে ভবিষ্যতে বিএনপি ক্ষমতায় আসলে তারা সরকার বিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা রাখবে। প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপি কি পেরেছিল? উল্টো খোকাকে অকার্যকর করে দেয়া হয়েছিল। বিএনপি যদি ভবিশ্যতে ক্ষমতায় আসে তাহলে এদের নিশ্চয় বরখাস্ত করার কোন পথ খুঁজে পাওয়া যাবে। বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশনের বিএনপিপন্থী মেয়রদের সরকার বরখাস্তের চিন্তা করছে যেভাবে ঠিক একইভাবে বিএনপিও করতে পারবে। বেশী বাড়াবাড়ি করলে আওয়ামিলীগের দেখানো পথে বিএনপি হাঁটলে আন্দোলনে কেন, পার্টি অফিসে এমনকি সিটি কর্পোরেশন অফিসেও মেয়রদের টিকিটিও পাওয়া যাবে না। বাড়তি কিছু করার দরকার পড়বে না, কেবল আওয়ামিলীগের দেখানো পথে হাঁটলেই চলবে।
বিএনপি যদি নির্বাচন থেকে সরে আসে তাহলে আরেকটা কাজ তাকে অবশ্যই পারতে হবে। যে কোন মূল্যে নির্বাচন প্রতিহত করা। তাতে যদি ভোটার বিহীন নির্বাচনে ২০১৩ সালের জাতীয় নির্বাচনের মতো কুকুরের ভোটে কেউ নির্বাচিত হয় তাতে ক্ষতি কি?
লেখক : জনপ্রিয় ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্ট