আসন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ঢাকা দক্ষিণ থেকে মেয়র পদে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম মাওলা রনি। আজ সোমবার গোলাম মাওলা রনি তার ফেসবুক পেজে এক স্ট্যাটাস দিয়েছেন। স্ট্যাটাসে লিখেছেন, আসন্ন সিটি নির্বাচনে বেগম জিয়া তার দলকে অংশগ্রহণ করার জন্য নির্দেশ দেবেন, নাকি সরকারি চালচালাকিকে আরো অধিকতর কূটচাল দিয়ে প্রতিহত করে দেবেন- এমনতরো আলোচনা এখনো সর্বত্র।
প্রিয়.কমের পাঠকদের জন্য তার দেয়া ফেসবুক স্ট্যাটাসটি হুবুহু তুলে ধরা হলো-
***
আসন্ন সিটি নির্বাচনে বেগম জিয়া তার দলকে অংশগ্রহণ করার জন্য নির্দেশ দেবেন, নাকি সরকারি চালচালাকিকে আরো অধিকতর কূটচাল দিয়ে প্রতিহত করে দেবেন- এমনতরো আলোচনা এখনো সর্বত্র। একদল বলছে- বিএনপির উচিত সদলবলে ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা। এতে করে দলটি হয়তো সমূহ বিপদ-বিপত্তি থেকে রক্ষা পাবে। বর্তমান অবস্থা থেকে বের হওয়ার একটি উপায় খুঁজে পাবে এবং শেষমেশ বিজয় লাভ করে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারবে। অন্য দল বলছে- সর্বনাশ! ভুলেও সরকারি ফাঁদে পা দেয়া যাবে না। নির্বাচনে অংশ নিলে বিএনপির অস্তিত্ব নিয়েই সঙ্কট দেখা দেবে, জয়-পরাজয় তো অনেক পরের বিষয়।
সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বেগম জিয়াকে খুব ধীরস্থিরভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। তিনি খুব ভালো করেই জানেন- সরকার তাকে এবং তার পরিবার ও দলকে নিয়ে খেলছে। এই খেলা কখনো তার জন্য অপমানকর, কখনো বা অস্বস্তিকর আবার কখনো কখনো নির্মম ও হৃদয়বিদারক হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সাথে সামান্যতম সৌজন্য বা সংযোগ থাকার যে চিরায়ত রীতি অনাদিকাল থেকে তাবৎ দুনিয়ায় চলে আসছিল, তা কিন্তু ২০১৫ সালে বাংলাদেশে এসে শূন্যের কোঠায় ঠেকেছে। কাজেই কোনো রকম কথাবার্তা কিংবা বিশ্বাস-আশ্বাসের সামান্যতম ভিত্তিমূল সৃষ্টি না করে বেগম জিয়া তার নির্মম ও নিষ্ঠুর প্রতিপক্ষের সাথে নির্বাচনী যুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন কি না তিনিই ভালো জানেন।
বেগম জিয়া প্রথমেই আমলে নিচ্ছেন নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিলের বিষয়টি। মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময় হলো ২৯ মার্চ। প্রত্যাহারের শেষ সময় ৯ এপ্রিল। প্রতীক বরাদ্দ দিতে আরো দুই-তিন দিন। এরপর সেই প্রতীকসহ প্রার্থীদের পোস্টার ছাপানো এবং লাগানোতে আরো চার-পাঁচ দিন। অর্থাৎ ১৫ এপ্রিলের আগে প্রার্থীরা মাঠে নামতে পারবেন না এবং ১০-১২ দিনের বেশি প্রচার-প্রপাগান্ডায় অংশ নেয়া অসম্ভব। তিনটি সিটি করপোরেশনের প্রতেকটিতে গড়ে ১১০০ ভোটকেন্দ্র রয়েছে। এই অল্প সময়ের মধ্যে প্রতিটি কেন্দ্র কমিটি গঠন, প্রতি ওয়ার্ডে একটি করে জনসভা এবং নির্বাচনী এলাকার শতকরা দুই-তিন ভাগ মানুষের কাছে পৌঁছা সহজ নয়। ফলে পুরো নির্বাচনটি পরিণত হবে একধরনের ভেলকিবাজিতে, আর সেই বাজিতে জিততে হলে অবশ্যই জাদুটোনা জানতে হবে- এমন মূল্যায়ন অমূলক নয়।
বেগম জিয়া তার আশপাশের সরকার সমর্থক লোকেদের নানামুখী চালে পড়ে প্রথমেই বলবেন, আমাকে একটা জাদুর বাক্স এনে দাও। তারপর বলবেন, আমাকে হিসাব মিলিয়ে দাও- দলের কয়জন চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌরমেয়র ও ওয়ার্ড কাউন্সিলর রয়েছেন? তাদের মধ্যে ক’জন জেলে আছেন? ক’জন আন্দোলন-সংগ্রাম করছেন, ক’জন সরকারের সাথে মিলেমিশে কাজকর্ম করছেন এবং কারণে অকারণে আমার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করছেন, তাদের রুটি হালুয়াতে আন্দোলনের ঝোল ঢেলে দেয়ার জন্য। তিনি হয়তো দলীয় জাদুকরদের আরো জিজ্ঞাসা করবেন, এখন কি স্থানীয় সরকারের জনপ্রতিনিধিদের কোনো ক্ষমতা-সম্মান বলতে কিছু অবশিষ্ট আছে! একটি চাঁদাবাজি, ছিনতাই বা ডাকাতির মামলায় চেয়ারম্যান ও মেয়রদের গ্রেফতার দেখিয়ে জেলে পাঠানোর দু-তিন দিনের মধ্যেই মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশ চলে আসে প্যানেল চেয়ারম্যান বা প্যানেল মেয়র নিয়োগের জন্য। আর অমনি স্থানীয় প্রশাসন তড়িঘড়ি করে সরকারদলীয় লোকেদের প্যানেল চেয়ারম্যান বা প্যানেল মেয়র নিয়োগ দিয়ে নিজেদের ফরজ দায়িত্বটি পালন করে স্বর্গে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়ে।
বিএনপির এখন বলতে গেলে কাউকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। কারো পরামর্শের প্রতি তাদের আস্থা রাখাও কঠিন হয়ে পড়েছে। আর এ কারণেই তারা যুক্তিতর্ক ও বাস্তবতার নিরিখে সব কিছু বিবেচনায় আনবে, এটাই স্বাভাবিক। বিএনপি যদি নির্বাচনে অংশ নেয় তাহলে প্রথমেই তাকে তিনজন মেয়র প্রার্থী এবং প্রায় দেড় শ’ কাউন্সিলর প্রার্থীকে মনোয়ন দিতে হবে, যা বর্তমান বাস্তবতায় একটু কঠিনই বটে। দলের সম্ভাব্য প্রার্থীদের প্রায় সবাই হয় আত্মগোপনে, নয়তো জেলে। একটি সীমাহীন মানবিক ও সামাজিক বিপর্যয়ে বিধ্বস্ত দলটির নেতাকর্মীরা কোন মন্ত্রবলে বা জাদুবলে উজ্জীবিত হয়ে হঠাৎ করেই নির্বাচনী যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বেন। তিনটি সিটি করপোরেশন এলাকার থানাগুলোতে বিএনপির বিরুদ্ধে মোট কতটি মামলা দায়ের করা আছে, তা যেমন দলটি জানে না; তেমনি জানে না ওইসব মামলায় গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিদের সংখ্যা, এজাহারভুক্ত আসামিদের সংখ্যা এবং সম্ভাব্য সন্দেহভাজন আসামিদের সংখ্যা সম্পর্কে। ফলে পুলিশ দেখলেই বিএনপির সাধারণ নেতাকর্মীরা গ্রেফতার আতঙ্কে অস্থির হয়ে যাবেন না, এ নিশ্চয়তা কে দেবে? এই অস্থিরতা নিয়ে আর যা-ই হোক অন্তত স্বস্তির নির্বাচন হয় না।
বেগম জিয়ার সাম্প্রতিক প্রেস কনফারেন্সে সরকার, বিশেষত সরকারপ্রধান সম্পর্কে একটি পর্যবেক্ষণ সবার নজরে এসেছে। বিএনপি বর্তমান সঙ্কটের জন্য একরতফাভাবে আওয়ামী লীগকে দায়ী করে। আরো স্পষ্ট করে বললে শেখ হাসিনাকে দায়ী করে। তাদের মতে, আওয়ামী লীগকে বিশ্বাস করে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে অংশগ্রহণ যেমন ভুল সিদ্ধান্ত ছিল, তেমনি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনী খেলার পর রণেভঙ্গ দিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম থামিয়ে সরকারকে সুযোগ দেয়াটা রীতিমতো অন্যায় হয়েছে। এ অবস্থায় কোনো আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতা ছাড়া বিএনপি যে সরকারের সাথে সমঝোতায় আসবে না, তা প্রায় নিশ্চিত। বেগম জিয়ার কথাবার্তায় আরো যেসব বিষয় ফুটে উঠেছে তা নিয়েও বিশ্লেষকেরা নানামুখী আলোচনার ঝড় তুলেছেন টেলিভিশন টকশো, পেপার-পত্রিকা ও সামাজিক মাধ্যমগুলোতে। বিশ্লেষকদের মতে, বিএনপি একটি দীর্ঘমেয়াদি আন্দোলনের জন্য সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। একটি আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়লে অন্য আন্দোলন দিয়ে তা পূরণ করা হবে। কোনো অবস্থাতেই আন্দোলন থেকে দলটি পিছু হটবে না। বর্তমান অবস্থায় তাদের হারানোর তেমন কিছু নেই। সরকার অবশ্য বেগম জিয়াকে গ্রেফতারের হুমকি দিচ্ছে। অন্য দিকে, বেগম জিয়া কায়মনো বাক্যে চাচ্ছেন সরকার তাকে গ্রেফতার করুক। ফলে সরকারি তরফ থেকে বেগম জিয়ার গ্রেফতার নিয়ে শুরু হয়েছে নানা টালবাহানা। সরকার দৃঢ়ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না কিংবা গ্রেফতারের পক্ষ-বিপক্ষের লাভক্ষতির যোগ-বিয়োগ মেলাতে পারছে না।
বিএনপির সামনে এখনো কতগুলো অনিশ্চয়তা রয়েছে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত প্রায় সব প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সারির নেতা হয় জেলে, নয়তো আত্মগোপনে থেকে দিন কাটাচ্ছেন। তাদের প্রায় সব রাজনৈতিক অফিসে তালা ঝুলছে। লাখ লাখ নেতাকর্মীর ব্যবসা-বাণিজ্য, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দুটো কথা বলা, কাউকে আশ্বাস দেয়া কিংবা সৃজনশীল কোনো চিন্তা করার মতো অবস্থা তাদের নেই। এই অবস্থায় সিটি নির্বাচনে তারা কেমন ফলাফল করবে সেই ভাবনা মাথায় নিতে হচ্ছে।
তিনটি প্রধান লক্ষ্য নিয়ে সরকার তড়িঘড়ি করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। প্রথমত, অতি অল্প সময়ের মধ্যে বিএনপি হয়তো নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত বা প্রস্তুতি নিতে পারবে না। ফলে ৫ জানুয়ারির মতো একটি একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে দলীয় নেতাকর্মীদের মেয়র ও কাউন্সিলর পদে বসিয়ে দেয়া যাবে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে যেহেতু এ যাবৎকালে দেশী-বিদেশী কোনো চক্রই সরকারের অবস্থান পরিবর্তন করাতে পারেনি, সেহেত্ ুওই মডেলের নির্বাচনের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে অভ্যস্ত করানোর বিষয়ে একটি সুযোগ সৃষ্টি হবে। এতে করে সরকারের প্রতিপক্ষরা যেমন একতরফা নির্বাচনের বিষয়ে ভবিষ্যতে উচ্চবাচ্য করার নৈতিক শক্তি হারিয়ে ফেলবে, তেমনি ২০১৯ সালের সংসদ নির্বাচন অধিকতর একতরফাভাবে অনুষ্ঠান করানোর পথটি পরিষ্কার হয়ে যাবে।
দ্বিতীয়ত, এই নির্বাচনে যদি বিএনপি অংশগ্রহণ করে তবে সরকার তাদের সাথে চমৎকার শিল্পীসুলভ রঙ্গরসে র্যাট-ক্যাট, অর্থাৎ ইঁদুর-বিলাই খেলার মহড়া দিতে পারবে। নির্বাচন উপলক্ষে দলটির গা-ঢাকা দেয়া নেতাকর্মীরা যদি বের হয়ে আসেন তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোনো ঝক্কি ঝামেলা ছাড়াই তাদের গ্রেফতার করতে পারবে। নির্বাচনী ডামাডোলের মধ্যে ওসব গ্রেফতারের খবর কেউ জানবে না বা জানতেও চাইবে না। দিন শেষে-রাত শেষে বিএনপি দেখবে- পুরো মাঠ ফাঁকা! কেউ কোথাও নেই- আছে শুধু বাকের ভাই একা! নির্ভীকচিত্তে ফাঁসির মঞ্চে ঝুলে পড়ার জন্য ভাই তখন হাহাকার করতে থাকবেন। হয়তো এভাবে চলে আসবে নির্বাচনের দিন। ভোট গণনার পর দেখা যাবে- বিএনপি কাক্সিক্ষত ফল পায়নি। সরকার উল্লাসনৃত্য করতে করতে বলবে- এসব কিছুই হয়েছে পেট্রল দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারার কারণে। বিএনপি একটি গণধিকৃত দল।
তৃতীয়ত, বিএনপি যদি কোনো কারণে জিতে যায় তাহলেও সমস্যা নেই। বরং বিএনপি জিতলে সরকারের বহুমুখী লাভ। তারা দর্প করে বলতে পারবে, তাদের অধীনে সব সময়ই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়। অতীতে হয়েছে, এখন হলো এবং ভবিষ্যতেও হবে। বিএনপি যেসব নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে সেসব নির্বাচনে তারা জয়লাভ করেছে। আর যেখানে বুঝতে পেরেছে যে পরাজয়ের সম্ভাবনা শত ভাগ, সেখানেই নির্বাচন বর্জন করেছে। পরাজয়ের শঙ্কা থেকেই বিএনপি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। নির্বাচনের পরে সরকার চমৎকারভাবে একটি রাজনৈতিক চাল চালার সুযোগ পাবে। নবনির্বাচিত বিএনপি দলীয় মেয়র এবং কারারুদ্ধ মেয়রদের কারামুক্ত করে একটি উন্নয়ন মঞ্চ সৃষ্টি করা হবে। তারপর ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, গাজীপুর, কুমিল্লা, বরিশাল ও সিলেট সিটি করপোরেশনে গড়ে একশ’ থেকে দুই শ’ কোটি টাকার অতিরিক্ত থোক বরাদ্দ দেয়া হবে। অন্য দিকে, কঠোরভাবে নির্দেশ দেয়া হবে ওসব বরাদ্দের সব কাজকর্ম বিএনপি দলীয় নেতাকর্মীদের দিয়ে করানো হবে। ফলে ওইসব শহরে বিএনপির অফিস কিংবা বিএনপি নেতৃত্ব বলতে মেয়রকেই বোঝানো হবে। এ ধরনের একটি চিত্রকল্প খুব একটা অস্বাভাবিক নয়।
বিএনপির মেয়র সাহেবেরা মনের আনন্দে থোক বরাদ্দ বিতরণ করতে করতে একবারও ভাববেন না- তাদের আমলনামায় কী লিখা হচ্ছে? কিছু দিন পর তাদের সবাইকে এক জায়গায় জড়ো করে এক হাতে দেয়া হবে আমলনামার কপি এবং অন্য হাতে দেয়া হবে নতুন থোক বরাদ্দের ডিও। তারপর বলা হবে- কী চাও? আমলনামার বিচার, নাকি ক্ষমা এবং পুনঃবরাদ্দ? সবাই বলবেন- ক্ষমা এবং পুনঃবরাদ্দ। তখন আবার বলা হবে, হে প্রশান্ত আত্মাগণ! আমরা তোমাদের বলছি, তোমরা ভোগ করো এবং পুরনোকে ত্যাগ করো- নতুন কিছু করো! নতুন বাংলাদেশ গড়ো- নতুন নেতৃত্বে!