বৃষ্টিতে ভিজছেন জাফর ইকবাল

জাফর ইকবালের অতি-নাটুকেপনা

বিলম্বে হলেও অধ্যাপক জাফর ইকবাল সম্পর্কে অধ্যাপক আসিফ নজরুল যথার্থ উক্তি করেছেন যে, “জাফর ইকবাল অপরাধবোধে ভোগেন। তিনি প্রতিনিয়ত মুক্তিযোদ্ধা হতে চেষ্টা করেন। তিনি বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। তার কোনো পড়াশোনা নেই, শিক্ষা তো দূরের কথা।” একথাগুলো আমি আগ বাড়িয়ে বললে কেউ আমল দিতো না। যেহেতু আসিফ নজরুল একজন সেলিব্রিটি শিক্ষক ও বুদ্ধিজীবী, তিনি তার “চাচা শ্বশুর” জাফর ইকবাল সম্পর্কে বলেছেন, অতএব বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। তার কথা মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে। তবে বিভিন্ন সময়ে জাফর ইকবালের বক্তব্য এবং অশিক্ষকসুলভ অসংলগ্ন আচরণে তাকে ইতর বিশেষ ও অতি-নাটুকে মনে হয়েছে।

আমি সংশয় তত্ত্বে বিশ্বাসী নই। জাফর ইকবাল সম্পর্কে আমার মনে সংশয় সৃষ্টি করেছিলেন দুটি আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাদেশী বংশোদ্ভুত দুই খ্যাতিমান গুণী অধ্যাপক। বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে এই দু’জন অধ্যাপকের কোনো আগ্রহ নেই, কিন্তু তাদের ফেলে যাওয়া দেশটির ভালো চান তিনি। তাঁরা তাদের এখতিয়ারে থাকা উপায়ে নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং বিশেষ করে তাঁদের বিভাগে বাংলাদেশী ছাত্রদের উপকার করতে চেষ্টা করেন।

তারা আমার কাছে জানতে চেয়েছিলেন আমি প্রফেসর জাফর ইকবালকে জানি কিনা। আমি তাদের উভয়কে জাফর ইকবাল সম্পর্কে যতটুকু জানি ততটুকু বলেছি। শিক্ষক হিসেবে জানি না, তবে তার দু’একটি লেখা পড়েছি। চেহারায় এবং বিশেষ করে চুল গোঁফে সম্ভবত একটু মিল আছে, সেজন্য একুশের বইমেলায় অনেক তরুণ-তরুণী তার বই কিনে আমার কাছে অটোগ্রাফ চেয়েছে। টিভি’র রান্নার প্রোগ্রামে তাকে দেখে আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছে, ইত্যাদি।
কিন্তু তাদের দৃঢ় বিশ্বাস, দেশ মাতৃকার সেবা করতে নয়, দেশের ১২টা বাজানোর মিশন নিয়ে জাফর ইকবাল আমেরিকা ছেড়ে দেশে গেছেন। আমেরিকার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট, আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি এবং একটি প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করাসহ দীর্ঘ ১৮ বছর জাফর ইকবাল আমেরিকায় কাটিয়ে দেশে ফিরে গেলেই সংশয় সৃষ্টি হওয়ার উপযুক্ত কারণ থাকার কথা নয়। কিন্তু তারা তাদের সংশয়ে অটল ছিলেন।

তাদের এই সংশয় আমার মনে জায়গা করে নিতে না পারলেও জাফর ইকবালের কর্মকাণ্ডে তার সম্পর্কে আমার বিশ্বাসে ফাটল ধরতে থাকে। তিনি ইস্যু তৈরি করতে পছন্দ করেন। মিডিয়ায় আলোচিত হতে পছন্দ করেন। ২০১৫ সালে আগস্ট মাসে তাকে দেখা যায় বৃষ্টির মধ্যে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ভিজতে। এটি ছিল তার স্ত্রীসহ ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক শিক্ষককে ছাত্রলীগ কর্মীদের দ্বারা প্রহারের প্রতিবাদ। ভাইস চ্যান্সেলরের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়ম ও অস্বচ্ছতার বিরুদ্ধে আন্দোলনরত “মহান মুক্তিযুদ্ধেও চেতনায় উদ্বুদ্ধ” আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের ওপর ছাত্রলীগের কয়েক নেতাসহ কর্মীরা “শাবিপ্রবি’র মাটি, ছাত্রলীগের ঘাঁটি,” “জয় বাংলা” ইত্যাদি শ্লোগান দিয়ে হামলা করলে জাফর ইকবালের স্ত্রী পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ইয়াসমিন ইকবালসহ কয়েকজন শিক্ষক আহত হন। এর প্রতিবাদে তিনি অঝোর ধারার বৃষ্টির মধ্য বসে থাকেন জাফর ইকবাল।
তখন তার বক্তব্য ছিল ছিল, “যেভাবে ছাত্ররা আমাদের শিক্ষকদের ওপর হামলা করেছে, তারা যদি আমার ছাত্র হয়ে থাকে, তাহলে আমি যে এ ধরনের ছাত্র তৈরি করেছি, সেজন্য আমার ফাঁসিতে ঝোলা উচিত।” (ডেইলি স্টার, ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৫)।

শিক্ষক পেটানোর সময় হামলাকারী ছাত্ররা “জয় বাংলা” শ্লোগান দিয়েছে, এটা তার জন্য বড় আঘাত ছিল। তিনি বলেন, “এই ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ করা হয়েছে। আমি আমার পুরো জীবনে এই শ্লোগানের এমন অপমান আর কখনও দেখিনি।” এই নাটুকে প্রতিবাদের পর ছাত্রলীগ তাদের কয়েক কর্মীকে বহিস্কার করলে জাফর ইকবাল একদিন পরই তার সুর পাল্টে বলেন যে ‘তিনি ভাবতেই পারেন না ছাত্রলীগ এমন করতে পারে। যারা ছাত্রলীগ করে, তারা তো সোনার ছেলে।’ তিনি সাংবাদিকদের কাছে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় ছাত্রলীগ কর্মীদের “ওরা বাচ্চা ছেলে” বলেও অভিহিত করেন।

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে এটি জাফর ইকবালের একমাত্র নাটক ছিল না। এর আগেও তিনি ও তার স্ত্রী ২০১৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদত্যাগ করেন ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের গৃহীত ব্যবস্থার প্রতিবাদে। পরে তারা পদত্যাগপত্র প্রত্যাহার করেন কর্তৃপক্ষ তাদের মনোমত উপায়ে ভর্তি পরীক্ষার নিয়ম পাল্টানোর পর।

আরও অনেক নাটকের জন্মদানকারী জাফর ইকবালের আরো অনেক অভিনয় খেয়াল করেছি। তার মধ্যে একটি ছিল, শুক্রবার জুমা’র জামাতে তার শামিল হওয়া। মসজিদের মেঝে পুরু কার্পেট মোড়া হলেও তিনি তার বাম বাহুর ওপর একটি জায়নামাজ ঝুলিয়ে নিয়ে যেতেন এবং নামাজ শেষে একই উপায়ে জায়নামাজ ঝুলিয়ে বাসায় ফিরতেন। তার ঈমান আমল সম্পর্কে আল্লাহ ভালো জানেন। অনেকে বলতেন যে তিনি আল্লাহ রাসুলের ধার ধারেন না। সেজন্য দর্শনীয়ভাবে তার জুমায় অংশগ্রহণে আমি বিস্ময় বোধ করতাম। তিনি বনানী ডিওএইচএস এ ৬ নম্বর রোডে বাস করতেন। আমিও একই রোডে ভিন্ন বাড়িতে বাস করতাম। তিনি এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরিবেশবিজ্ঞানি প্রফেসর ড. আতিক এ রহমান সম্ভবত একই বিল্ডিংয়ে থাকতেন। অতএব জুমা শেষে প্রায়ই জাফর ইকবাল ও ড. আতিকের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হতো। ড. আতিকের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক ছিল। আমাকে দেখলে তিনি দাঁড়াতেন এবং আমরা শুভেচ্ছা বিনিময় করতাম, দাঁড়িয়ে কথা বলতাম। জাফর ইকবাল পাশে থাকলেও তার সঙ্গে আমার কখনও কথা হয়নি। তার সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহ পোষণ না করার একমাত্র কারণ ছিল তার নাটুকেপনা।

তার এবারের নাটক শুধু নাটক নয়, অতি-নাটক। এবারের কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা তার কাছে আর “বাচ্চা ছেলে বা বাচ্চা মেয়ে” নয়। তারা নিজেদের যেহেতু “রাজাকার” বলে শ্লোগান দিচ্ছে, অতএব তিনি যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন আর ‘রাজাকারদের’ মুখ দেখতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন না, বলে লিখিত ঘোষণা দিয়েছেন।
আমি নিজে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না পারলে আমি অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতাম না। বাড়ির কাছে কোনো কলেজ থেকে ছোটোখাটো ব্যাচেলর ডিগ্রি নিয়েই আমাকে সন্তুষ্ট থাকতে হতো। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালর্য়ে খুব প্রশংসা করি না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ও মনে করি না। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বর্তমান আন্দোলনের পূর্ব পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে সংঘাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭৪ জন ছাত্র নিহত হয়েছে এবং প্রতিটি হত্যাকাণ্ডে নিহতদের নাম ও নিহত হওয়ার বছর উল্লেখ করে নিবন্ধও লিখেছি আমি। তা সত্ত্বেও আমি এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স ও মাষ্টার্স ডিগ্রি লাভ করেছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমার জীবনকে একটি ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছে, আমার বন্ধু ও পরিচিতজনের ব্যাপ্তি সম্প্রসারিত করেছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়কে আমি বিলং করি, বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে বিলং করে। অর্বাচীনের মতো আমি বলতে পারি না যে, অঘটন ঘটে বলে আমি কখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাব না।

Scroll to Top