ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত বর্তমান সময়ের চলমান দীর্ঘতম সংঘাত। বর্তমানে ফিলিস্তিনিরা পৃথিবীর সবচেয়ে মজলুম ও বঞ্চিত জাতি। নিজেদের বাড়িঘর হারিয়ে বর্তমানে প্রায় ৫০ লাখ ফিলিস্তিনি জাতিসঙ্ঘে শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত।
শরণার্থীদের প্রকৃত সংখ্যা আরো বেশি। শরণার্থীদের বেশিরভাগই বাস করে জর্ডান, গাজা ভূখণ্ড পশ্চিম তীর, সিরিয়া, লেবানন এবং পূর্ব জেরুসালেমে। তাদের এক তৃতীয়াংশ বসবাস করে শরণার্থী শিবিরগুলোতে। বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার ভুক্তভোগী এসব মানুষও স্বাধীনতা, সাম্য, ন্যায়বিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করছে। স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার ও প্রতিটি শিশুর শান্তিতে বসবাস নিশ্চিত করতে আমরণ সংগ্রাম চালানোতে প্রমাণিত হয়েছে ফিলিস্তিনিরা বীরের জাতি। শহীদের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে তবু ইসরাইলকে বিনা যুদ্ধে এক ইঞ্চি ভূখণ্ডও দখল করতে দেয়নি ফিলিস্তিনিরা।
ফিলিস্তিনি মুসলমানদের অপরিণামদর্শিতার কুফল হিসেবে ইহুদিদের নিকট কিছু ভূখণ্ড বিক্রি করে ফিলিস্তিনিরা যে সর্বনাশ ডেকে এনেছিল তার খেসারত তাদেরকে দিতে হচ্ছে এখনো পদে পদে। ১৮৯৬ সালে ইহুদি সাংবাদিক থিওডর হারজল দ্য জুইশ স্টেট শীর্ষক এক লেখায় বলেন, ক্রমবর্ধমান ইউরোপীয় ইহুদিবিদ্বেষের একমাত্র সমাধান আলাদা এক ইহুদি রাষ্ট্র। তার শুরু করা জায়নিজম আন্দোলনই মূলত ইসরাইল সৃষ্টির প্রধান কারণ। এই আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল ইহুদিদের জন্য একটি আলাদা আবাসভূমি সৃষ্টি করা।
এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে থিওডর দাবি করলেন, ফিলিস্তিন ছিল ইহুদিদের আদি আবাসভূমি। অবএব সব ইহুদিকে সেখানে ফিরে যেতে হবে। গড়তে হবে পৃথক নিবাস। বস্তুত এখান থেকেই শুরু ফিলিস্তিনি সমস্যার। ১৮৯৭ সালে জায়োনিস্ট সংঘ গড়ে তোলা হয়। প্রথম জায়োনিস্ট কংগ্রেসে লক্ষ্য ধার্য করা হয়, ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র করে তুলতে হবে।
১৯০২ সালে ৩৫ হাজার, ১৯১৪ সালে ৪০ হাজার, ১৯২৩ সালে ৪০ হাজার, ১৯২৯ সালে ৮২ হাজার ইহুদি চলে আসে ফিলিস্তিনে, যেটা এখন ইসরাইল নামে পরিচিত। খরচপাতিতে সাহায্য করত জ্যুইশ ন্যাশনাল ফান্ড, বিদেশি জায়োনিস্টরা এতে সাহায্য করত। ১৯২৮ সালে JNC (Jewish National Council) গঠিত হয় ফিলিস্তিনে। ১৯২৯ সালে প্রথম বড় ইহুদি-মুসলিম দাঙ্গা হয়। ১৯৩১ সালে জায়োনিস্টরা ইর্গুন জাই লিউমি নামে এক মিলিশিয়া প্রতিষ্ঠা করে। এই ইহুদি সন্ত্রাসী সংগঠন ১৯৪৬ সালে জেরুসালেমের কিং ডেভিড হোটেলে বোমা বিস্ফোরণ করে এবং ১৯৪৮ সালে ইহুদি অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে দেইর ইয়াসিন গ্রামে গণহত্যা করে।
১৯৩৩ সালে নাৎসিদের সাথে চুক্তিতে আরো ৫০ হাজার ইহুদি ফিলিস্তিনে চলে আসে। ১৯৩৮ সালে প্রায় আড়াই লাখ ইহুদি আসে ফিলিস্তিনে। ১৯৭৯ সালে ইরান থেকে পালিয়ে আসে ৪০ হাজার ইহুদি। ১৯৮৪ সালে ইথিওপিয়াতে দুর্ভিক্ষ চলাকালে ৮ হাজার ইথিওপিয়ান ইহুদিকে উড়িয়ে নিয়ে আসা হয় ইসরাইলে। ১৯৮৫ সালে লেবানন থেকে সব ইসরাইলিদের সরিয়ে নেয়া হয়।
ফিলিস্তিন ছিল উসমানীয় খেলাফতের অধীন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে যারা ছিল ব্রিটেন বিরোধী জোটে। ১৯১৭ সালে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড বেলফোর এই ভূমিতে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হবে বলে আশ্বাস দেন। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির সরকারের বেলফুর ডিক্লারেশনের মধ্য দিয়ে ফিলিস্তিনে ইহুদিদের পা রাখা বৈধতা পায়। সে অন্যায় পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েই ফিলিস্তিনীরা ইহুদি বিরোধী লড়াই শুরু করেছিল। বহু ইহুদি ইউরোপ থেকে গিয়ে প্যালেস্টাইনে বসবাস শুরু করেন, কিনতে শুরু করে জলাভূমি, প্রতিষ্ঠা করে তেল আবিব শহর ও একটি বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন ১৯১৮ সাল থেকে ৩০ বছর দেশটিকে নিজেদের অধীন রাখে এবং ম্যান্ডেট প্যালেস্টাইন নামক বিশেষ ব্যবস্থা চালু রাখে। ব্রিটিশ বাহিনীর সহযোগিতায় ইহুদিরা ফিলিস্তিনদের বিতাড়িত করে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য গড়ে তোলে অনেক প্রশিক্ষিত গোপন সন্ত্রাসী সংগঠন। তার মধ্যে তিনটি প্রধান সংগঠন ছিল হাগানাহ, ইরগুন ও স্ট্যার্ন গ্যাং যারা হত্যা, সন্ত্রাস, ধর্ষণ আর ধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টির মাধ্যমে নিরীহ ফিলিস্তিনদের বাধ্য করে নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে চলে যেতে। শুরু থেকেই ইসরাইলের চালানো এসব বর্বর-অসভ্য-নৃশংস আচরণের কোনো পরিবর্তন আজও হয়নি।
১৯৪২ সালে ডা. হাইম ওয়াইজম্যান ও আরো কয়েকজন ইহুদি নেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এক বৈঠকে মিলিত হয় এবং সেখানে বিটমোর প্রোগ্রাম নামে একটি প্রস্তাব পাস করা হয়। এ প্রস্তাব অনুসারে ইহুদী সাধারণতন্ত্র হিসেবে ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠার দাবি করা হয়। এ সংবাদে সমগ্র আবর জাহান বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৪৫ সালে আবরলীগ গঠিত হয়। তারপরও ফিলিস্তিনকে ইহুদি ও আরব দেশের মধ্যে ভাগ করে দিতে ‘জাতিসঙ্ঘ পার্টিশন’ পরিকল্পনা হয়। জাতিসঙ্ঘের ঘোষণাপত্র ১৮১ তে জেরুসালেমকে সার্বভৌম এলাকার মর্যাদা দেয়া হয়, তিন ধর্মালম্বীদের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ জায়গা হওয়ায় আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রণ থাকার কথা বলা হয়।
১৯৪৭ সালের ১৫ মে গঠিত হয় United Nations Special Committee on Palestine (UNSCOP) যা পরে প্রস্তাব দেয় ‘স্বাধীন এক আরব রাষ্ট্র, স্বাধীন এক ইহুদী রাষ্ট্র এবং জেরুসালেম শহর’- এই তিন ভাগ। ১৯৪৭ সালের ২৯ নভেম্বর ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করে দুটি রাষ্ট্র (একটি ইহুদি, অন্যটি আরব) প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ইঙ্গ-মার্কিন চাপে জাতিসঙ্ঘে ভোট গ্রহণ হয়। তাতে ৩৩টি রাষ্ট্র পক্ষে, ১৩টি বিরুদ্ধে এবং ১০টি ভোট দানে বিরত থাকে। প্রস্তাব অনুযায়ী মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ হয়েও ইহুদিরা পেল ভূমির ৫৭% আর ফিলিস্তিনরা পেল ৪৩%।
তবে প্রস্তাবিত ইহুদি রাষ্ট্রটির উত্তর-পশ্চিম সীমানা ছিল অনির্ধারিত। অর্থাৎ ভবিষ্যতে ইহুদিরা সীমানা বাড়াতে পারবে। ফলে ইসরাইল প্রতিষ্ঠা চূড়ান্ত হলেও উপেক্ষিত থেকে যায় ফিলিস্তিন। জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে পাস হয়ে যায় একটি অবৈধ ও অযৌক্তিক প্রস্তাব। অসম ও অন্যায্য এই যুক্তিতে আরবেরা সে সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি। আরব সমাজে অসন্তুষ্টি ছড়িয়ে পড়লে প্রায় ১ লাখ আরব ইহুদীপ্রধান এলাকা ছেড়ে চলে যায়। আমেরিকা তখন ফিলিস্তিন ভাগ করার প্রস্তাব থেকে সমর্থন গুটিয়ে নেয়, কিন্তু ১৯৪৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ব্রিটেন নতুনভাবে সমর্থন দেয়। ফলে আরব লীগের তীব্র বিরোধিতা স্বত্ত্বেও ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করে ইসরাইল নামে ইহুদি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে পাস হয়।
জাতিসঙ্ঘের যে প্রস্তাব অনুসারে ইসরাইল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, সেই একই প্রস্তাব অনুসারে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রেরও প্রতিষ্ঠা পাওয়ার কথা। অথচ ইসরাইল এখন বিশ্বের অন্যতম শক্তিধর দেশ। আর ফিলিস্তিনবাসীর জন্য স্বাধীনতা অধরাই রয়ে গেছে।
১৯৪৮ সালের ১৪ মে ব্রিটিশরা এই এলাকা ছেড়ে চলে যায়। পরে সঙ্কটের চূড়ান্ত রূপ দেখা যায় ইসরাইলের স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণার পর থেকে। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে তেলআবিব মিউজিয়ামে জ্যুইশ পিপলস কাউন্সিল জড়ো হয় এবং রাত ১২টা এক মিনিটে ইসরাইল রাষ্ট্র ঘোষণা করে জায়নিস্ট নেতা ডেভিড বেন গোরিয়ন। তিনি সকল ইহুদি নারী-পুরুষকে মিলিটারি ট্রেনিং নেয়া বাধ্যতামূলক করেন। ১০ মিনিটের ভেতর যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দেয়, অতঃপর সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ব্রিটেন। ১৫ই মে আরব-ইসরাইল যুদ্ধ শুরু হয়। মিসর, সিরিয়া, জর্ডান, ইরাক আর লেবানন একযোগে ইসরাইলকে আক্রমণ করে। সহায়ক হিসেবে সৌদি আরব ও ইয়েমেন সমর্থন জোগায় যুদ্ধ উপকরণ ও সৈনিক দিয়ে। সেই যুদ্ধে আরবেরা পরাজিত হয় এবং ইসরাইল জাতিসঙ্ঘ পরিকল্পনায় তাদের জন্য বরাদ্দকৃত ঐতিহাসিক ফিলিস্তিনের ৫৬ শতাংশের জায়গায় মোট ৭৭ শতাংশ দখল করে নেয়। এরপর যে এক চিলতে জমি পড়ে রইল, সেখানে স্বাধীন ফিলিস্তিন প্রতিষ্ঠা করা যেত। কিন্তু সেই পথে না গিয়ে মিসর ও জর্ডান তা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়। পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুসালেম গেল জর্ডানের বাদশাহর কবলে, গাজার দখল নিল মিসর।
জেরুসালেমের পশ্চিমাঞ্চলের অর্ধেক দখল করে ইসরাইলি বাহিনী সেখান থেকে বেশিরভাগ আরবকে বহিষ্কার করে, অনেক নিরস্ত্র মানুষ দখলদার সশস্ত্রদের ভয়ে জীবন বাঁচাতে সেখান থেকে পালিয়েও যায়। সেই থেকেই ইসরাইলের আগ্রাসনের শুরু। দখলদার ইসরাইলের হাতে লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনী জনগণ আহত, নিহত ও বাস্তুহারা হচ্ছে; উদ্বাস্তু হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আশ্রয় নিচ্ছে। ইহুদিরা হত্যা সন্ত্রাসের পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করার উদ্দেশে রাতে তাদের ফোন লাইন, বিদ্যুৎ লাইন কাটা, বাড়িঘরে হ্যান্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ, জোর করে জমি দখল এবং বিভিন্নভাবে নারী নির্যাতন করে মৃত্যু বিভীষিকা সৃষ্টি করেছিল। ফলে লাখ লাখ আরব বাধ্য হলো দেশ ত্যাগ করতে।
১৯৪৮-১৯৪৯ এই দু’বছরের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের সময় সাড়ে ৭ লাখ ২৬ হাজার ফিলিস্তিনি দেশছাড়া হয়। পরে ১৯৬৭ সালের জুন মাসে আরব ও ইসরাইলের মধ্যে আবারও যুদ্ধ হয় এবং ইসরাইল জর্ডানের পশ্চিম তীর এবং গাজা ভূখণ্ড দখল করে নেয়, আরো হাজার হাজার ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়ে পড়ে। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ, সিরিয়া, মিসর ও জর্দান সেনাবাহিনীকে ৬ দিনের যুদ্ধে পরাজিত করা পর্যন্ত জেরুসালেম ও জর্ডান নদীর পশ্চিম তীর জর্দানের অধীনস্ত ছিল। ১৯৬৮ সালের মার্চে ইসরাইলি ফোর্স অ্যাটাক করে ফিলিস্তিনি বাহিনী ফাতাহকে।
১৯৮২ সালে ইসরাইল লেবাননে আগ্রাসন চালিয়ে ১৭ হাজার ৫০০ মানুষকে হত্যা করে। এদের বেশির ভাগই ছিল নিরীহ সাধারণ মানুষ। ঐ একই বছর লেবাননের শাবরা শাতিলা গণহত্যায় ১৭ হাজার নিরীহ মানুষ নিহত হয়। লেবাননে ইসরাইলের উপর্যুপরি আক্রমণে ইয়াসির আরাফাত তার পিএলও-এর ঘাটি তিউনিশিয়ার রাজধানী তিউনিসে সরিয়ে আনেন। ১৯৮৬ সালে তিউনিসেও হামলা চালিয়ে বহু লোককে হত্যা করে ইসরাইল। এরপর ১৯৯৬ সালে কানা গণহত্যায় নিহত হয় ১০৬ সাধারণ লেবাননী জনগণ। এরা ছিল জাতিসঙ্ঘ আশ্রিত এবং নিহতদের অনেকেই ছিল শিশু।
২০০৬ সালে তারা লেবাননের মারওয়াহীন গ্রামের অধিবাসীদের ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলে। তারা চলে যাওয়ার জন্য রাস্তায় নামতেই হেলিকপ্টার থেকে তাদের গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
১৯৬৭ সালের ২৬ মে পূর্ব জেরুসালেম ও সিনাই জবরদখল করে নিয়েছিল ইসরাইলী বাহিনী। কিন্তু পূর্ব জেরুসালেমের অধিগ্রহণই বিশ্ব সম্প্রদায় মেনে নেয়নি; তাই তেল আবিবেই এতদিন যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসও কাজ করে আসছিল। দখল করার ১৩ বছর পর ১৯৮০ সালে ইসরাইল ‘জেরুসালেম ল’ পার্লামেন্টে পাস করে এবং জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করে। একই বছর জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদ ‘রেজ্যুলুশনার ৪৭৮’ নামে একটি সংশোধনী পাস করে; এতে বলা হয় ইসরাইলের ওই আইন গ্রহণযোগ্য নয়।
তারপরও ইসরাইল জেরুসালেমকেই তাদের রাজধানী হিসেবে দাবি করতে থাকে। তবে বিশ্বের কোনো দেশের কাছে এটি এতদিন স্বীকৃত ছিল না। এখনতো দখলদার বাহিনী বায়তুল আকসা মসজিদটিতে জুমার নামাজ আদায় নিষিদ্ধ করছে। অথচ ১৯৬৭ সালে যখন ইসরাইল এই এলাকায় প্রবেশাধিকার পায় তখন শুধু মুসলিমরাই আল-আকসায় নামাজ পড়তে পারতো। দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় প্রার্থনার সুযোগ পেত ইহুদিরা। মেনে চলতে হতো অনেক নিয়ম।
১৯৬৯-১৯৭০ সালে আবারো মিসরের সাথে ইসরাইলের যুদ্ধ লেগে যায়। ১৯৯৩ সালের জুলাইতে, এক সপ্তাহ ধরে ইসরাইল লেবাননে আক্রমণ চালায়, লেবাননের শিয়া হিজবুল্লাহ পার্টিকে দুর্বল করে দিতে। ২০০২ সালে এরিয়েল শ্যারন পশ্চিম তীরে ব্যারিয়ার বানানো শুরু করলেন। ২০০৪ সাল থেকে একদম পুরোদমে গাজায় প্রতিশোধ নিতে নামে ইসরাইল। চলতে থাকে অপারেশন। ২০০৬ সালের ১৪ মার্চ এক ফিলিস্তিনি জেলে অপারেশন চালায় ইসরাইল। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে ইসরাইলি এয়ারফোর্স সিরিয়ার নিউক্লিয়ার রিয়াক্টর ধ্বংস করে দেয়। ২০০৮ সালে হামাসকে শায়েস্তা করতে গাজায় অভিযান চালায় ইসরাইল। ২০১২ সালের নভেম্বরে হামাস নেতা আহমেদ জাবারিকে হত্যা করতে ইসরাইল গাজায় হামলা শুরু করে। ২০১৪ সালের ৮ জুলাই হামাসের রকেট হামলার উত্তরে ইসরাইল গাজা এলাকায় বড় আকারের আক্রমণ শুরু করে।
২০০৫ এর হিসাব মতে, জেরুসালেমে ৭,১৯,০০০ মানুষ বাস করত, যার ৪,৬৫,০০০ ইহুদি আর ২,৩২,০০০ মুসলিম। ইহুদীরা পশ্চিমে, আর মুসলিমরা পূর্ব দিকে বাস করে। ১৯৯৩ সালে সম্পাদিত অসলো প্রক্রিয়ার ভিত্তিতে এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরাইল ও ফিলিস্তিনি মুক্তি সংস্থার মধ্যে যে শান্তি চুক্তি সম্পাদিত হয়, তার ভিত্তিতে ১৯৯৬ সালে পশ্চিম তীর ও গাজায় নামকাওয়াস্তে ফিলিস্তিনি স্বায়ত্তশাসন কায়েম হয়। সেই অঞ্চলের একটা বড় অংশ ইসরাইলের অবৈধ বসতির কবলে, অথবা সরাসরি সামরিক নিয়ন্ত্রণে। নামেই স্বায়ত্তশাসন, কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে চৌপ্রহর ইসরাইলি প্রহরা, উঁচু দেয়াল, এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যেতে হলে ইসরাইলি অনুমতি নিতে হয়।
কিন্তু সেই প্রশাসনও দুই টুকরা হয়ে যায় ২০০৬ সালের নির্বাচনের পর। পশ্চিম তীর গেল ফাতাহর নিয়ন্ত্রণে, গাজা গেল ইসলামিক ব্রাদারহুডের মিত্র হিসেবে পরিচিত হামাসের নিয়ন্ত্রণে। এটা স্পষ্ট যে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করে ইসরাইলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল এবং যুক্তরাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ এবং একের পর এক তাদের বাসভূমি দখল করে যাচ্ছে ইসরাইল।
১৯৯৫ সালে মার্কিন কংগ্রেস ‘জেরুসালেম অ্যাক্ট’ পাস করেছে। সেখানে আমেরিকান দূতাবাসকে তেলআবিব থেকে জেরুসালেমে স্থানান্তরের বিষয় ছিল, কিন্তু নির্বাহী কর্তৃপক্ষ তা কার্যে পরিণত করতে অপারগতা প্রকাশ করে। অথচ ২০১৭ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সময় রাত ১২টায় ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০০ কোটি মুসলমানের প্রাণের সম্পদ পবিত্র ভূমি জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণা দেন। পূর্ব জেরুসালেমে প্রায় ৩ লাখ ৩০ হাজার ফিলিস্তিনি বাস করেন, এদের সঙ্গেই থাকেন আরো ২ লাখ ইহুদি ইসরাইলি। পশ্চিম জেরুসালেমে রয়েছে বেশি ইহুদির নিবাস। একদিকে ফিলিস্তিনি জনগণ বিশ্ব ফোরামে সব সময় বলে আসছে- স্বাধীন ফিলিস্তিনের ভবিষ্যৎ রাজধানী হবে জেরুসালেম, নির্দিষ্ট করে বললে পূর্ব জেরুসালেম। অন্যদিকে জেরুসালেমের যেকোনো অংশে রাজধানী স্থাপন করতে রাজি নয় ইসরাইল, তারা চায় জেরুসালেম হবে একটি ‘অখণ্ড’ শহর।
অর্থাৎ ইসরাইল জেরুসালেম নগরীর ইসলামি চরিত্র বদলে দিতে চাইছে। তারা মুসলমানদের বিভক্তির সুযোগ নিচ্ছে। ইতোপূর্বে জেরুসালেম শহরটি কমপক্ষে দুইবার ধ্বংস হয়েছে, ২৩ বার অবরোধ হয়েছে, ৫২ বার আক্রমণ হয়েছে এবং ৪৪ বার দখল এবং পুনর্দখল হয়েছে। জেরুসালেম খ্রিস্টানদের হাতে ছিল এমন সময়ে মুসলমানরা আল-আকসা মসজিদ বা বাইতুল মুকাদ্দাসের দিকে মুখ ফিরিয়ে নামাজ পড়েছেন।
৬৩৮ সালে খলিফা ওমরের (রা) সময় জেরুসালেম সর্বপ্রথম মুসলমানদের অধীনে আসে। ১০৯৬ সালে প্রায় পাঁচশ’ বছর পর জেরুসালেম আবার খ্রিস্টান ক্রুসেডারদের হাতে চলে যায়। ১১৮৭ সালে সালাহ উদ্দীন আইউবীর নেতৃত্বে জেরুসালেম মুসলমানদের অধিকারে আসে। ১৯১৭ সাল পর্যন্ত তা ওসমানীয় খেলাফত বা তুরস্কের অধীনে ছিল। ৯ ডিসেম্বর ১৯১৭ ব্রিটিশ বাহিনীর হাতে পরাজিত হয়ে ওসমানী খেলাফতের সেনাবাহিনী জেরুসালেম ত্যাগ করেন এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ গায়ের জোরে তা দখল করে নেয়। পরে ১৯৬৭ সালে পূর্ব জেরুসালেম সংযুক্ত করলেও তখনই জেরুসালেম নিয়ে কিছু বলেনি ইসরাইল। ১৯৮০ সালে জেরুসালেমকে ইসরাইলের ‘অনন্ত কালের রাজধানী’ আখ্যায়িত করেছিল।
পূর্ব জেরুসালেমে ২০১৬ সালের জুনে ১৩০টি পাকা বাড়ি ইহুদিদের জন্য তৈরি করা হয়। পূর্ব জেরুসালেমের কিছু উত্তরে ‘নিভ ইয়কভ’ এলাকায় আরো ৬৮টি বাড়ি নির্মাণের কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়। ২০১৬ সালের জুলাই মাসে ১ হাজার ৮০০ বাড়ি পূর্ব জেরুসালেমে নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী ঘোষণার পরপরই সেখানে নতুন করে ১৪ হাজার ইহুদি বসতি নির্মাণের অনুমোদন দেয়া হয়। রামাল্লার বিভিন্ন স্থানে আরো হাজার হাজার বসতি নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। এসবের মূল উদ্দেশ্য জেরুসালেমকে ইহুদি সংখ্যাগরিষ্ঠ বানানো এবং পূর্ব জেরুসালেম থেকে মুসলমানদের উৎপাটন।
জেরুসালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে পুরো মুসলিম বিশ্বের গালে চপেটাঘাত করা হয়েছে। মার্কিন দূতাবাস জেরুসালেমে স্থানান্তরে ইসরাইলের দখলদারিত্ব আরো বেড়ে গেছে। এখন ফিলিস্তিনিদের প্রধান দাবি- তাদের জমিতে ফিরে যাওয়ার অধিকার। এই দাবির ভিত্তি হচ্ছে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে ১৯৪৮ সালে গৃহীত এক প্রস্তাব। সেখানে বলা হয়েছে, ‘যেসব শরণার্থী তাদের বাড়িতে ফিরে যেতে চাইবে এবং প্রতিবেশীদের সাথে শান্তিতে বসবাস করবে তাদেরকে সেখানে যাওয়ার অনুমতি দিতে হবে।’
কিন্তু ইসরাইলের বক্তব্য- ৫০ লাখ শরণার্থীকে ফিরিয়ে নেওয়া অসম্ভব। কারণ সেরকম কিছু হলে তারাই ৮৫ লাখ জনসংখ্যার দেশটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে পড়বে এবং ইহুদি রাষ্ট্র হিসেবে ইসরাইলের সমাপ্তি ঘটবে। কিন্তু বিশ্ববাসী চায় পূর্ব জেরুসালেমকে রাজধানী করে ১৯৬৭ সালের সীমানা অনুযায়ী একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হোক এবং ইসরাইলের আগ্রাসন বন্ধ হোক। এ জন্য ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থনের স্বার্থে স্বাভাবিকভাবেই বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায়কে আমেরিকান সব পণ্য বর্জন করতে হবে। সব পণ্য বর্জনের মাধ্যমে ট্রাম্পের ফিলিস্তিন বিরোধী কর্মকাণ্ডের শুধু প্রতিবাদ নয়, এর বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে বিশ্বব্যাপী।
ফিলিস্তিনি সমস্যা সমাধানের জন্য এই আন্দোলনকে সমর্থন করতে বৈচিত্র্যের মাধ্যমে বিস্তৃতি বাড়াতে হবে। দেশে দেশে প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি একটি বিল পাসের মাধ্যমে ইসরাইলের সিদ্ধান্তকে একটি অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করতে হবে। সমস্যাটির সুষ্ঠু সমাধান না হওয়া পর্যন্ত প্রচেষ্ঠা অব্যাহত রাখতে হবে। ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সরব হতে এবং ইসরাইলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে সাইবার জগত ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমসহ সব জায়গায় অব্যাহত রাখতে হবে। রাজনৈতিক মতবিরোধ ভুলে ফাতাহ আন্দোলন ও হামাসকে আরো কাছাকাছি আসতে হবে। নির্যাতিত সব ফিলিস্তিনিকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। বিশ্বের কোটি কোটি মুসলিমের কাছে আবেদন তৈরি করতে হবে।