এবনে গোলাম সামাদ : অনেকের ধারণা, মানবধারার (Race) দিক থেকে সব ইহুদি হলো এক। কিন্তু আসলে তারা তা নয়। বেশির ভাগ ইহুদি, প্রায় চার ভাগের তিন ভাগ বাস করত ইউরোপে। কিন্তু ইউরোপে চেহারার দিক থেকে দুই ধরনের ইহুদিদের দেখা যায়। এদের এক ধরনের ইহুদিকে বলা হয় পুবের ইহুদি। আরেক ধরনের ইহুদিদের বলা হয় পশ্চিমের ইহুদি। পুবের ইহুদিদের মাথার আকৃতি হতে দেখা যায় গোল। এদের চোখের তারার রং হালকা; গাঢ় কালো বর্ণের নয়। এদের আছে অথবা কিছু দিন আগেও ছিল একটি বিশেষ ভাষা, যার মাধ্যমে এরা নিজেদের মধ্যে কথালাপ করত। অবশ্য এই ভাষাতে তারা নিজেদের জন্য কিছু সাহিত্য সৃষ্টিও করেছে। তাই ভাষাটিকে একেবারেই বলা যায় না ছিল কেবলই মুখের ভাষা।
এই ভাষাটির নাম হলো ইদিস (Yiddish)। এই ভাষাটির উদ্ভব হতে পেরেছিল হিব্রু এবং মধ্যযুগে প্রচলিত জার্মানির রাহ্ইন (Rhine) অঞ্চলের জার্মান ভাষার সংমিশ্রণ। ভাষাটা লেখা হতো এবং এখনো হয় হিব্রু অক্ষরে। পুবের ইহুদিরা বাস করত প্রধানত পূর্ব জার্মানি, পোল্যান্ড, রাশিয়া ও রোমানিয়াতে। এরা ছিল প্রধানত কৃষক, শ্রমজীবী, সরাইখানার মালিক এবং ছোটখাটো দোকানদার। অর্থাৎ স্বল্প আয়ের লোক। একসময় খ্রিষ্টানরা এদের ওপর করেছে অমানবিক অত্যাচার। চালিয়েছে হত্যাকাণ্ড। রুশ ভাষায় যাকে বলে পোগরম (Pogrom)। কিন্তু পুবের ইহুদিরা তা বলে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। টিকে থাকে ১৯১৭ সালে নভেম্বর মাসে যে রুশ-বিপ্লব সঙ্ঘটিত হয় তার অধিকাংশ নেতা ছিলেন পুবের ইহুদিরা। যার মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতিমান হলেন লিয়ন ত্রতস্কি। লেনিনের পরেই ছিল যার বিশেষ মর্যাদা এবং দলগত অবস্থান। তিনি গড়ে তোলেন লালফৌজ।
যাদের বলা হয় পশ্চিমের ইহুদি, তারা পুবের ইহুদিদের তুলনায় দেখতে ছিল অনেক ভিন্ন। এদের মাথার আকৃতি হলো লম্বা। চোখের তারার রং সাধারণত হতো এবং হয় কালো। মাথার চুল হতো এবং হয় তরঙ্গাকৃতির। এসব ইহুদি আর্থিক দিক থেকে দরিদ্র ছিল না। এরা ছিল প্রধানত শিক্ষিত মধ্যবিত্ত। যেমন প্রফেসর, ডাক্তার, উকিল। এরা ছিল অনেকেই ধনী ব্যবসায়ী এবং নামকরা ব্যাংকের মালিক। যেমন রথচাইল্ড, লয়েড্্সের মতো ব্যাংকার পরিবারের লোকজন। বিলাতে যেসব ইহুদি বাস করত এবং এখনো করে, তারা ছিল প্রধানত পশ্চিমের ইহুদি-বিভাগভুক্ত। বিলাত থেকে বাংলাদেশে এসেছিল ইহুদি র্যালি পরিবার। বাংলাদেশের পাট কেনাবেচা ব্যবসায় এরা একসময় লাভ করেছিল বিশেষ প্রাধান্য। যারা বাংলাদেশ থেকে প্রচুর বিত্ত ইংল্যান্ডে নিয়ে গিয়েছিল। সব অঞ্চলে ইহুদিদের একরকম চেহারা ছিল না। কেবল মাথার আকৃতি, চোখের রকম ও চুল যে তাদের আলাদা হয়, তাই নয়। অনেক ক্ষেত্রে ইহুদিদের মধ্যে এই পার্থক্যটা হতে দেখা যায় খুবই বড় রকমের। যেমন দক্ষিণ ভারতের কেরেলার ইহুদি সম্প্রদায়। এদের গায়ের রঙ কেরেলার হিন্দুদের মতোই কালো। দেখতেও তারা প্রায় কেরেলার হিন্দুদেরই মতো। যদিও ধর্মে তারা হল ইহুদি। এখন এদের অনেকে কেরেলা ছেড়ে চলে গেছে ইহুদি-রাষ্ট্র ইসরাইলে।
চীনে খুব সামান্য সংখ্যক ইহুদি আছে। এরা দেখতে স্থানীয় চীনাদেরই মতো। আমি এসব কথা বলছি, কারণ ইহুদিদের দাবি ছিল তারা সবাই প্রায় দুই হাজার বছর আগে ফিলিস্তিন অঞ্চল ছেড়ে এসেছিল ইউরোপে। তাই আবার তাদের অধিকার আছে ফিলিস্তিনে গিয়ে একটি ইহুদি স্বদেশ-ভূমি (রাষ্ট্র কথাটা তারা বলেনি) গড়ে তুলবার অধিকার। সেই প্রাচীনকালে ইহুদিরা কথা বলত হিব্রু ভাষায়। পরে তারা হিব্রু ভাষায় কথা না বলে, কথা বলতে শুরু করে আরামাইক ভাষায়। হিব্রু ভাষায় সম্পন্ন হতে থাকে কেবল তাদের ধর্মানুষ্ঠান। অর্থাৎ প্রার্থনার কাজ। হিব্রু ভাষায় জেরুসালেমের নাম ছিল, জিঅন (Zion)। এ থেকেই ইহুদিদের ফিরে গিয়ে ইহুদি রাষ্ট্র গড়বার আন্দোলন নাম পেতে পারে জিয়নিজম। ইহুদিরা নিজেদের রাষ্ট্রের নাম রেখেছে ইসরাইল (ইংরেজি উচ্চারণে ইজরাইল)। ইসরাইল ছিলেন হজরত ইব্রাহিমের অন্যমত পুত্র। ইহুদিরা দাবি করে যে, তারা হলো হজরত ইসরাইলের বংশধর। ইহুদি শব্দটা হিব্রু ভাষার। ইসরাইলিরা একসময় নিজেদের বলত ইহুদা। আরবিতে বলে ইহুদি। হজরত ইব্রাহিমের আরেক পুত্রের নাম ছিল ইসমাইল। আরব মুসলমানেরা দাবি করেন, তারা হলেন হজরত ইসমাইলের বংশধর। অর্থাৎ বনি ইসমাইল। এখানে উল্লেখ্য, আরবি ভাষা ও হিব্রু ভাষা একই সিমেটিক পরিবারভুক্ত। ভাষার দিক থেকে এরা খুব ভিন্ন নয়। যেমন হিব্রু ভাষায় সালম মানে শান্তি। আরবিতেও সালাম বলতে শান্তিই বোঝায়। অনেকের মতে ইসলাম শব্দটার উদ্ভব হয়েছে আসলে হিব্রু সালম শব্দ থেকে।
প্রথম মহাযুদ্ধের আগে ইউরোপে একটি রাজ্য ছিল, ইংরেজিতে যাকে ডাকা হতো অস্ট্র-হাঙ্গেরি (Austro-Hungary) নামে। এই রাজ্যে অস্ট্রিয়া অংশের ভাষা ছিল জার্মান। আর হাঙ্গেরি অংশের ভাষা ছিল হাঙ্গেরিয়ান (ম্যাগিয়ার)। অস্ট্র-হাঙ্গেরি রাজ্যটির রাজধানী ছিল ভিয়েনা। যার ভাষা ছিল জার্মান। এ সময় ভিয়েনা হয়ে উঠেছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। থিওডর হার্জাল (Theodor Herzl, 1860-1904) জন্মেছিলেন হাঙ্গেরিতে। তিনি পেশায় ছিলেন একজন সাংবাদিক। সাংবাদিকতা করতেন ভিয়েনাতে (Vienna)। ইনি প্রথম আরম্ভ করেন ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র স্থাপন করবার আন্দোলন। বিলাতে প্রথম মহাযুদ্ধের সময় অ্যাসিটন নামক বস্তুর অভাব ঘটে। অ্যাসিটন ছাড়া তখন যেসব বিস্ফোরক যুদ্ধের কাজে ব্যবহৃত হতো, তার বিস্ফোরণ ঘটানো যেত না। সেইম ভাইজমান (Chaim Weizman) ছিলেন একজন রুশ ইহুদি কেমিস্ট। কিন্তু তিনি প্রথম মহাযুদ্ধ বাধার আগে দিয়ে ইংল্যান্ডে আসেন এবং হতে পারেন বিলাতের লিড্স বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কেমিস্ট্রির প্রফেসর। তিনি জানতেন সস্তায় যথেষ্ট পরিমাণে এসিটন উৎপাদন করবার একটি গোপন কৌশল। আসলে এই কৌশলটির আবিষ্কারক ছিলেন তিনি। প্রথম মহাযুদ্ধের সময় ভাইজমান ব্রিটিশ সরকারকে বলেন, ব্রিটেন যদি যুদ্ধে জেতে এবং এই যুদ্ধে জেতার পর ফিলিস্তিনে ইহুদি আবাসভূমি গড়তে দেবে বলে প্রতিশ্রুতি দেয়, তবে তিনি ব্রিটিশ সরকারকে তার এসিটন তৈরির কৌশল দেবেন। ব্রিটিশ সরকার তাকে দেয় ইহুদি আবাস গড়ার প্রতিশ্রুতি। উল্লেখ করা যেতে পারে, ফিলিস্তিনে ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ভাইজমান হন তার প্রথম প্রেসিডেন্ট।
প্রথম দিকে ফিলিস্তিনে ইহুদি রাষ্ট্র স্থাপনের আন্দোলন পশ্চিমের ইহুদিদের মধ্যে তেমন সাড়া জাগাতে পেরেছিল না। যেমন জাগাতে পেরেছিল পুবের ইহুদিদের মধ্যে। কিন্তু ১৯৩৩ সালে এডলফ হিটলার হন জার্মানির চ্যান্সেলর। তিনি ছিলেন প্রচণ্ড ইহুদিবিদ্বেষী। জার্মানিতে শুরু হয় ইহুদি নির্যাতন ও নিধন। হিটলার জন্মেছিলেন অস্ট্রিয়াতে; জার্মানিতে নয়। তার জীবনের একটা অংশ কেটেছিল ভিয়েনাতে। হিটলার ক্ষমতায় এসে অস্ট্রিয়াকে জার্মানির সাথে যুক্ত করেন। অস্ট্র-হাঙ্গেরি সাম্রাজ্য প্রথম মহাযুদ্ধের পরে ভেঙে পড়েছিল। অস্ট্রিয়াতে হিটলার ইহুদিদের ওপর চালান নির্যাতন। এর ফলে গোটা জার্মানি থেকে দলে দলে ইহুদি আসতে আরম্ভ করে সাবেক ফিলিস্তিনে বৈধ ও অবৈধ পথে।
প্রথম মহাযুদ্ধের আগে ফিলিস্তিন ছিল উসমানলি তুর্কি বা তুরস্কের একটি প্রদেশ। প্রথম মহাযুদ্ধে তুরস্ক যোগ দিয়েছিল জার্মানির সাথে। জার্মানির মতো সেও প্রথম মহাযুদ্ধে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের কাছে পরাজিত হয়। লিগ অব নেসন্স (League of Nations) বা জাতিপুঞ্জ ফ্রান্সকে ম্যানডেট বা শাসনভার দেয় সিরিয়ার। আর ব্রিটেনকে প্রদান করে ফিলিস্তিনের। ফলে ইউরোপ থেকে দলে দলে ইহুদিরা যেতে পেরেছিল ফিলিস্তিনে। তারা প্রচুর জলা জায়গা ক্রয় করেছিল খুব চড়া দামে আরবদের কাছ থেকে। আরবরা খুশি হয়েছিল এত চড়া দামে জলা জমি বিক্রি করার জন্য। বাংলা ভাষায় হাওর শব্দটা এসেছে আরবি থেকে। ইহুদিরা ফিলিস্তিনে এসে হাওর কিনেছিল। ১৯৩৯ সালে ১৭ মে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট একটি শ্বেতপত্রের মাধ্যমে ঘোষণা করে, ব্রিটেন ফিলিস্তিনে কোনো ইহুদি রাষ্ট্র স্থাপন করতে দেবে না। সেখানে গড়বে এমন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, যাতে কিনা আরব এবং ইহুদিরা ভোগ করবে সমান অধিকার। কিন্তু ১৯৪৫ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতে না হতেই ইহুদিরা আরম্ভ করে ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিদ্রোহ। অন্যদিকে আরবরা শুরু করেন ইহুদিবেরোধী যুদ্ধ। ফলে ব্রিটিশ প্রশাসনের হাত থেকে চলে যায় ফিলিস্তিনের বাস্তব নিয়ন্ত্রণ। ১৯৪৭ সালে ব্রিটেন সমস্যাটিকে নিয়ে যায় রাষ্ট্রসঙ্ঘে (UNO)।
রাষ্ট্রসঙ্ঘ প্রস্তাব পাস করে, প্যালিস্টাইনকে ভাগ করে দু’টি রাষ্ট্র গড়ার। একটি হবে ইহুদিদের আরেকটি হবে আরব মুসলমানদের। ব্রিটেন ফিলিস্তিন পরিত্যাগ করে দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে। ইহুদিদের সাথে আরবদের যুদ্ধ বেধে যায়। কিন্তু আরবরা যুদ্ধ করে ইসরাইলের সাথে জিততে পারে না। ইসরাইলকে আক্রমণ করে মিসর, জর্ডান, ইরাক, সিরিয়া, সৌদি আরব ও লেবানন।
১৯৪৫ সালে সৌদি আরবের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল আরব লীগ। এরা সবাই ছিল আরব লীগের সদস্য। যুদ্ধ হয়েছিল আরব লীগের সাথে একা ইসরাইলের। কিন্তু তথাপি জিতেছিল ইসরাইল। ১৯৪৯ সালে রাষ্ট্র হিসেবে ইসরাইল রাষ্ট্র-সঙ্ঘের সদস্য হয়। কিন্তু সাবেক ফিলিস্তিনে গঠিত হয় না কোনো আরব রাষ্ট্র। আর তাই ফিলিস্তিনে কোনো আরব রাষ্ট্র হয় না রাষ্ট্র-সঙ্ঘের সদস্য। আরবরা যুদ্ধে জিততে না পারলেও মিসর জয় করতে পেরেছিল গাজা, ইহুদিদের কাছ থেকে। জর্ডান জয় করতে পেরেছিল জেরুসালেমের পূর্বাংশ; ইসরাইল যা পেতে পেরেছিল রাষ্ট্রসঙ্ঘের বিভাগ রেখা অনুসারে। ইসরাইলের সাথে আরব লীগের শেষ যুদ্ধ হয় ১৯৬৭ সালে। ইসরাইল এই সময় দখল করে মিসরের কাছ থেকে গাজা ও সিনাই; সিরিয়ার কাছ থেকে গোলান মালভূমি আর জর্ডানের কাছ থেকে পূর্ব জেরুসালেম ও আরো অনেক জায়গা। একটি হিসাব অনুসারে, ১৯৬৭ সালের আগে ইসরাইলের আয়তন ছিল ৮০১৭ বর্গমাইল। আর বর্তমানে তার আয়তন দাঁড়িয়েছে ৩০০০০ বর্গমাইলের উপরে। যা আরবরা ইসরাইরের কাছ থেকে আর উদ্ধার করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না।
১৯৪৮ সাল থেকে ইসরাইলে যুদ্ধ করে চলেছেন ইহুদিরা আরবদের সাথে। কিন্তু যুদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও ইসরাইলে হতে পারছে নির্বাচন। ইসরাইল একটি পার্লামেন্টারি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। প্রতি চার বছর অন্তর ইসরাইলের আইনসভা বা পার্লামেন্টের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে ভোট দেন প্রাপ্ত বয়স্ক ইহুদি নাগরিকেরা। আইনসভাকে হিব্রু ভাষায় বলে ক্নেসেট (Knesset)। ক্নেসেট কর্তৃক প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন প্রতি পাঁচ বছরের জন্য। ইসরাইলের আইন পরিষদ এককক্ষ বিশিষ্ট। সরকার বদলের জন্য ইসরাইলে সরকারের ধারাবাহিকতার অভাব ঘটে না। হয় না অর্থনৈতিক অব্যবস্থা। ইসরাইল বাজার অর্থনীতিতে বিশ্বাস করে। কিন্তু ইসরাইলে গড়ে উঠেছে বিশেষ এক ধরনের সমবায় আন্দোলন। যাকে বলা হয় কিবুৎজ (Kibbutz)। কিবুৎজ শব্দটা হিব্রু ভাষার। শব্দগত অর্থ হলো সমষ্টি (Group)। প্রতিটি কিবুৎজের সদস্যরা কাজ করেন একত্রে। তারা যা উৎপাদন করেন, তারা তা ভোগ করেন একত্রে। কিবুৎজে মুদ্রা বিশেষ ব্যবহৃত হয় না। কেবলমাত্র বাইরে থেকে প্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনাবেচার জন্য মুদ্রার ব্যবহার করা হয়। ফলে ইসরাইল রাষ্ট্রে অন্য দেশের মতো ঘটতে পারছে না মুদ্রাস্ফীতির সমস্যা। মানুষ সে দেশে অনুমান করতে পারছে কতটা দ্রব্য তারা উৎপাদন করতে পারছে, আর কতটাইবা তারা পারবে ভোগ করতে।
হিব্রু (Hebrew) ভাষাটা ২০০০ বছর আগে পরিণত হয়েছিল একটি মৃত ভাষায়। একমাত্র প্রার্থনা ছাড়া আর কোনো কাজে এর ব্যবহার ছিল না। কিন্তু ইসরাইলে ভাষাটার নবজন্ম ঘটেছে। হিব্রু ব্যবহৃত হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনায়। হিব্রু ব্যবহৃত হচ্ছে বিদ্যালয়ে ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায়। ইসরাইলে খাদ্য উৎপাদনের ওপর অধিক গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। এর জন্য উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়েছে উন্নতমানের সেচ প্রকল্প। দেশটির অধিকাংশ হলো মরুভূমি। কিন্তু এখন উন্নত সেচব্যবস্থার মাধ্যমে আগে যেখানে কিছুই জন্মাতে চাইত না, সেখানে করা যাচ্ছে আপেল ফল। ইহুদি ধর্মে অনেক নবী এসেছেন। তবে যার প্রভাব হলো সবচেয়ে বেশি, তিনি হলেন হজরত মুসা এবং তাঁর কেতাব তাওরাত। যার ভাষা হলো হিব্রু। হিব্রু ভাষায় হজরত মুসার অনুসারীদের বলা হতো ইহুদা। আমরা বলি ইহুদি। ইহুদি আইনকানুনের ব্যাখ্যাকে একত্রে বলা হয় তালমুদ। জার্মা বলতে বোঝায় ইহুদি আইনকানুনের ব্যাখ্যাকে। তবে এর ভাষা হলো আরামাইক, যা একসময় চলত জেরুসালেম ও তার সংলগ্ন অঞ্চলে। ইসরাইলের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষিত হয়েছে ইহুদি ধর্ম। যা হলো ইহুদি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি। ইসরাইল একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র নয়। কিন্তু তথাপি ইসরাইল চিহ্নিত হচ্ছে না একটি ধর্ম-উন্মাদ রাষ্ট্র হিসেবে। ইসরাইলে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে ইহুদি ধর্ম বিশ্বের শ্রেষ্ঠধর্ম। আর হজরত মুসার আইন মেনে চললে বিশ্বে আসবে শান্তি। ইহুদিরা হলেন আল্লার প্রিয়পাত্র। কারণ তারা হজরত মুসার অনুসারী। সারা বিশ্ব শান্তিপূর্ণ হবে, যদি তা তাই আসে ইসরাইলের প্রভাবে।
ইসরাইল তাই চাচ্ছে সারা বিশ্বে তার প্রভাবকে বিস্তারিত করতে। আমার মনে পড়ে ১৯৭১ সালের কথা। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আবদুস সামাদ আজাদকে পাঠিয়েছিলেন ইসরাইলে সাহায্য সহযোগিতা পাবার আশায়। ইসরাইলের সাথে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের যোগাযোগ হতে পেরেছিল ভারতের পূর্ব কমান্ডের অন্যতম সেনাপতি জেএফআর জ্যাকবের উদ্যোগে। জ্যাকব কেবল ইহুদিই ছিলেন না, ছিলেন জিয়নিস্ট। তিনি ব্রিটিশ-ভারতের সেনাবাহিনীতে যোগ দেন হিটলারের সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করবেন এই সংকল্প নিয়ে। জ্যাকব রচনা করেছিলেন ১৯৭১ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের আত্মসমর্পণের দলিল। যাতে এ এ কে নিয়াজি ও জগজিৎ সিং অরোরা স্বাক্ষর করেছিলেন। এই স্বাক্ষরতার অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করেছিলেন জেএফআর জ্যাকব। পাকিস্তান অবশ্য ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। কেবলমাত্র পাকিস্তানের ইস্টার্ন কমান্ডের লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজি বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করেছিলেন ভারতের পূর্ব কমান্ডের সেনাপতি লে. জে. অরোরার কাছে। পৃথিবীর সব দেশের ইহুদিরা চাচ্ছেন ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের প্রতাপ প্রতিপত্তি বৃদ্ধি। ১৯৭১ এ জ্যাকবও তাই চেয়েছিলেন। যদিও আমরা তাকে দিয়েছি মুক্তিযুদ্ধের একজন যোদ্ধা হিসাবে বিশেষ খেতাব। কিন্তু তিনি যা চেয়েছিলেন, তার লক্ষ্য ছিল ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইলের স্বার্থ; বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থ নয়।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট