শিবিরের উদারতা কি দুর্বলতা?

15
ছাত্র আন্দোলন ও শেখ হাসিনার পতন: একটি নতুন যুগের সূচনা?

প্রথমেই একটি বিষয় পরিষ্কার করি। ছাত্র-গণআন্দোলনে সর্বস্তরের জনগণ অংশগ্রহণ করলেও আন্দোলনের স্ট্রাটেজি ও কর্মসূচি সর্বস্তরের জনগণ নির্ধারণ করেনি। এমনকি ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়নসহ ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর সঙ্গে আলাপ করে কোনো কর্মসূচি নির্ধারণ করা হয়নি। আন্দোলনের স্ট্রাটেজি ও কর্মসূচির সিদ্ধান্ত গুটি কয়েক ছাত্রনেতা গ্রহণ করতো এবং বাকিরা সবাই সেই সিদ্ধান্ত মেনে আন্দোলন করতেন৷ আর সেক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার কয়েকটি স্তর ছিল। যার মধ্যে ১৫ জুলাই পর্যন্ত স্তরে এতে শুধু বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিবির এতে অংশ নিয়েছে ও কর্মসূচিতে ভূমিকা রেখেছে।
১৫ জুলাই আন্দোলনে ডাকসুর সমাজ সেবা সম্পাদক আখতার হোসেন ও সিএফ আকরাম হোসাইনের সঙ্গে টোকিও থেকে আমি সম্পৃক্ত হই এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী সংস্থার সাবেক সভানেত্রী তামিমা জোবায়দা পুরো সময়ে আমার সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, পর্যালোচনা ও স্ট্রাটেজি প্রণয়নে সম্পৃক্ত ছিল।
আবার ১৭ জুলাইয়ের পর থেকে ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র শিবির, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র শিবির, প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র শিবির, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবির ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র শিবির সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় সরাসরি সম্পৃক্ত ছিল।
এখানে একটি বিষয় বলা দরকার পুরো আন্দোলনে সবচেয়ে বড় ডিসাইসিভ ঘটনা ছিল সরকারদলীয় এজেন্সির মধ্যে সবার আগে ছাত্রলীগকে আত্মসমর্পণ করানো। যদি ছাত্রলীগকে ক্যাম্পাস ছাড়া করা না যেত তাহলে আন্দোলনকে মোটেই সফল করা সম্ভব হতো না। তখন মূলতঃ কোটার বিষয়ে সরকারের ছাড় নিয়েই সবাইকে ক্লাসে ফিরে যেতে হতো এবং এখনো আমরা ছাত্র নেতাদের রিমান্ড আর জেলখানায় অসুস্থ হওয়া নিয়ে ফেসবুকে হাহাকার করতাম।
কিন্তু বাস্তবতা হলো শিবিরের সম্পৃক্ততায় ছাত্রলীগের হল ছাড়া হওয়ার ঘটনা থেকে আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছে। এক্ষেত্রে আমার কাছে বারবার আন্দোলন শেষ করার বার্তা আসলেও আন্দোলন ৫ আগস্ট পর্যন্ত জারি ছিল শিবিরের সাহসী সিদ্ধান্তে। তাই ডিবি পুলিশ ও সরকার বারবার সমন্বয়কদের গুম করে, আটকে রেখে, মুচলেকা নিয়ে আন্দোলন থামিয়ে দেওয়ার পরেও আন্দোলন জারি ছিল।
এখন কথা হলো সময়টি যদি ২০২৪ না হয়ে ১৯৭১ সাল হতো আর সংগঠনটি ছাত্র শিবির না হয়ে ছাত্রলীগ হতো তাহলে কি কেউ একদিকে দাবি করত স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে আবার স্বাধীনতা আন্দোলনে অন্যতম নেতৃত্বদাতা সংগঠন রাজনীতি করতে পারবে কি না তা নিয়ে অন্যদের মুখ থেকে কিছু শুনতে হবে? বিশেষ করে এখন ছাত্র ইউনিয়ন বা ছাত্রফ্রন্ট, যাদেরকে সচেতনভাবে বাদ দিয়েই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন গড়তে হয়েছে, তারা কি কোনো মতামত দিতে পারে?
মূলতঃ ছাত্রশিবিরের উদারতাকে সবাই দুর্বলতা হিসাবে গ্রহণ করেছে। যারা নেপথ্যে ও প্রকাশ্যে হাসিনাকে উৎখাতে নেতৃত্ব দিয়েছে তারা যেখানে বিপ্লবোত্তর সময়ে সবকিছুর নেতৃত্ব দেওয়ার কথা সেখানে সবাই ভাব করছে যে বিপ্লবী বীররা কায়েমি স্বার্থবাদীদের জমা খরচ দিয়ে চলবে।
মূলতঃ ছাত্র শিবির একটি বুর্জোয়া ইসলামী সংগঠন হওয়ায় অন্যরা এতটা আলাপ করার সুযোগ পাচ্ছে।
আর নাহলে ভাবুন যে ৫ আগস্ট হাসিনার পতনটি হলো রাশিয়ার অক্টোবর বিপ্লবের মতো, সেক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিএনপিসহ আর বাকি সব দলের বিপরীতে শিবির হলো ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের বলশেভিক গ্রুপ, তাহলে আপনাদের এই দ্বিতীয় স্বাধীনতার পর ঘটনাটা কী দাঁড়াত? অতিরিক্ত অযৌক্তিক কথা বললে বন্দুকের নল কোন দিক দিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো বুঝছেন কি?
এবার আসেন বিব্রতকর অংশে। কোটা বিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানে রূপ দেওয়ার পরিকল্পক, স্ট্রাটেজিস্ট ও রাহবারের নাম গোলাম আজম খোমেনী ইহসান। যেহেতু সে দুই দশক ধরে একই কথা বলছে এবং একই বিপ্লবের গান গাইছে, তাই তার অবদান স্বীকার করলে সবার কোটারি স্বার্থেইতো আঘাত লাগে। তাই এএফপির শফিকুল আলমরা তাকে ডিনাই করতে ন্যারেটিভ দাঁড় করিয়েছে। শিবির নেতারাও খোমেনীর অবদানের কথা প্রকাশ করবে দূরে থাক নিজেদের ভূমিকার কথা না বলেও দেড় মাস চুপ ছিল। মাঝখানে সবাই বলে বেড়ায় ড. ইউনূসকে কেউ সরকার প্রধান চায়নি, এমনকি তিন বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে পরপর দুই দিন এনিয়ে ছাত্রনেতাদের সমন্বয়কও হয়েছে। কিন্তু ড. ইউনূসকে সরকার প্রধান করার আইডিয়া কার, তা কেউ এনডোর্স করেনি। যদি করতো তাহলেতো সে তার কুড়ি বছরের কাজ ধরে রাষ্ট্রযন্ত্র-ব্যাংক বীমা-ক্যাম্পাস-মিডিয়া সব ধরে টান দিত এবং এত দিনে সংবিধান বাতিল হতো ও আওয়ামী লীগসহ ফ্যাসিস্টরা নিষিদ্ধ হতো। এবং শিবিরের উদারতাকে দুর্বলতা ভাবা লোকগুলোকে তখন ইদুর গর্তেও খুঁজে পাওয়া যেত না।
এখানে মনে করিয়ে দেই, ছাত্র-গণঅভ্যুত্থানের সবচেয়ে বড় বেনেফিসিয়ারি হলেন খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান। আমি স্বীকৃতি পেলে ও সামনে আসলে ছাত্র সমাজ+ড. ইউনূস+সেনাপ্রধান+বিএনপি+জামায়াতের একটা নেক্সাস তৈরি করে দিতাম, তারপর বাংলাদেশের এক একটি দিন হতো এক বছরের মতো, কল্পনাতীত গতিতে রাষ্ট্র ও সমাজ বদলে যেত। সর্বোচ্চ ছয় মাস পর এ জাতি তার কোনো অতীত মনে করতে পারতো না।
কিন্তু আমরা সে সুযোগ পাইনি। জাতীয় বিপ্লব ব্যাপারটা কেউই বোঝেনি। তবে তারপরেও আমাদের টিমের কেউ না কেউ সামান্য সুযোগ পেয়েও বড় কাজ করছে। আল্লাহ যদি চায় তা বাস্তবায়িত হলেও এখনকার ক্ষমতা সম্পর্কিত লোকেদের চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যাবে।
শিবিরকে বলবো, প্রকাশ্য আসার পর প্রচলিত ধারায় ফিরে যেও না। মেরিটোক্রেটিক বাংলাদেশ গড়ার লড়াইটা করো, বাংলাদেশের পশ্চাৎপদ ছাত্রসংগঠনগুলো তোমাদের ধারেকাছেও আসতে পারবে না। স্রেফ এক পাতার একটা রূপকল্প ধরিয়ে দেব, একশ’ বছর ধরে শত্রুরা শুধু খাবি খেয়ে বেড়াবে। আমীন।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও স্ট্র্যাটেজিস্ট